বুধবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভোট সুনামিতে জনপ্রত্যাশা তুঙ্গে উঠল

মেজর জেনারেল মো. আবদুর রশীদ (অব.)

ভোট সুনামিতে জনপ্রত্যাশা তুঙ্গে উঠল

একাদশ সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষে ভোট সুনামিতে বিরোধী পক্ষের রাজনীতি ভেসে গেল। এই ভোট সুনামির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশবিরোধী শক্তির অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে দিল বাংলাদেশের জনগণ। তৃতীয় বারের মতো তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে ক্ষমতায় নিল। এবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা একাট্টা হয়ে গত ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনাকে হটাতে গিয়ে ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে দিল তার পক্ষে। তাদের ধারণা ছিল ক্ষমতাসীনদের জনতুষ্টির অভাবকে কাজে লাগিয়ে গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবকে তুলে ধরে কেল্লা ফতে করবে। তবে নির্বাচনী প্রচারণায় দৃশ্যমান উন্নয়নকে অস্বীকার করতে পারেনি তারা। তখন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হচ্ছে না’ ইত্যাদি ধুয়া তুলে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আন্তর্জাতিক কিছু শক্তির সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতাকে ব্যবহার করে গণতন্ত্রের নতুন ধারণা সামনে এনে গণতন্ত্র উদ্ধারের ঝাণ্ডা তুলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে মানুষকে ভোট বিপ্লবের ডাক দেয়, জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য মিথ্যাচার করে নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করার মহাকৌশল নিয়ে এগিয়ে গেলেও জনগণ তাদের ধোঁকাবাজি ধরে ফেলেছে বলে মনে হলো ভোটের ফল দেখে।

পরাজয়ের গ্লানি ঢাকতে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টায় মেতে উঠেছে বিরোধী মহল। নতুন নির্বাচনের দাবি মানুষের ভোটের প্রতি অনাস্থা দেখানোর শামিল। মূলত গণরায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখিয়ে বিএনপি-জামায়াত গং গণতন্ত্র উদ্ধারের তত্ত্ব তুলে গণতন্ত্রবিরোধী মৌলবাদী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের নামে সহিংসতার দামামা বাজাচ্ছে।

বিরোধীদের পরাজয় এবং সরকারি দলের প্রতি জনগণের দেওয়া ম্যান্ডেট এসেছে মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অগাধ আস্থা ও উন্নয়নের মহাযাত্রাকে বেগবান করার প্রত্যাশার কারণে। সরকারি দলের বিরাট বিজয় প্রত্যাশার চাহিদাও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই আগামী পথচলায় সরকারি দলের সামনে নতুন পর্বতসম চ্যালেঞ্জের জন্ম হয়েছে।

প্রত্যাশা পূরণের জন্য আগামী দিনের সরকারের চেহারা ও চরিত্র জনগণের সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হতে হবে। দেশবাসী শুরুতেই নিজেদের ভোটের যথাযথ মর্যাদা আশা করে। সব প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্বচ্ছ ও সৎ গুণসংবলিত সুযোগ্য নেতৃত্বকে ঘিরে। বিরোধীদের সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান এবং সরকারি দলের প্রতি একচ্ছত্র সমর্থন প্রকৃত পক্ষে চ্যালেঞ্জকে আরও কঠিন করে তুলেছে। বিজয়ী দলের মধ্যে স্বেচ্ছাচারী প্রবণতা জন্মানোর স্বাভাবিকতাকে ঠেকানো তাদের প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত। জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে সরকারপক্ষকে যারা ভোট দিয়েছেন তাদের মাঝে সন্তুষ্টি তৈরি করবে। তাই এখন নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি নতুন করে পড়তে হবে সরকারি দলকে এবং অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতা এবং তার বাস্তবায়নে  বাংলাদেশের মানুষ শান্তি খুঁজে পেয়েছে এবং আস্থাভরে সরকারি দলকে ভোট দিয়েছে। এবার শুনেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতার কথা। যেখানে মানুষের মনের গভীরে বাস করছে দুর্নীতি ও নিপীড়নমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা। সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য সমাজে অসন্তুষ্টি গড়ে তোলে। তাদের আচরণ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং নিজ আধিপত্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমে দলীয় কোন্দলে মেতে ওঠে।

সংসদে বিরোধীপক্ষের ক্ষীণ অবয়ব গণতন্ত্র অনুশীলন ও ভিন্নমত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দাঁড়াতে পারে এই তাত্ত্বিক ধারণাকে উল্টে দেওয়ার জন্য করণীয় কৌশল বা বিকল্প পন্থা অনুসন্ধান ও চর্চা নতুন গুরুত্ব বহন করে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে। ভিন্নমত প্রকাশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে বেশি কার্যকর করা যাবে তার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। স্বাধীন মত প্রকাশকারীদের ক্ষমতায়িত করে শূন্যতা পূরণের বিকল্প হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে।

২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক তেলেসমাতি তত্ত্ব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে ছিল ভিন্ন আমেজ। সব দল অংশগ্রহণ করেছে, নির্ভয়ে সাধারণ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। আগ্রহভরে ভোট দিয়েছে মানুষ। ভোটের ফলাফলে বিরোধী পক্ষ নিরাশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী দেশের অনেকেই হতাশ হয়েছে। ফলে নির্বাচন-পরবর্তী ভূ-রাজনীতিতে সুনামির ধাক্কা লেগেছে। যা চ্যালেঞ্জকে আরও বহুমুখী করেছে। শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পড়েছে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে। মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ। যেখান থেকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথচলা শুরু করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বাংলাদেশ চলবে এবং বিকশিত হবে এবার এ প্রত্যাশা পোক্ত হয়েছে। নতুন বা তরুণদের ভোটে এবার সুনামি হয়েছে। তাদের প্রত্যাশাকে পড়তে হবে গভীরভাবে। তরুণরাই বদলে দিতে পারে সবকিছু, বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে উন্নয়নের চূড়ায়। তাদের কর্মসংস্থান ও সক্ষমতা বৃদ্ধির অবকাশ আগামীতে স্বভাবতই গুরুত্ব বহন করে। এবারের নির্বাচনের সুনামি ফলাফলের প্রত্যাশাকে  গতানুগতিক পথচলা দিয়ে পূরণ করা যাবে না বরং ভোট সুনামির বিপরীতে চিন্তার বিপ্লব ঘটিয়ে বিকশিত কর্মপন্থা ও কৌশল বানাতে হবে। দেশের পথচলায় বাধা দিতে এবার অপশক্তির আঘাতের মাত্রা ও পরিমাণ দুটোই বাড়বে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ধরে রাখতে তাদের চাহিদা ও প্রচারণার বিষয়গুলোকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। শঙ্কা ও সম্ভাবনাকে গভীর বিশ্লেষণ করে সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশবিরোধীরা উন্নয়নের গতিধারাকে শেখ হাসিনার আলাদিনের চেরাগ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের অস্তিত্ব ঠেকাতে অর্থনীতির গলা চিপে ধরার অপচেষ্টায় লিপ্ত হবে। দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিরাপত্তা কৌশল ও নিরাপত্তা সহযোগী গড়ে তোলার গুরুত্ব অপরিসীম। সার্বিক নিরাপত্তা কৌশল বিনির্মাণ দেশকে অযাচিত ও অদৃশ্য শক্তির ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখবে।

এবারের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্নের অবসান ঘটালেও সুশাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা চালাতে পারে। এই অপশক্তির সঙ্গে যোগ দিতে পারে দেশ-বিদেশি অপশক্তি। তাদের প্রতি স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের মদদ থাকতে পারে। অর্থনৈতিক ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কৌশলকে সম্পৃক্ত করে এগোতে হবে।

আগামী দিনে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে  জনগণের সব অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কৌশল বিনির্মাণ জরুরি হলেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে এটি অনেক বড় আকৃতির।

দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন  সম্ভব এবং সংবিধানের ধারাবাহিকতা ও অনুসরণে কোন অসুবিধা নেই তা প্রমাণ করেছে এবারের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা বদলাতে এ নির্বাচন অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতের ইতিবাচক নির্বাচনী ধারণা তৈরিতে এ নির্বাচন নতুন দিক খুলে দিল। তাই এ নির্বাচন বিতর্কিত করতে অনেক অপশক্তি ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের বিপরীতে এবার ভোট দিয়েছেন ভোটারেরা। ফলে স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে দেওয়া ম্যান্ডেট ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কোন পথে চলবে, কোন আদর্শ নিয়ে সামনে যাবে তার নির্দেশনা স্পষ্ট করেছে।

এ নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক। এখানে অংশ নেওয়া ভোটারদের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিয়ে আগামী দিনের উন্নয়নের পাশাপাশি গণতন্ত্র ও সুশাসন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার  দিকপাল হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে নতুন মর্যাদায় স্থাপন করবেন এ আস্থা মানুষের মনে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। এ দেশের মানুষ আস্থায় নিয়েছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে। যে কারণে তার দলের পক্ষে তাদের রায় একচ্ছত্রভাবে আবারও প্রদান করেছে। উন্নয়নের ধারা মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে। সেইসঙ্গে উন্নয়নের সুফল বৈষম্যহীনভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পুরনো চ্যালেঞ্জ নতুন অবয়বে উঠে এসেছে। বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের কৌশলকে জনগণের কাছে শুরুতেই দৃশ্যমান করতে পারলে আগামীতেও ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে আনন্দ উপভোগ করবেন ভোটদানকারীরা।

নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে। একইসঙ্গে জানিয়ে দিল তাদের প্রত্যাশার কথা। গভীর এবং অবিস্মরণীয় অবিচল আস্থা স্থাপন করেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। অনেক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আগামী নেতৃত্বকে এগিয়ে যেতে হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এর মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সৃষ্ট সব সংশয়ের অবসান ঘটেছে।

লেখক : স্ট্র্যাটেজি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইক্লাডস)-এর নির্বাহী পরিচালক।

সর্বশেষ খবর