বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

গান গাই গান শিখি : রওশন আরা মুস্তাফিজ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

গান গাই গান শিখি : রওশন আরা মুস্তাফিজ

গান শেখার বই তেমন একটা বাজারে পাওয়া যায় না। যেগুলো পাওয়া যায় সেগুলো এমন কঠিন ভাষায় লেখা যে তা ছাত্রদের মধ্যে কোনো নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করতে পারে না। এর আগে ওস্তাদ মুন্সী রইস উদ্দিন যে বইটি লিখেছিলেন তা এযাবৎকাল ছাত্র-ছাত্রীদের একমাত্র সম্বল হিসেবে কাজ করেছে। বইটির নাম ‘ছোটদের সা রে গা মা’। অনেক সময় রাগ ভুলে গেলে আমিও ব্যবহার করি। উনি আমার নিজের ওস্তাদ ছিলেন, তাই বইটির অনেক সংস্করণ হওয়ায় আমি আনন্দিত বোধ করি। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আরেকটি বই, যা প্রকাশ করেছে বটেশ্বর বর্ণন। রওশন আরা মুস্তাফিজ আমাদের দেশের কণ্ঠশিল্পীর তালিকায় একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রেখেছেন, বিশেষ করে নজরুল-সংগীত ও ক্লাসিক্যাল সংগীতে। গান শিখতে গেলে সহায়ক গ্রন্থের প্রয়োজন আছে কি? শিল্পী লিখছেন খুব সহজ করে, আমরা কেন গান গাই, গান কি সবাই গাইতে পারে, সংগীতচর্চার প্রকৃত প্রেক্ষিত, গান শিখতে হলে গানের সহায়ক গ্রন্থ কেন প্রয়োজন, আমি কেন এ বই লিখছি, গান শেখার রীতি, স্কেল নির্বাচন পদ্ধতি, গান শেখার সহায়ক বাদ্যযন্ত্র, কণ্ঠসাধন পদ্ধতি, নিয়মিত সাধনার জন্য বিভিন্ন মাত্রা ও ছন্দ। এগুলো কোনো বইতে আগে পাইনি। তাই যখন একই মলাটে পেয়ে যাই পর্দার পরিচিতি, বিভিন্ন স্কেলে হারমোনিয়াম বাজানোর পদ্ধতি, তানপুরা কীভাবে বাজাতে হয়, তবলার উপাদান কতটুকু তখন আমি অবাক হয়ে যাই। এগুলো তো আমরা ওস্তাদের কাছে শিখেছি দিনের পর দিন ভক্তিভরে। এখন একটি বইতেই সব পেয়ে যাচ্ছি। রওশন আরা লিখেছেন সংগীতের আদি ইতিহাস। গান নিয়ে কিংবদন্তি, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতের পার্থক্য। সত্যি কথা বলতে কি, এগুলো আগে জানতাম না। আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গসংগীত কারা আনলেন তাও ভালো করে জানি না। এরা হলেন রাজা এবং জমিদার অধ্যুষিত কলকাতা, ঢাকা, বাঁকুরা জেলার বিষ্ণপুর, ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুর, রামগোপালপুর, ভবানীপুর, মুক্তাগাছা, ত্রিপুরা জেলার শিবপুর, কুমিল্লা, আগরতলা রাজবংশ, গোপালগঞ্জের তারাপদ চক্রবর্তী পরিবার। প্রথমে আসে রাজা স্যার সৌরিন্দ্র মোহন ঠাকুরের নাম [১৮৪০ থেকে ১৯১৪], প-িত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে [১৮৬০ থেকে ১৯৩৬]। রওশন আরা সুন্দরভাবে জানিয়েছেন যা একজন শিক্ষার্থীর জানা আবশ্যক। যেমন নাদ, শ্রুতি, স্বর, সপ্তক, স্থান, চল, বিকৃত স্বর, ঠাট, রাগ, আশ্রয় রাগ, জন্য রাগ, জাতি, গানের বিভাগ, যেমন কলি, ধাতু, পদ ও তুক, বর্ণ, অলঙ্কার, গমক, মীর, স্রুুত, আস, কণ্ঠস্বর, ভুষিকা, মূর্ছনা, প্রস্বন, পুকার, ছুট, কম্পন, আন্দোলন, আরোহণ ও অবরোহণ, গ্রহ স্বর ও ন্যাস স্বর, পকর, আলাপ, বিস্তার, দম ও খম, তেহাই, বাদী স্বর, সমবাদী স্বর, অনুবাদী স্বর, বিবাদী স্বর, বর্জিত স্বর, অল্পত্ব ও বহুত্ব, পূর্বাঙ্গ ও উত্তরাঙ্গ, সন্ধি প্রকাশ রাগ, সারগাম গীত বা স্বরমালিকা, লক্ষ্মণ গীত, সারগাম, ধুন। যারা গান শিখবেন তারা এগুলোর কিছুই শেখেন না। ফলে রয়ে যান অশিক্ষিত সংগীতজ্ঞ। যেমন আমি। এর কিছুই মনে নেই। মনে রাখার জন্য এইবই। আমাদের তাল সম্পর্কে জ্ঞানও খুব সীমিত। দাদরা, তেওরা, তাদের বাজানোর পদ্ধতি সুন্দরভাবে বোঝানো হয়েছে। যে ছাত্র-ছাত্রী তাল চিনবেন না, তারা হবেন তালকানা। তাই সম, অতীত, অনাঘাত বা ফাঁক, বিষম এগুলো জানতে হবে। শুধু তবলা নয়, চিনতে হবে পাখোয়াজ, ঢোলক, নাক্কাড়া, খোল, ডমরু ও মৃদঙ্গকে। এগুলোর বোলও জানতে হবে। যারা জানবেন না, তারা কীভাবে গান শিখবেন? আজকালকার শিল্পীরা সাধারণ দাদরা, কাহারবা, ত্রিতাল, দ্রুতলয়, একতাল, বিলম্বিত একতাল, চৌতাল, পাখোয়াজের বোল, আড়া চৌতাল, সেতার ঘানি, তিলওয়ারা, সুরফাঁক তাল, কিছুই শেখেন না। তাই যখন টেলিভিশনে ওদের গান শুনি, তখন হাসতে হাসতে পেট ফেটে যায়। যদি জিজ্ঞাসা করি কাশ্মীরি খেম্টা বা ভারতাঙ্গার কথা, তেওরা বা তিব্রা তালের কথা, ঝুমরার কথা, দিপচন্ডির কথা, পশতু তালের কথা তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। যারা মিউজিকের প্রডিউসার তারাও কিছুই শেখেননি।

সংগীতের নানা প্রকার, গীতিরীতি ও শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে প্রথমে এসেছে ধ্রুপদের কথা। তারপর ধামার বা হরি এবং হোলির কথা। এরপর খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, তারানা, গজল, সাদরা, দাদরা, নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। লোকসংগীতও বাদ পড়েনি। এর মধ্যে সংক্ষেপে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, কীর্তন, জারি গান ও সারি গানের কথা এসেছে। আমি অবাক হয়ে যাই যখন একই বইতে কীর্তন গানের উদ্গাতা শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভুর [১৪৮৫ থেকে ১৫৩৩] কথা ছবিসহ। তারপর বাউল গানের উদ্গাতা লালন শাহ [১৭৭২ থেকে ১৮৯০], মরমি সাধক হাসনরাজাকে [১৮৫৪ থেকে ১৯২২] খুঁজে পাই। আমি অবাক হয়ে ভাবী এত সুন্দর বইটি কীভাবে লিখলেন রওশন আরা। তাকে অভিনন্দন জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বইটি যেমন শিক্ষার্থীদের কাজে আসবে, তেমন আমারও। ধন্যবাদ রওশন।

 

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর