সোমবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

অবিস্মরণীয় হওয়ার সড়কে উঠলেন শেখ হাসিনা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

অবিস্মরণীয় হওয়ার সড়কে উঠলেন শেখ হাসিনা

১৯৭০ সালের নির্বাচন আমি দেখেছি। যদিও বয়স পূর্ণ না হওয়ায় তখন ভোট দিতে পারিনি। তবে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র, তারুণ্যের উদ্যমী রক্তের তাড়নায় স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্য হিসেবে আমাদের বাড়ির পাশের কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক ভোটারদের ভোটদানে সহযোগিতায় লিপ্ত থেকেছি কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি। গ্রামের কে ভোট দিতে এসেছে, কে আসেনি, তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে সারা দিন গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটেছি। নিজের দুই খানা পা ছাড়া অন্য কোনো বাহন বা যোগাযোগ ব্যবস্থা তখন ছিল না। কিন্তু ক্লান্তিবোধ আসেনি এক মুহূর্তের জন্য। ভোট কেন্দ্র আমাদের বাড়ির লাগোয়া হওয়ায় দুপুরে কত মানুষের জন্য আমার মাকে ভাত রান্না করতে হয়েছিল এবং সবাই মিলে খাওয়ার যে কী আনন্দ তা মনে পড়লে এখনো আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। মা আমার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন বেশ কিছু বছর হলো। এখন এসব স্মৃতি মনের পাটাতনে ভেসে উঠলে চোখ থেকে শুধুই বর্ষা নামে। এবারও ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রাক্কালে সারা দেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছি, মানুষের সঙ্গে কথা বলার মধ্য দিয়ে প্রচুর আনন্দ অনুভব করেছি। কথা বলার সময় নির্বাচন নিয়ে মানুষের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। তাতে সত্তরের নির্বাচনের একটা চিত্র আমার মানসপটে ধরা দিয়েছে। সত্তর, একাত্তর যারা আমরা দেখেছি তাদের স্মৃতি থেকে সেটি কখনো অম্লান হওয়ার নয়, হতে পারে না। সেটা ছিল উত্তাল তরঙ্গের মতো বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণের অপরূপ রূপের চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ। সত্তরের ৭ ডিসেম্বর ভোটের দিনের শেষ মুহূর্তের একটি ঘটনা ও দৃশ্য কখনো ভুলবার নয়। ভোট প্রদানের শেষ সময় ৪টা বেজে পাঁচ-সাত মিনিট হবে, এমন সময় সত্তর ঊর্ধ্ব একজন বৃদ্ধা লাঠি ভর দিয়ে কেন্দ্রের অদূরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের ছাউনিতে এলেন ভোটার নম্বরযুক্ত স্লিপ নেওয়ার জন্য। ভোট দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে, এখন আর ভোট দেওয়া যাবে না। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ মহিলা আমাদের সামনে মাটিতে বসে পড়লেন এবং চিৎকার কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। কোনো কথাতেই তিনি থামছেন না। বরং আরও বেগে কান্না ও চিৎকার করে বলতে থাকলেন, আমি শেখের বেটাকে ভোট দিতে এসেছি, ভোট না দিয়ে যাব না। ভোটের শেষপ্রান্তে সিনিয়রদের মধ্যে কেউ উপস্থিত নেই। আমরা একই বয়সের তিন-চারজন এরকম একটা বিপদের মধ্যে পড়লাম, কী করা যায় বুঝে উঠতে পারছি না। ভেবেচিন্তে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে গেলাম। তিনি আমাদের পরিচিত এবং এলাকারই অন্য একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমরা অনুনয় বিনয়ের সঙ্গে সব কিছু বললাম। স্যার প্রথমে কিছুতেই রাজি হতে চাইলেন না। কিন্তু আমরাও নাছোড়বান্দা, স্যারের ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলাম। অবস্থা বেগতিক দেখে স্যার বললেন, তোমাদের বিপরীত পক্ষ মুসলিম লীগের এজেন্ট, তারা যদি আপত্তি না করে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। মুসলিম লীগের এজেন্টরাও জানত এ কেন্দ্রে তারা এক শতাংশ ভোটও পাবে না, পরাজয় সুনিশ্চিত। তাই তারাও আর আপত্তি করল না। আমাদের চেষ্টা সফল হলো। আমাদের মায়েরতুল্য মহিলাকে কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে আমরা বাইরে অপেক্ষা করছিলাম ভোট প্রদান শেষে বাইরে আমাদের সামনে এসে দন্তহীন মাড়ি বের করে যে প্রাণভরা হাসিটা তিনি দিলেন তাতে উচ্ছ্বসিত হয়েছি বটে, তার প্রকৃত মূল্য তখন বুঝতে পারিনি, বোঝার মতো আক্কেল হয়নি। এখন পরিণত বয়সে যখন ফিরে তাকাই তখন মনে হয় বাংলাদেশের সর্বত্র তখন এরকম হাজার লক্ষ হাসির সৃষ্টি হয়েছিল বলেই তার অন্তর্নিহিত শক্তির জোরে একাত্তর সালে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধের মাথায় পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পেরেছিলাম। সাড়ে সাত কোটি মানুষের হৃদয়কে বঙ্গবন্ধু স্পর্শ করতে পেরেছিলেন বলেই সেই সম্মিলিত হৃদয়ের শক্তির দ্বারা এত বড় অসম্ভবকে আমরা সম্ভব করতে পেরেছিলাম। তাই জনমানুষের শক্তি কী করতে পারে তা বোঝার জন্য বারবার আমাদের সত্তর-একাত্তরের দিকে তাকাতে হবে। এই জনমানুষকে উপেক্ষা করে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত বিদেশিদের কাছে ধরনা দেওয়া এবং ধোঁকাবাজি আর মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাময়িক সময়ের জন্য সুবিধা পাওয়া গেলেও শেষ বিচারে তাদের যে চরমভাবে পরাজিত হতে হয় তার উদাহরণ সত্তর-একাত্তর এবং সেটি পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপির ভূমিধস পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। সত্তরের নির্বাচনের প্রাক্কালে সারা দেশে একটাই রব ছিল নৌকা ও শেখ মুজিব। প্রার্থী কে সেটা কোনো বিবেচনাই ছিল না। অনেক ভোটার নিজ এলাকার প্রার্থীকে চিনত না এবং নামও জানত না। তারা অকাতরে ভোট দিয়েছে নৌকা ও শেখ মুজিবকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে সে রকমই একটা পরিবেশ সারা বাংলাদেশে দেখেছি। মানুষের মুখে ছিল নৌকা ও শেখ হাসিনা। প্রার্থী কে সেটা মানুষ বিবেচনায় আনেনি। প্রার্থী বিবেচনায় আনলে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীই ধরাশায়ী হতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং সত্তরে যেমন পিতা শেখ মুজিবের প্রতি মানুষ আস্থা রেখেছিল, তেমনি ২০১৮ সালে এসে মেয়ে শেখ হাসিনার প্রতি মানুষ সীমাহীন আস্থা রেখেছে। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ভোটের ফলের মধ্যে। অভূতপূর্ব নির্বাচনে বিশাল বিজয়। যত বিশাল বিজয় তত বেশি দিগন্তহীন প্রত্যাশার সৃষ্টি, যার বিপরীতে নতুন সরকার দল, শেখ হাসিনার সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থকরা আত্মপ্রসাদে থাকলে মহা সর্বনাশ হবে। পঁচাত্তরকে মনে রাখতে হবে সর্বক্ষণ। প্রাপ্তিরও একটা ওজন আছে। এই ওজন বহন করার সক্ষমতা শেখ হাসিনার রয়েছে বলেই মানুষ তাকে দুই হাত ভরে ভোট দিয়েছে। ৩০ ডিসেম্বর মানুষ ভোটের মাধ্যমে রায় দিয়েছে এদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতি তারা আর দেখতে চায় না। দীর্ঘ ৩৭ বছর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, সূক্ষ্ম ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশলী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষজনিত বিভাজনের অবসান ঘটানোর দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন। এর চূড়ান্তকরণের দায়ও এখন শেখ হাসিনার। তরুণ প্রজন্মের ভিতর তিনি নিজেই এই প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছেন। এটা দুভাবে হতে পারে। বিএনপি নিজের উপলব্ধি থেকে জামায়াত ত্যাগ এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কবল থেকে মুক্ত হয়ে মতাদর্শগত জায়গায় বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক নীতি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্বলিত মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শনে ফিরে আসতে পারে। তা শুধু মুখে নয়, দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে সেটি দৃশ্যমান করার জন্য জাতির পিতার প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান প্রদর্শনসহ মুক্তি সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সবকিছুকে আপন করে নেবে এই অর্থে যে, এগুলো কোনো দলের নয়, সমগ্র জাতির সম্পদ। তাহলে বর্তমান বিএনপিকে ঘিরেই তৈরি হতে পারে আওয়ামী লীগের বিপরীতে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। কিন্তু বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের কাঠামো ঠিক রেখে এটা করা সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত কঠিন কাজ। বিএনপি যদি এটা করতে না পারে তাহলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত দশ বছরের মতো বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার যাত্রাপথে বিএনপি নামক দলটি রাজনীতি থেকে ঝরে পড়বে এবং সেই শূন্যস্থান পূরণে আওয়ামী লীগের বিপরীতে উত্থান ঘটবে নতুন রাজনৈতিক পক্ষের, যারা পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী হবে। সামরিক শাসক কর্তৃক প্রবর্তিত রাজনৈতিক দল বিশ্বের কোথাও টিকে নেই। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হবে এমন বাস্তবতা নেই। আজ ইন্টারনেটের চাইতেও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলছে তরুণ প্রজন্মের মন-মানসিকতা। তার সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যর্থ হলে যা হওয়ার তা-ই হবে। তবে আমি যত সহজে বলছি কাজটি তত সহজ নয়, অত্যন্ত কঠিন, দুর্গম পথ এবং আগামী দিনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। শেখ হাসিনা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সফল হলে মানুষের বাকি অনেক প্রত্যাশা পূরণের কাজ সহজ হয়ে যাবে। তখন বাহাত্তরের সংবিধান পরিপূর্ণভাবে ফিরে আসবে এবং রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের চির অবসান ঘটবে। এটা ঘটার পরেই শেখ হাসিনার অবিস্মরণীয় নেতা হওয়ার যাত্রা শেষ হবে এবং তিনি প্রতিষ্ঠিত হবেন সে রকমই একটা আসনে যে রকম আসনে আমেরিকার জনগণ বসিয়েছে আব্রাহাম লিংকনকে। আমেরিকান জাতির ফাউন্ডিং ফাদার না হয়েও লিংকন আজ ফাউন্ডিং ফাদারের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তিনি দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বলেই আমেরিকা বিশ্বশক্তিতে পরিণত হতে পেরেছে, তা না হলে এটা সম্ভব হতো না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। আর ১৯৭৫ সালের পর জিয়াউর রহমান কর্তৃক বিভক্ত হওয়া জাতিকে, আজকের ১৬ কোটি মানুষকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করে শেখ হাসিনা হবেন দ্বিতীয় ফাউন্ডিং ফাদার। তারপর বাংলাদেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না, কেবলই হবে সামনে যাওয়ার অগ্রযাত্রা। কঠিন দুর্গম পথ অতিক্রম করে এই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে যাত্রার সঙ্গী হিসেবে রাখতে হবে, যে যাত্রায় তারা ইতিমধ্যেই শামিল হয়েছেন, যার চিত্র ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের ফলের ভিতর দিয়ে দেখা গেছে। তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে রাখতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যে ঘোষণা তিনি দিয়েছেন তার বাস্তবায়নের চিত্র সবার কাছে দৃশ্যমান হতে হবে। শুধু মুখের কথায় কাজ হবে না।  দলের মন্ত্রী, এমপি ও সব পর্যায়ের নেতাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। উন্নয়ন ও জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনের মতো দুর্নীতি দমনেও বাংলাদেশ হবে রোল মডেল, এমন প্রত্যাশা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জন্মেছে, সেটিকে ধরে রাখতে হবে। এটি সম্ভব হলে বহুল প্রত্যাশিত সুশাসন স্বাভাবিক পথ ধরেই চলে আসবে। তখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের স্রোত আসবে বাংলাদেশে, যার পথ ধরে তরুণ প্রজন্মের জন্য বিশাল কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত হবে। সেটাই হবে সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। এটি কিন্তু এখন আর কথার কথা নয়, গত ১০ বছরের অগ্রযাত্রাই সেটি প্রমাণ করে। মানুষের প্রত্যাশা জন্মেছে শেখ হাসিনাই পারবেন এবং তিনিই হবেন বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় মহান নেতা।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর