বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

যুবসমাজকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব কে নেবে?

তসলিমা নাসরিন

যুবসমাজকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব কে নেবে?

কেউ কেউ বলে বাংলাদেশে জঙ্গি তৈরির গোপন কারখানা আছে। আমি বলি, যদি থাকেও, সেই কারখানাগুলো নিশ্চিতই অবৈধ, খবর পেলে কারখানার মালিককে বা জঙ্গি নেতাকে গ্রেফতার করবে পুলিশ। বন্দুকযুদ্ধে বেশ কিছু জঙ্গি নিহত হয়েছে, সে খবর আমরা পেয়েছি। কিন্তু বহুকাল থেকে প্রকাশ্যে মানুষকে জঙ্গি হওয়ার জন্য ইন্ধন জোগাচ্ছে কিছু লোক, তা কিন্তু দেখেও আমরা না দেখার ভান করছি। কয়েকটি আয়াত মুখস্থ করেই ভ- কিছু লোক ধর্ম ব্যবসায় নেমে পড়ে। যাঁরা কোরআনের সূরা মুখস্থ বলতে পারলেও আরবি ভাষা জানেন না বলে সূরার অর্থ জানেন না, তাঁরাই কিনা ধর্মবিশারদ সেজে দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা চষে বেড়াচ্ছেন! জ্ঞানী লোকের মুখ থেকে নানা রকম ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর শুনতে চায় সাধারণ মানুষ। জ্ঞানী লোকের ছদ্মবেশে যাঁরা আসছেন, তাঁরা আসলে জ্ঞানী নন, তাঁরা অতি ধুরন্ধর লোক। তাঁরা স্রেফ লোক ঠকানোর ব্যবসা করছেন। ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়ার নামে তাঁরা মানুষের মগজ ধোলাই করছেন, মানুষকে নারী-বিরোধী, গণতন্ত্র-বিরোধী, মানবাধিকার-বিরোধী, প্রগতিশীলতা-বিরোধী, আধুনিকতা-বিরোধী, মৌলবাদী তৈরি করছেন। সুর করে কিছু আয়াত বলে, ধর্মের নানা ঘটনার মনগড়া কিছু ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মভীরু মানুষের মাথা নষ্ট করার অধিকার অর্জন করছেন বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীদের একাংশ। ভক্তরা অঢেল টাকা পয়সা ঢালছে এঁদের পেছনে। সমাজের জন্য ক্ষতিকর ধর্ম ব্যবসায়ী বাংলাদেশে প্রচুর। ইসলাম নিয়ে যদি রাজনীতি চলতে পারে, ইসলাম নিয়ে ব্যবসা চলবে না কেন? কেউ এমন প্রশ্ন করতে পারেন। ধর্ম নিয়ে ব্যবসা আসলে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেই ব্যবসা যদি জনগণের জন্য এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয়, তবে তা বন্ধ করা জরুরি। ধর্ম যদি রাজনীতির মধ্যে ঢুকে যায়, তবে সেই রাজনীতি নিঃসন্দেহে মানুষের মঙ্গলের বদলে অমঙ্গল বয়ে আনে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সরিয়ে রাখাটা অত্যন্ত জরুরি। এতে ধর্মেরও ভালো, রাষ্ট্রেরও ভালো। কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীরা ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র চালানোর পক্ষে বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাজ হলো সরল সোজা-নিরীহ মানুষকে বিভ্রান্ত করা।

প্রায় সব ধর্ম ব্যবসায়ী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলেন। তাঁরা সবাই ধর্মীয় আইনে দেশ চালানোর পক্ষপাতী। দেশে শরিয়া আইন ছাড়া আর কোনো আইন তাঁরা চান না। এই আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও তারা এই আইন চান। ধর্ম ব্যবসায়ী মাত্রই নারীবিরোধী। তাঁরা নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না, নারীকে তাঁরা ঘরবন্দী দেখতে চান, স্বামীর দাসী হিসেবে দেখতে চান, যাদের নিজস্ব কোনো জীবন থাকবে না, যাদের পৃথক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। নারীদের কাজ ঘর-সংসারের জন্য জীবন উৎসর্গ করা, স্বামীর সেবা করা, স্বামীর আদেশ নিষেধ মেনে চলা, স্বামীকে সুখী করা, সন্তান জন্ম দেওয়া, আর সন্তান লালন-পালন করা। এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা প্রতিটি বয়ানে মেয়েদের ইস্কুল কলেজে লেখাপড়া করা, মেয়েদের চাকরি বাকরি করা, মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়ার বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছেন। যারা শুনছে, তারা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হচ্ছে। তারা নিশ্চয়ই নিজের কন্যাসন্তানকে শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হতে বাধা দেবে। এই ধর্ম স্ত্রীদের পেটানোর পক্ষেও বাণী দিচ্ছেন, স্ত্রীরা অবাধ্য হলে নাকি পেটাতে হবে। যারা তাদের বয়ান শুনছে, তারা নিশ্চয়ই স্ত্রীদের পেটাতে এরপর দ্বিধা করবে না।

প্রায় প্রতিটি ধর্ম ব্যবসায়ীই ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করছেন। তাঁরা আল্লাহ, রসুল, রসুলের আত্মীয়-স্বজন, রসুলের সাহাবিরা কখন কী বলেছেন, তা সুর করে বাংলায় বা আরবিতে শুনিয়ে দেন, যার অধিকাংশই তাঁদের বানানো। মুশকিল হলো, আরবিতে কেউ কিছু বললেই তাঁকে খুব জ্ঞানী বলে অজ্ঞজনরা ভেবে নেয়। ভেবে নেয় আল্লাহ তাঁদের বেহেশত ঠিক করে রেখেছেন। এই লোকগুলোকে বড় বিশ্বাস করে সাধারণ ধর্মভীরু মানুষ। আর এই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ওদের সংগে প্রতারণা করেই চলেছেন ধর্ম ব্যবসায়ীরা।

সবচেয়ে ভালো হয় যদি মানুষ ‘ইসলামের ইতিহাস’ ইসলামের ইতিহাসের বই থেকে জানে। ভালো হয় কোরআন হাদিস সম্পর্কে জ্ঞান যদি কোরআন হাদিসের বই থেকেই অর্জন করে। ভ- ধর্ম ব্যবসায়ী আর পীর-ব্যবসায়ীরা জ্ঞান বিতরণের নামে সমাজকে হাজার বছর পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করার, মুক্তচিন্তক আর প্রগতিশীলদের খুনের হুমকি দেওয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কোনো সরকার যদি মনে করে মুক্তচিন্তকদের খুন করা অপরাধ নয়, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে গণতান্ত্রিক সরকার নিজেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। সরকারের এ কথা জানা খুবই দরকারি যে, ধর্ম সম্পর্কে নিজের মতপ্রকাশ করার অধিকার শুধু মোল্লা মাওলানা হুজুর আর যাজক পুরোহিতদের নেই; যে কোনো ধর্ম, যে কোনো সংস্কৃতি, যে কোনো অন্যায় অবিচার নিয়ে প্রশ্ন এবং মন্তব্য করার অধিকার সবার আছে। ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে ধর্মের মালিকানা দিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ধর্ম সবার, যে বিশ্বাস করে, তার, যে বিশ্বাস করে না, তারও।

ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে। নিরীহ ধর্মভীরু যুবকদের পথভ্রষ্ট করার প্রক্রিয়া এখনো যদি বন্ধ না করা হয়, সর্বনাশ হবে। সরকার যদি সত্যিই সমাজকে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে চান, তবে ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করুন। ধর্ম ব্যবসায়ীরা বর্বরতা আর অসহিষ্ণুতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাঁদের ওয়াজে তাঁরা বলেন, ‘আমার ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বললে আমরা তাকে কুকুরের মতো হত্যা করব’। অধিকাংশ ধর্ম ব্যবসায়ীর বয়ান কাকে ঘৃণা করতে হবে, কাকে বিপদে ফেলতে হবে, কাকে হত্যা করতে হবে, কাকে নৃশংসভাবে খুন করতে হবে এ নিয়ে। প্রতিটি ধর্মই বর্বরতাকে দূরে সরিয়ে মানবিক হয়েছে। চার্লস ডিকেন্সের লেখা ‘এ ক্রিসমাস ক্যারল’-এ ক্রিসমাসের উৎসব ধর্মীয় উৎসব না হয়ে বরং দয়া-মায়া আর বন্ধুত্ব-সৌহার্দ্যরে উৎসব হয়ে উঠেছে। মানবিক বা যুক্তিবাদী হওয়ার জন্য অন্য ধর্মের কাউকে এভাবে এগোতে দেখিনি। যদি এগোত, তাহলে আইসিস বা বোকো হারাম নামের সন্ত্রাসী দল গড়ে উঠত না।

বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীদের একাংশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে কে কত বেশি বর্বর হতে পারে, কে কত জোরে হুংকার করতে পারে। যে যত বেশি পারে, সে তত বাহ্বা পায়। কিন্তু এখনো কেউ তাদের বোঝাতে পারছে না কেন যে, ধর্ম সম্পর্কে উপদেশ দেওয়ার সময় কে কত বেশি উদার, কে কত বেশি মানবিক, কে কত বেশি সহিষ্ণু সেটাই দেখতে হবে? কেউ তাদের বোঝাতে পারছে না, কেন হত্যাযজ্ঞ আমাদের বাঁচাবে না, শান্তিপ্রিয়তা আমাদের বাঁচাবে, ঘৃণা আমাদের বাঁচাবে না, ভালোবাসা বাঁচাবে?

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর