রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শহীদদের যেন ভুলে না যাই

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

শহীদদের যেন ভুলে না যাই

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে অঝর ধারায়। যেমন সাহাবিদের তেমন রসুলেরও। কিন্তু কিছুই করার নেই। মুশরিকরা তাড়িয়ে দিচ্ছে তাঁদের। মদিনায় এসে ঘর বাঁধলেন নবীজি ও তাঁর বাহিনী। মন কিন্তু পড়ে রইল মক্কায়। আফসোস! মদিনায়ও শান্তিতে বাস করা গেল না। বার বার মদিনার সার্বভৌমত্বে আঘাত হেনেছে কাফির-মুশরিকের দল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জীবন বাজি রেখে লড়েছেন। দাঁত ভেঙেছেন। মাথা ভেঙেছেন। নিজেকে রক্তাক্ত করেছেন। প্রিয়জনদের হারিয়েছেন। তবু মদিনায় আঁচড় লাগতে দেননি তিনি। এভাবে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় মদিনার স্বাধীনতা সুসংহত হলো। এবার টার্গেট মাতৃভূমি মক্কা। মক্কাও একসময় বিজয় হয়ে গেল বিনা যুদ্ধে। তারপর বিদায় হজ। উম্মতকে শেষ নসিহত করলেন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। উম্মতকে বলে দিলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে আবার দেখা হবে কিনা আমি জানি না। হয়তো এটাই তোমাদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা।’ হজ শেষে ফিরে এলেন মদিনায়। জীবনীকাররা লিখেন, এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায়ই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়তেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁর মিশন সফল হয়েছে। এখন তাঁকে সাড়া দিতে হবে মহান প্রভুর দরবারে। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে তাঁর মনে পড়ছে পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। আজকের এই স্বাধীন মদিনা ভূমি পেতে কী কষ্টই না করতে হয়েছে তাঁকে। কত রক্ত ঝরেছে সাহাবিদের। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত কাছের কত মানুষকে কবরে শুইয়ে দিতে হয়েছে এই স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে। মনের আকাশে এসব ভাবনাই বারবার উঁকি দিচ্ছে তাঁর। একদিনের ঘটনা। গভীর রাত। কিছুতেই ঘুম আসছে না নবীজির। মনটা বড় ছটফট করছে। বিছানা থেকে উঠে সোজা চলে এলেন ওহুদের ময়দানে। শহীদদের কবরের সামনে দাঁড়ালেন। তাদের সঙ্গে কথা বললেন। মনের আবেগ ঢেলে তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি দিতে লাগলেন। আর বললেন, ‘হে আমার শহীদ ভাইয়েরা! তোমাদের অমর বীরত্বগাথার বরকতেই আজ আল্লাহতায়ালা আমাদের বিজয় দিয়েছেন। তোমাদের ত্যাগের জন্যই আজ আমরা স্বাধীন। আমরা তোমাদের ভুলব না। খুব শিগগিরই তোমাদের কাছে আমরা আসছি।’ সিরাতবিদরা লিখেন, দীর্ঘ সময় নিয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহীদদের কবর জিয়ারত করলেন। সেদিন নবীজি এতটাই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন যে, কিছুতেই তিনি কান্না থামাতে পারছিলেন না। তারপর বাসায় ফিরে এলেন। এ ঘটনা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে গিয়ে আমরা যাদের হারিয়েছি, আর যারা এখনো বেঁচে আছে, তাদের আমরা যেন ভুলেই আছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি চলছে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি কি? প্রায়ই তো পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, অমুক মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন। না খেয়ে কত মুক্তিযোদ্ধাই তো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আর শহীদদের কবর জিয়ারত করা, স্বাধীনতা ও বিজয়ের জন্য তাদের মাগফিরাত কামনার বিষয়টি তো সাধারণ মানুষ ভুলেই গেছে। দিবস এলে আমরা হয়তো লোক দেখানো কিছু করি। কিন্তু তাদের প্রাপ্য পাওনাটুকু কতটা পরিশোধ করছি? যে দেশের জন্য শহীদরা জীবন দিয়েছেন, সে দেশটিকেও তো সুন্দর-সমৃদ্ধভাবে গড়ে তুলতে পারিনি আমরা। কিয়ামতের দিন যদি তারা আমাদের প্রশ্ন করেন, রক্তে কেনা বাংলাদেশকে কেন তোমরা নিজেদের অন্যায়-দুর্নীতির কালো থাবায় বিষাক্ত করেছ? তখন কী জবাব দেব? রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন, শহীদদের কখনো ভোলা যাবে না। দেশের জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের সম্মান সবার ওপরে। যারা জীবিত তারা আমাদের মাথার মুকুট। মরে গেলে তারা হবেন আমাদের অহংকার। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা শহীদদের প্রেরণা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। এই হোক বিজয় দিবসের অঙ্গীকার। আল্লাহ আমাদের শহীদ ভাইদের জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাস্সিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর