মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আদর্শ মানব গঠনে নারীর ভূমিকা

মুফতি আইনুল ইসলাম কান্ধলবী

আদর্শ মানব গঠনে নারীর ভূমিকা

একজন সফল পুরুষের পেছনে কোনো না কোনো নারীর অবদান অবশ্যই থাকে। কখনো মা, কখনো স্ত্রী বোন, অথবা কন্যা নেপথ্যে ভূমিকা পালন করেন। রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। মহান আল্লাহ তাঁকে এমন মর্যাদা দিয়েছেন যে, আল্লাহর পরে তিনিই মহান। কিন্তু রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যখন প্রথম ওহি অবতীর্ণ হলো তখন তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘরে ফিরে এলেন এবং স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে বললেন, জাম্মিলুনি জাম্মিলুনি (আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দাও)। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হজরত জিবরাইল (আ.)-কে তাঁর আকৃতিতে প্রথম দেখলেন তখন তিনি ঘাবড়ে গেলেন। এক ধরনের ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। তিনি বললেন, খাসিতু আলা নাফসি (আমি আমার জীবনের আশঙ্কা করছি)। তখন খাদিজা (রা.) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘কখনো নয় হে প্রিয়! আপনি তো আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখেন, আপনি অসহায়ের সহায়, অতিথি-পরায়ণ, অনাথ-আশ্রয়হীনের আশ্রয়।’ এভাবে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কয়েকটি উন্নত চরিত্রের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘যখন আপনার মাঝে এমন চরিত্রমাধুর্য বিদ্যমান তখন আল্লাহ আপনাকে কখনই ধ্বংস করবেন না।’ এমন অভয় বাণী শুনে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্ত হলেন। সুতরাং তাঁর জীবনে নারীর অবদান স্ত্রীরূপে আবির্ভূত হলো। যিনি কঠিন মুহূর্তে তাঁকে সান্ত্বনা দিতেন এমনকি তাঁর সঙ্গে বিয়ের পর তিনি নিজের সমুদয় সম্পদ তাঁর কদমে লুটিয়ে দিলেন আর রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সম্পদ দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন। হজরত আবু বকর (রা.)-কে আল্লাহর রসুলের গুহার সঙ্গী, সফরসঙ্গী ইত্যাদি বলা হয়। আমরা যদি তাঁর ইতিহাস পড়ি তবে আরও একজন নারীর অবদানের কথা জানতে পারব। হাদিসে এসেছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হজরত আবু বকর (রা.)-এর ঘরে তাশরিফ আনলেন এবং ইরশাদ করলেন, ‘আবু বকর! আমি তোমার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।’ হজরত আবু বকর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর হাবিব! এখানে আমি, আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা ছাড়া অন্য কেউ নেই।’ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘আল্লাহ আমাকে হিজরতের নির্দেশ দিয়েছেন।’ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হজরত আবু বকর (রা.)-এর বড় কন্যা হজরত আসমা (রা.) তৎক্ষণাৎ তাঁর ওড়নাটি দুই টুকরা করে ফেললেন। একটি তাঁর পর্দার জন্য মাথায় জড়িয়ে রাখলেন আর অন্য খণ্ডের মধ্যে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফরের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী বেঁধে দিলেন। আবু বকর (রা.) তাঁর স্ত্রীকে বললেন, তুমি খাবার তৈরি করে দেবে আর নিজ কন্যা আসমা (রা.)-কে বললেন, তুমি যেহেতু ছোট তাই তুমি গারে সাওরে খাবার পৌঁছে দেবে কারণ তোমাকে কেউ সন্দেহ করবে না। অতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে হিজরতের উদ্দেশ্যে গারে সাওরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হজরত আসমা (রা.)-এর দাদা আবু কুহাফা এসে জিজ্ঞাসা করলেন আবু বকর কোথায়? হজরত আসমা (রা.) বললেন তিনি তো চলে গেছেন। এ কথা শুনে আবু কুহাফা যেন ভয় পেয়ে গেলেন এবং বললেন ধনসম্পদ সবকিছু নিয়ে যায়নি তো? আসমা (রা.) বয়সে ছোট হলেও একটা কৌশল করলেন। তাঁর সামনে থাকা কিছু পাথর কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর দাদার হাতটি ওই পাথরগুলোর ওপর রেখে বললেন, ‘দাদাজান! আব্বাজান অনেক কিছু রেখে গেছেন।’ দাদা ভাবলেন হয়তো তার ছেলে বলেই অনেক সহায়সম্পদ রেখে গেছেন। তিনি আশ্বস্ত হয়ে গেলেন। হজরত আসমা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের পিতা যখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে চলে গেলেন তখন পাঁচ হাজার দিরহাম সঙ্গে নিয়ে গেলেন। আমাদের জন্য আল্লাহ ও রসুল ছাড়া আর কিছু রেখে যাননি। আমি প্রতিদিন নিয়মিত খাবার পৌঁছে দিতাম। দ্বিতীয় দিন যখন আমি খাবার নিয়ে গেলাম তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন “আরে আসমা! তোমার মুখে আঘাতের দাগ দেখা যাচ্ছে এবং তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। আসমা তোমার কী হয়েছে, তুমি উদাস কেন?” এ কথা শুনে আমার চোখে পানি এসে যায়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, “আসমা তুমি কাঁদছো কেন?” আমি বললাম, হে আল্লাহর হাবিব! গতকাল আমি যখন খাবার দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তায় আবু জাহালের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সে আমার চুলগুলো শক্ত করে ধরে জিজ্ঞাসা করে- “হে আসমা! তুমি কি জান তোমার বাবা কোথায়? তোমাদের নবী কোথায়? ... ... তারা কোথায়?” আমি বললাম, কখনো বলব না। আবু জাহাল বলল, “আমি এখন তোকে হত্যা করব।” ও আল্লাহর হাবিব! আমি তাকে বলে দিলাম, তোমার যা করার দরকার তা কর কিন্তু আমি বলব না। হঠাৎ সে আমাকে সজোরে চপেটাঘাত করল। একটি পাথরখণ্ডের সঙ্গে আমার মাথায় সজোরে আঘাত লাগে। আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। মাথা থেকে রক্ত পড়তে থাকল, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তখন আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। আবার আমার চুল ধরে একটানে দাঁড় করাল এবং হুমকি দিল- “তাড়াতাড়ি বল তারা কোথায়? নয় তো মেরে ফেলব।” আল্লাহর হাবিব! আমি তাকে জবাব দিলাম, আবু জাহাল শোনো আমার কথা, জীবন তোমার হাতে তুলে দিতে পারি কিন্তু মুহাম্মদকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারি না।’ হজরত আসমা (রা.) ছোট মানুষ, তাঁর কী ভালোবাসা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি! আবু জাহালকে বললেন, ‘আমার জীবন তোমার হাতে দিয়ে দিলাম তবু মুহাম্মদকে তোমার হাতে দিতে পারি না।’ হজরত আবু বকর (রা.)-এর হিজরতের পেছনে আমরা কন্যারূপী একজন নারীর অবদান দেখতে পাই।

                লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর