শনিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

হাসিনা সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

হাসিনা সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে

সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার বিপুল জয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অভিনন্দন জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের সাধারণ মানুষ, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদরা। এরা সবাই মনে করেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা জানিয়েছে তা এক অভূতপূর্ব ইতিহাস। প্রতিবেশী অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা দুই হাত তুলে বঙ্গবন্ধুতনয়াকে অভিনন্দনের পর অভিনন্দন জানিয়েছেন। ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সৌমেন মিত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নারকীয় হত্যার কথা ভুলতে পারি না, আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও কংগ্রেস দল ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। ১৩ দিনের যুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেছিলেন যেভাবে শেখ হাসিনা গত ১০ বছর এবং তার আগে ’৯০-এর দশকে আরও পাঁচ বছর রাজত্ব করে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করে দেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেটা দেখে সবারই শিক্ষা নেওয়া উচিত।’ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু মনে করেন শেখ হাসিনার জয় ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের জয়। আরএসপি নেতা মনোজ ভট্টাচার্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘আশা করি যেভাবে শেখ হাসিনা সে দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিয়ে আসছেন ভবিষ্যতেও তা দেবেন।’

ভারতের সংবাদমাধ্যম শেখ হাসিনার জয়কে একটি ঐতিহাসিক জয় বলে প্রতিবেদন ছেপেছে। ৪৭-৪৮ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব সংবাদপত্র মুক্তিযুদ্ধকে শুধু সমর্থনই করেনি, যারা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল বহুল প্রচারিত আনন্দবাজার পত্রিকা ফলাফল প্রকাশের পর প্রথম সম্পাদকীয়তে হেডিং করেছে ‘বিজয়বার্তা’। এই বিজয়বার্তায় তারা লিখেছে, ‘শেখ হাসিনা অতএব তৃতীয়বারের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার নাতিদীর্ঘ ইতিহাসে ইহা রেকর্ড, আওয়ামী লীগ যে ব্যবধানে বিরোধী দলগুলোকে পরাস্ত করিয়াছে, তাহাও অবশ্য রেকর্ড, বলিয়া দিতে হয় না যে, আওয়ামী লীগ নেত্রীর পিছনে প্রবল সমর্থন রহিয়াছে, ভোটবাক্সে তাহার প্রতিফলনও ঘটিয়েছে। একদিক হইতে এই সুস্পষ্ট জনমতাজ্ঞা বিরাট সুখবর। গত কয়েক বছর ধরিয়া যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশকে গ্রাস করিতে উদ্যত ছিল, তাহাতে এইবারের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরিয়া নানা রকমের উদ্বেগ জমা হইয়াছিল। অশান্তি ও সংকটের আশঙ্কার মেঘ ঘন হইতেছিল, শেষ পর্যন্ত ভোটের ফল আশা দিয়েছে যে, বিজয়ার্থী শেখ হাসিনা শক্তভাবে দেশের হাল ধরিবেন, রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির স্থিতির লক্ষ্যে আবদ্ধ সংস্কারসমূহকে আগাইয়া লইয়া যাইবেন, দেশকে দৃঢ়তর জমির ওপর দাঁড় করাইতে পারিবেন, ইতোমধ্যেই নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি চোখে পড়ার মতো, বাস্তবিক অনেক বিষয়ে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকে লজ্জায় ফেলিবার মতো। পরবর্তী স্থিতিশীল, প্রগতিবাহী সরকার সেই উন্নতির চাকা সাময়িকভাবেও স্তব্ধ হইতে দিবেন না এমন আশা করা যায়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দনবার্তা প্রেরণ করিয়াছেন। পার্শ্ববর্তী দুই দেশই বর্তমান সুসম্পর্ককে ভবিষ্যতে আরও অর্থবহ করিতে সচেষ্ট হইবে, আশা রহিল।’

‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র সহযোগী সম্পাদক সাগরিকা ঘোষ লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের এই জয় শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের জয়।’ প্রবীণ এবং জনপ্রিয় সাংবাদিক একদা বিবিসি ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞ সুবীর ভৌমিক মনে করেন, ‘শেখ হাসিনার জয় ঈর্ষান্বিত আমেরিকা ও পাকিস্তান মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করে দিয়েছে। এজন্য হাসিনা সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।’ তিনি আরও মনে করেন, ‘শক্তহাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ও তাঁর দলকে এর মোকাবিলা করতে হবে।’ সুবীরবাবু মনে করেন, যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন বিশেষ করে বিএনপির জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী খালেদার জনগণের ভোট চাওয়ার কোনো অধিকার নেই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই ভোটে তাদের পরাস্ত করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমস্ত বিরোধী দলের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বীকার করে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিলেও জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করে। তারা নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে সোচ্চার হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন তাদের অভিযোগের উত্তর দিয়ে বলেছিল নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকরা মনে করেন, খালেদার রাজত্বের সময় তার পুত্র তারেক রহমানের নির্দেশে গ্রেনেড হামলায় জড়িত বেশ কয়েকজন নেতা এবারে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজন জয়ী হলে সংসদের ভিতরে তারা দেশের নানা বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিলে তাতে সরকার পক্ষেরই লাভ হতো। স্বাধীনতার ৪৮ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ শাসন করেছে মাত্র ২১ বছর আর এই পাঁচ বছর ধরলে ২৬ বছর হবে। এরই মধ্যে তাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে।

এবারের সাফল্যের নেপথ্যে আরও একটি কারণ দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি। তিন মাস আগে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুসারে ভারতের বিএসএফ ও বিজিবি পশ্চিমবঙ্গে লুকিয়ে থাকা জামায়াতিদের নির্বাচন বানচাল করার পরিকল্পনা সফল হতে দেয়নি। ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে ঢুকতে পারেনি। নির্বাচনের দু-তিন মাস আগে থেকে শেখ হাসিনা ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য তারা কলকাতার বিভিন্ন হোটেলে গোপন বৈঠকে মিলিত হতো। সেখানে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হতো। কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশন অফিস ওই ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে ঢাকা ও দিল্লিকে ওয়াকিবহাল করে। এই ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের এক বিধবা মহিলাও উপস্থিত থাকতেন। উপস্থিত থাকতেন তৃণমূলের দুই সাংসদ, একজন লোকসভার সাংসদ আর একজন রাজ্যসভার সদস্য। এদের কেউ কেউ কয়েক বছর আগে খাগড়াগড় বিস্ফোরণকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল বলে ভারতের এনআইএ এবং বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা উভয় দেশের অর্থাৎ দিল্লি ও ঢাকা সরকারকে জানিয়েছিল। নির্বাচন ভ ুল করার ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাংলাদেশ সরকারের হাতে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ায় বিভেদকামী সংগঠনগুলো তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারেনি। এর সমস্ত কৃতিত্ব বাংলাদেশ প্রশাসনের। তৃণমূলের ওই দুই এমপির একজনের বাড়ি উত্তর বিহারে আর একজনের বাড়ি বাংলাদেশের সিলেটে। তিনি মৌলবাদী চক্রের সঙ্গে জড়িত। বছর ত্রিশ আগে তিনি সিলেট থেকে আসাম হয়ে কলকাতা আসেন। কলকাতায় এসে তিনি প্রথমে বামফ্রন্ট, তারপর কংগ্রেসে যোগদানের চেষ্টা করেন কিন্তু না পেরে তৃণমূলে ভিড়ে যান। তৃণমূল তাকে রাজ্যসভায় মনোনয়ন দেয়। এরাই হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মুসলিম ভোটব্যাংক। কিন্তু নির্বাচনে শেষ কথা বলে জনগণ। বাংলাদেশেও শেষ কথা বলেছে জনগণ। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক মহল মনে করে, শেখ হাসিনার নতুন সরকার গত ১০ বছর বাংলাদেশে যে উন্নয়ন শুরু করেছিল তার ধারাবাহিকতা শুধু বজায় রাখবে না, আরও একধাপ এগিয়ে তিনি সুশাসন দিতে পারবেন। সেজন্য জনগণ তাকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছে।

একটা প্রশ্ন থেকেই গেল তা হলো তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে গত ১২ বছর ধরে টানাপড়েন চলছে। ড. মনমোহন সিং থেকে নরেন্দ্র মোদি যতবারই উদ্যোগ নিয়েছেন ততবারই বঙ্গেশ্বরী দুই ধাপ পিছিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে মমতার মন্ত্রী ও সাংসদরা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনাকে জেতানোর জন্য আমরা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করব না।’ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কী দেখা গেল। ২০১৪ ও ’১৮ সালে শেখ হাসিনা এবং তার দলকে বাংলাদেশের জনগণ বিপুল ভোটে জয়ী করল। শুধু টুইট করে অভিনন্দন নয়, মমতার উচিত ছিল শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। মমতার একগুঁয়েমির একমাত্র কারণ হলো, পশ্চিমবঙ্গের বিহারি সংখ্যালঘুদের ভোটব্যাংক। এই ভোটব্যাংকের রাজনীতি উভয় দেশের মধ্যে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, মোদি আর চার মাস ক্ষমতায় আছেন। তিনি চার মাসের মধ্যে ঢাকার সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করতে পারবেন। ’৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এক করতে পেরেছিলেন। তাহলে মোদি কেন পারবেন না? আরও উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন তখন জ্যোতি বসু ও গনি খান চৌধুরীর যৌথ নেতৃত্বে ৩০ বছরের ফারাক্কা পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছিল। ভারতের কংগ্রেস দলের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ওই চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন, মমতা ব্যানার্জি তখনো বাগড়ার সৃষ্টি করেছিলেন। এসব তো ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞজনেরা প্রশ্ন তুলছেন মোদি কেন সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ডেকে মীমাংসা করছেন না। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই চুক্তির পক্ষে। এর উত্তর দেবে একমাত্র সাউথ ব্লক।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর