মঙ্গলবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছিলেন যিনি

সুমন পালিত

পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছিলেন যিনি

জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির ঘৃণার লক্ষ্যস্থল। চেহারায় মানুষের মতো হলেও মানসিকতায় ছিলেন ঘৃণ্য জানোয়ার। অখ- পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতেছিলেন ইয়াহিয়া খান। ১৯১৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাবের চাকওয়ালে জম্ম  গ্রহণ করেন তিনি। পাঞ্জাবে জম্ম  গ্রহণ করলেও তিনি ছিলেন আইয়ুব খানের মতই পাখতুন গোত্রের সদস্য। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ব্রিটিশ ভারতের দেরাদুনের মিলিটারি একাডেমি থেকে ১৯৩৯ সালের ১৫ জুলাই কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন ইয়াহিয়া। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৯৪৭ সালে তিনি কোয়েটায় ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্টাফ কলেজে ইনস্ট্রাক্টর পদের দায়িত্বে ছিলেন।

১৯৫১ সালে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত হন। একই বছর কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি সীমারেখায় নিয়োজিত ১০৫ ইনডিপেনডেন্ট ব্রিগেডের কমান্ডার পদে নিয়োগ পান ইয়াহিয়া। ’৫৪ সালে ডেপুটি চিফ অব জেনারেল স্টাফ পদে নিয়োগ পান। এ সময় ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণে গঠিত আর্মি প্ল্যানিং বোর্ডের প্রধান নিযুক্ত হন। ’৫৭ থেকে ’৬২ সাল পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান আর্মি চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেন। ’৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিয়োগ পান। ’৬৬ সালের মার্চে ইয়াহিয়া খানকে তার দুজন সিনিয়র সহকর্মীকে ডিঙিয়ে আর্মি কমান্ডার-ইন-চিফ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

পেশাদারী মনোভাবের কারণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে ইয়াহিয়া খানের ওপর আস্থা রাখেন। ’৬৬ থেকে ’৬৯ তিন বছর পর্যন্ত পাকিস্তানের দুই অংশে ব্যাপক রাজনৈতিক অসন্তোষ আইয়ুব খানের ভিত নড়বড়ে করে দিলেও সেনা অভ্যুত্থানের কোনো চেষ্টা হয়নি আইয়ুব খানের প্রতি ইয়াহিয়া খানের আনুগত্যের কারণে।

বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চাপিয়ে দিলে বাংলাদেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশেও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার হুমকি সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের বদলে আইয়ুব খান তার একান্ত অনুগত সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দায়িত্ব দেন এবং নিজে পদত্যাগ করেন। ’৬৯ সালের ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে নিজের সাড়ে ১০ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটান। ইয়াহিয়া খান ওইদিন রেডিও এবং টেলিভিশন ভাষণে নিজেকে দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। আইয়ুবের একনায়কতন্ত্রী সংবিধান বাতিল করে ইয়াহিয়া দেশে নতুন সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচিত সরকার গঠনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এম এন হুদাকে সরিয়ে মেজর জেনারেল মোজাফফর উদ্দীনকে নিয়োগ করেন। এ পদে পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে সেনা মোতায়েন করা হয় ছাত্ররা যাতে আন্দোলন করতে না পারে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য কমাতে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন তিনি। বাঙালিদের নিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নতুন ব্যাটালিয়ন গঠনের উদ্যোগ নেন ইয়াহিয়া খান। ১৯৬৯-’৭০ অর্থবছরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে নতুন বাজেট প্রণয়ন করা হয় তাতে অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে ২.৮ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইয়াহিয়ার অধীনে ’৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে। প্রথমত, পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা। নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পাকিস্তানের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। সংবিধান প্রণয়নের পর জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনপুষ্ট দল সরকার গঠন করবে। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র দুটি বাদে সব আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হন তবে পশ্চিম পাকিস্তানে তারা একটি আসনেও জয়ী হতে পারেননি। এর ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতার মূল নিয়ন্ত্রক শক্তি সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠেন। পশ্চিম পাকিস্তানের দুই বৃহত্তর প্রদেশ পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে বিপুলভাবে জয়ী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো হতাশার মুখে পড়েন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ভুট্টো গং ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ভুট্টোর চাপে ইয়াহিয়া খান ’৭১ সালের ১ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে ১৬ থেকে ২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। কিন্তু দুই পক্ষ কোনো সমঝোতায় উপনীত হতে ব্যর্থ হয়। ইয়াহিয়া খান মুখে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনে সামরিক বাহিনীকে নিয়োজিত করেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সামরিক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে।

’৭১ সালের ২৫ মার্চ মাঝরাতে পাকিস্তান বাহিনী যে গণহত্যা চালায় তার নীলনকশা প্রণীত হয় অনেক আগেই। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় নির্বাচিত জাতীয় সংসদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে সামরিক জান্তার টালবাহানার প্রতিবাদে। অসহযোগ আন্দোলনে স্তব্ধ হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দান বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে ১০ লাখের বেশি মানুষের সমাবেশে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ইয়াহিয়া খান এ ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে আলোচনার জন্য সেনাবাহিনীর সদর দফতরে এক সভার আয়োজন করেন, যেখানে সিংহভাগ জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হামলার বিষয়ে মত দেন। তারা বলেন, ‘গুটিকয় ছাড়া সব বাঙালিই পাকিস্তানকে খণ্ডিত করতে চায় এবং এজন্য তারা সশস্ত্র হচ্ছে। তাদের সংগঠিত হওয়ার আগেই আঘাত হানতে হবে।’ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বাংলাদেশে যে গণহত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতেই ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আসার আগেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নবম ও ১৬তম পদাতিক ডিভিশনের সৈন্যদের বিমানযোগে ঢাকায় নামানোর ব্যবস্থা করেন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ-অনুশীলন করার নামে। পাকিস্তানি সেনারা শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় আসে। কারণ ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। সৈন্যরা তাদের সঙ্গে ভারী অস্ত্রশস্ত্র আনতে পারেনি। পরে জাহাজে করে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হয়। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ওইদিন রাত ১২টায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের একটি সামরিক অভিযান ঢাকায় পরিচালনা করার আদেশ দিয়ে যান। যে অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় অবস্থানরত স্বাধীনতাকামী ছাত্র এবং আওয়ামী লীগ সদস্যদের স্তব্ধ করা ও ঢাকার বাইরে সেনাবাহিনীতে কর্মরত সব বাঙালি সদস্যকে গ্রেফতার বা হত্যা করা। বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা ও চরম দমনাভিযান চালানোর জন্য ইয়াহিয়া খান এ এলাকার সেনা কমান্ডে রদবদল করেন। চরমপন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক পদ থেকে বাদ পড়েন অ্যাডমিরাল এ এস এম আহসান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান। এ দুটি পদসহ অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার দায়িত্ব পান চতুর্থ কোরের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, যাকে বেলুচিস্তানের কসাই বলে অভিহিত করা হতো। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর টিক্কা খানের নির্দেশেই শুরু হয়। অপারেশন সার্চলাইট সামরিক অভিযানে পাকিস্তানিরা সাধারণ মানুষের ওপর গণহত্যা চালানোর পাশাপাশি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের গ্রেফতার শুরু করে। তাদের মধ্যে কিছু বাঙালি অফিসারকে হত্যাও করা হয়। ফলে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা ব্যাপকভাবে এসব বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং রাজাকার-আলবদর-আলশামসের গণহত্যা, জ্বালাও-পোড়াও-ধর্ষণের মুখে লাখ লাখ মানুষ দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দেশের অভ্যন্তরেও লাখ লাখ মানুষ শহরাঞ্চল থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যুবসমাজের এক বড় অংশ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভারতের সুস্পষ্ট সমর্থন থাকায় তারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আঘাত হেনে হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালিয়ে যেত নতুবা ভারতে আশ্রয় নিত। এ পরিস্থিতিতে ইয়াহিয়া এপ্রিলের শুরুর দিকে লাহোরে দশম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজিকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। জেনারেল টিক্কা গভর্নরের দায়িত্বে থেকে যান এবং সেপ্টেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি হন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ’৭১ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে তার সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী সামরিক অভিযানে লিপ্ত।’ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পেছনে ভারতীয় মদদের অভিযোগ আনেন তিনি। জুলাইয়ে তিনি নিক্সনকে টেলিফোনে বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী সামরিক অভিযান গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ইতিমধ্যে বিশ্বজনমত সোচ্চার হয়ে ওঠে। পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে সে দেশের জনগণ ও সংবাদমাধ্যম ছিল বাঙালিদের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি সরাতে ’৭১ সালের নভেম্বরে ইয়াহিয়া ভারতের সঙ্গে পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের এক বিমানঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার দেশের তিন বাহিনীকে পাকিস্তানের মোকাবিলার নির্দেশ দেন।

ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া পাকিস্তান বাহিনীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ভারত আগে মুক্তিযোদ্ধাদের পরোক্ষভাবে সাহায্য করলেও ডিসেম্বর থেকে সরাসরি সহায়তা শুরু করে। পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ড গঠিত হয়। এ কমান্ডের প্রধান করা হয় অভিজ্ঞ সেনাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে। যৌথ কমান্ড গঠনের পর একের পর এক যুদ্ধে হারতে থাকে পাকিস্তানি বাহিনী। ইয়াহিয়া যুদ্ধ শুরুর প্রথম সপ্তাহেই বুঝে ফেলেন তারা পরাজিত হতে যাচ্ছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে এ আশায় তারা যুদ্ধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশ অংশে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থান রাজধানী ঢাকা ও বড় বড় শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তান অংশেও তারা ভারতের পাল্টা হামলায় পিছু হটতে থাকে। ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। পাকিস্তানের এ পরাজয়ের দায় ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপানো হয় অনেকাংশে। পাকিস্তানে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভ দেখা দিলে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন এবং ’৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ’৭০ সালের নির্বাচনে ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান। ক্ষমতা গ্রহণের কিছু দিন পর ভুট্টো ইয়াহিয়াকে গৃহবন্দী করেন। ’৮০ সালের ১০ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডিতে মৃত্যুবরণ করেন অখণ্ড পাকিস্তানের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট ও পাকিস্তান নামের পঙ্কিল রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সামরিক শাসক।

            লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

[email protected]

সর্বশেষ খবর