মঙ্গলবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্ষমা কর অরিত্রী

ফাতিমা পারভীন

ক্ষমা কর অরিত্রী

প্রতিবাদের ভাষা যখন নিজের জীবনকে হরণ করে তখন তাকে আত্মহত্যা বলি। একটা নীরব প্রতিবাদের মধ্যে চলে গেল একজন অরিত্রী। গত ৩ ডিসেম্বর বিকালে কল দিলাম একজন রাজনীতিবিদের কাছে। জানতে চাইলাম বরগুনার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। শত ব্যস্ততার মাঝেও যেন মনটা চলমান পরিস্থিতির ওপরে পড়ে আছে। কল রিসিভ হলো অথচ ওপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ পেলাম। নারী কণ্ঠের কান্না। জানতে চাইলাম, কান্নার আসল রহস্যটি। যার কাছে রহস্য জানতে চাইলাম তিনিও কাঁদছেন। তারপর বললেন, আমার সহপাঠী ও ব্যাচ ’৮৫-এর বন্ধু দিলীপ অধিকারীর আদরের কন্যা ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির মেধাবী শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী ওই প্রতিষ্ঠানের তিন শিক্ষকের  অপমানের শিকার হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। শুনে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথার ওপরে। মনে হলো আমার প্রিয় পরিবারের একজনের বিয়োগ হলো। আমি কোনো দিনই অরিত্রীকে দেখিনি। অথচ আমার কাছে চিরপরিচিত হয়ে উঠল ছোট্ট এই মেয়েটি। ছুটে এলাম আমার বোনের মেয়ের কাছে। আমার বোনের কানে-মুখে অতি সন্তর্পণে মন খারাপের হেতুটি বলেছিলাম, যাতে আমাদের পরিবারের ছোট্ট অরিত্রী না জানতে পারে। জানলে শিক্ষকের প্রতি নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেবে। হাজারো প্রশ্ন ছুড়ে দেবে। জবাবহীন আমি নীরবে দাঁড়িয়ে নিজেকে অপরাধী মনে করব। কারণ পৃথিবীতে সব প্রশ্নের উত্তর বড়রা ছোটদের দিতে পারেন না। সেও ভিকারুননিসা নূন স্কুলেরই ছাত্রী। অন্য শাখার ভিন্ন ক্লাসের। অরিত্রী আমার মেয়ে, বরগুনার মেয়ে। আমাদের মেয়ে। তার মৃত্যু আমাদের বিবেককে তাড়িত করেছে। চোখে জল এনেছে। আগামীতে যেন অরিত্রীর মতো কেউ আত্মহননের পথ বেছে না নেয় তা আমাদের কাম্য। একটা ভুলের সমাধান আর একটা বড় ধরনের ভুল দিয়ে নিষ্পত্তি হতে পারে না। লেখাপড়া আমরাও করেছি। ভুল আমরাও করেছি। আমাদেরও শিক্ষক ছিলেন এখনো আছেন। যে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অরিত্রীর সামনে তার বাবাকে ডেকে এনে অপমান করেছেন তিনিও তো একদিন অরিত্রীর বয়সী ছিলেন। আমরা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নই, তিনিও যে কোনো দিন ভুল করেননি তা বলতে পারবেন না। তার শিক্ষক কোনো দিন তার বাবাকে ডেকে এনে এতটা অপমান-অপদস্থ করেছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। তিনি কী শিক্ষা পেয়েছেন জানি না, তবে শিক্ষক তো সবার থেকে আলাদা। তার মানবিক গুণাবলি থাকবে। তিনি জাতির মেরুদণ্ড। তিনি রাষ্ট্রের আদর্শ। তার মানবিক গুণাবলির কাছে কবি কাজী কাদের নেওয়াজও হার মেনেছেন। ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতাটি আজও মনে আছে। মুখস্থ করতে গিয়ে মায়ের বকুনির কথা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। শিখেছিলাম সেই শৈশবে শিক্ষকের মর্যাদা। হয়তো অরিত্রীকেও বাবা-মা শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ শিখিয়েই বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন।  আজ কী বলব ভাষা খুঁজে পাই না। শুধুই চোখের সামনে একজন অরিত্রীকে দেখি, বেঁকেচুরে এলিয়ে পড়া লকলকে আদর-মমতাভরা নিস্তেজ এক দেহ দেখি। একজন বাবার প্রতি শিক্ষকের অপমানের নীরব প্রতিশোধ দেখি। আজকাল স্কুলগুলোয় বেত বন্ধ হয়েছে। এখন আর অরিত্রীরা স্কুলে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় না। তবে এখন প্রায়ই রূঢ় আচরণের শিকার হয় তারা। তাদের অ্যাটিচিউড এখন বেতের লাঠির চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। অনেক শিক্ষককে দেখে আমাদের অরিত্রীদের ভয়ে সংকুচিত হয়ে মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়! এখান থেকে বের হওয়া উচিত। তারা শিশুদের শিক্ষক কিন্তু শিশুবান্ধব নন। পাঠদানের সময় অনৈতিক-অশ্লীল বাক্য ছুড়ে দেন। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাতে তাদের মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সুন্দর জাতি গঠনে তাই প্রয়োজন শিক্ষকদেরও কাউন্সেলিং করা। তাদের আরও প্রশিক্ষণের দরকার, যাতে তারা শিশুবান্ধব মানসিকতা নিয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষা দান করতে পারেন। অনেক অভিভাবককে আমি চিনি, যাদের রয়েছে শিক্ষকদের প্রতি প্রচুর অভিযোগ, কিন্তু তারা বলতে পারেন না। বললে সন্তান -দের পরীক্ষার রেজাল্টে নম্বরটা আশানুরূপ হবে না! শিক্ষকরা অভিভাবকদের মনে করেন তাদের গোয়াল-ঘরের স্থায়ী আর বাধ্য রাখাল। আর তারা হলেন মনিব। অরিত্রী শুধুই একজন শিক্ষার্থীর নাম নয়, অরিত্রী এক বিবেকের নাম। আমাদের পরিবারের আদর্শ এক বালিকার নাম। বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা জড়িত পরম শ্রদ্ধার নাম। এক নীরব প্রতিবাদের নাম। জানি, অরিত্রীকে নিয়ে আমাদের পত্রিকাগুলো লিখবে। মানববন্ধন হবে বিচারের দাবিতে। ঝড় উঠবে হয়তো বাংলার মাটিতে। হোক। প্রতিবাদ হোক। বিচার হোক এমন অমানবিক আত্মহননের পেছনে যার কালো হাতের ছোবল রয়েছে। মানুষের মুখের ভাষায় যদি একটি ভবিতব্য আলোর প্রদীপ নিভে যায় তবে তার ভাষা নির্বাক করা হোক। তিনি শিক্ষক নন, মানুষরূপী দানব। তাকে অপসারণ করা হোক। বিচার হোক। আজকেই হোক অরিত্রীদর সুরক্ষার শুদ্ধি অভিযান। তাহলে আমাদের অরিত্রীরা আলোর মুখ দেখবে। স্বপ্ন দেখবে সোনার বাংলার সোনার মানুষ হতে। কী জবাব দেবেন আজ আমাদের শিক্ষকরা! নাকি তারাও মনে মনে এমনই ভাববেন, একজন অরিত্রীর শিক্ষকের প্রতি এমন বিনম্র শ্রদ্ধা কবি কাজী কাদের নেওয়াজের শিক্ষকের মর্যাদার সারমর্ম বুঝি এমনই হয়! নাকি সবাই মিলে বলব, ক্ষমা কর অরিত্রী, আমাদের ক্ষমা কর।

লেখক : শিশু ও নারী অধিকার কর্মী

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর