রবিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

কোরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রতিবেশীর হক

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

কোরআন-সুন্নাহর আলোকে প্রতিবেশীর হক

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আর ইবাদত কর আল্লাহর, শরিক করো না তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে। পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম-মিসকিন, প্রতিবেশী, অসহায়, মুসাফির ও নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে।’ সূরা নিসা, আয়াত ৩৬। এখানে রব্বুল আলামিন বলেছেন, ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর জন্যই এবং আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক না করার বিধান পরিষ্কার ভাষায় তিনি বলে দিয়েছেন। এ অকাট্য বিধানের পর তিনি আয়াতে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হক। তার মধ্যে মাতা-পিতার হক, আত্মীয়-স্বজনের হক, এতিমের হক ইত্যাদি রয়েছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ হকের সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ প্রতিবেশীর হকের কথা উল্লেখ করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রতিবেশীর হককে আল্লাহ কত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তা রক্ষা করা আমাদের জন্য কত জরুরি। প্রতিবেশীর হক সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি হাদিস আমরা উল্লেখ করছি। এক. বুখারি ও মুসলিমে এসেছে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জিবরিল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাগিদ করেছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে না জানি প্রতিবেশীকে মিরাসের অংশীদার বানিয়ে দেওয়া হয়।’ দুই. অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ইমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ মুসলিম। তিন. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে স্বীয় প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো সে-ই সর্বোত্তম প্রতিবেশী।’ ইবনে খুজাইমা, মুসনাদে আহমদ। চার. হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি এসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, এক নারীর ব্যাপারে খ্যাত সে বেশি বেশি (নফল) নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, দুই হাতে দান করে। কিন্তু জবানের দ্বারা স্বীয় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় (তার অবস্থা কী হবে?)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামে যাবে। আরেক নারী বেশি (নফল) নামাজও পড়ে না, খুব বেশি নফল রোজাও রাখে না আবার তেমন দান-সদকাও করে না; সামান্য দু-এক টুকরা পনির দান করে। তবে সে জবানের দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না (এই নারীর ব্যাপারে কী বলেন)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জান্নাতি। মুসনাদে আহমাদ, বুখারি। পাঁচ. অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো প্রতিবেশী যেন অন্য প্রতিবেশীকে তার দেয়ালে কাঠ স্থাপন করতে বাধা না দেয়।’ বুখারি, মুসলিম। ছয়. আরেক হাদিসে এসেছে, ‘যে তার (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে স্বয়ং আল্লাহ তার প্রয়োজন পূর্ণ করেন।’ মুসলিম। উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি প্রতিবেশীর অধিকার ও হক অপরিসীম। ‘প্রতিবেশী’ শব্দটি মানব-সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ফলে ইসলামে প্রতিবেশীর হককে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজকাল এ বিষয়ে আমাদের মাঝে চরম অবহেলা দেখা যায়। বিশেষ করে শহরের মানুষের মাঝে। বছরের পর বছর পার হয়ে যায় পাশের বাড়ির/ফ্ল্যাটের কারও সঙ্গে কোনো কথা হয় না, খোঁজখবর নেওয়া হয় না; বরং অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া হয়। অথচ প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ ও তাকে কষ্ট না দেওয়াকে ইমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। হাদিসের ভাষ্যমতে, পরিপূর্ণ ইমানদার হতে হলে অবশ্যই প্রতিবেশীর হক ও অধিকার আদায় করতে হবে। এখন আমাদের বুঝতে হবে প্রতিবেশী বলতে আমরা কী বুঝি। মৌলিকভাবে যিনি আমার পাশে থাকেন তিনিই আমার প্রতিবেশী। চাই আমার বাড়ির সঙ্গে তার বাড়ি হোক কিংবা দেশের সঙ্গে তার দেশ হোক। মুসলিম হোক, অমুসলিম হোক, নারী হোক কিংবা পুরুষ হোক সবাই প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত। প্রতিবেশী সাধারণত তিন শ্রেণির হয়। ১. অনাত্মীয় বিধর্মী প্রতিবেশী। এ ব্যক্তির হক প্রতিবেশী হওয়ার ভিত্তিতে। ২. মুসলিম প্রতিবেশী, যার সঙ্গে আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ ব্যক্তির হক প্রতিবেশী ও মুসলিম হওয়ার দিক থেকে। ৩. মুসলিম আত্মীয় প্রতিবেশী। এ ব্যক্তির হক প্রতিবেশী, মুসলিম ও আত্মীয় হওয়ার দিক থেকে। তবে প্রত্যেক শ্রেণিই যেহেতু প্রতিবেশী তাই প্রতিবেশীর সব হকের ক্ষেত্রে সবাই সমান হকদার। আর প্রতিবেশীর খোঁজখবর রাখা, বিপদাপদে এগিয়ে যাওয়া, একে অন্যের সুখ-দুঃখের শরিক হওয়া, হাদিয়া আদান-প্রদান করা, সেবা-শুশ্রুষা করা, প্রতিবেশীর কেউ মারা গেলে সান্ত¡না দেওয়া, কাফন-দাফনে শরিক হওয়া, একে অন্যের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া, প্রতিবেশীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রতিবেশীর কষ্টের কারণ হয় এমন সব ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি সবই একজন মুমিনের স্বভাবজাত বিষয়। এমনটিই ইসলামের শিক্ষা। প্রিয় পাঠক! আসুন, আমরা সবাই প্রতিবেশীর যথাযথ হক আদায় করে, ইমান পূূর্ণ করে রব্বুল আলামিনের রেজা ও সন্তুষ্টি হাসিল করি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুুফাসসির ও খতিব বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর