শনিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা

ড. আতিউর রহমান

এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা

নতুন বছরের শুরুতেই আমরা একটি তারুণ্যোদীপ্ত নতুন মন্ত্রিসভা পেয়েছি। আর পেয়েছি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ অর্থনীতির এক আশাজাগানিয়া সংবাদ। সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বে বড় অর্থনীতির তালিকাটি কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশে নতুন সরকারের শপথ নেওয়ার দিনই প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার দুই ধাপ পেরিয়ে ৪১তম অবস্থানে পৌঁছে গেছে। আর ২০৩৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থান হবে ২৪তম। তার মানে আগামী ১৫ বছরে ১৭টি দেশকে টপকে যাবে বাংলাদেশ। গত ১৫ বছরে টপকেছে ১২টি দেশ। আগামী পাঁচ বছরে অর্থাৎ সদ্য শপথ নেওয়া সরকারের আমলেই পাঁচটি দেশকে টপকে যাবে বাংলাদেশ। তখন তার অবস্থান হবে ৩৬তম। এর পরের পাঁচ বছর আরও নয়টি দেশকে টপকে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৭তম। এর পরের পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০৩৩ সালে আরও তিনটি দেশকে টপকে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৪তম। তখন আমরা মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোকে পেছনে ফেলে দেব। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের অর্থনীতির আকার আগামী ১৫ বছরে আড়াই গুণ বেড়ে ১.০৫ ট্রিলিয়ন ডলারে (অর্থাৎ স্থির মূল্যে ২৯ লাখ ১৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা) উন্নীত হবে। বর্তমানে তা ২৮৬ বিলিয়ন ডলার (যা স্থির মূল্যে ১১ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা)। এই সময়টায় আমাদের অর্থনীতি গড়ে ৭ শতাংশ হারে বাড়বে। আমার ধারণা, বাস্তবে প্রবৃদ্ধির হার আরও বেশি হবে। এরই মধ্যে এ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতের পরই তার স্থান। ভারত এরই মধ্যে বিশ্ব তালিকায় পঞ্চম স্থানে পৌঁছে গেছে। ২০৩৩ সালে তার অবস্থান হবে তৃতীয়। বর্তমানে বাংলাদেশের পরে রয়েছে পাকিস্তান (৪৪তম), শ্রীলঙ্কা (৬৬তম), নেপাল (১০১তম), আফগানিস্তান (১১৫তম), মালদ্বীপ (১৫৬তম) ও ভুটান (১৬৬তম)।

শুধু আকারেই নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নসূচকেও বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় এক নম্বর দেশ। আরেকটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন থেকে এ কথাটি জেনেছি। ২০১৮ সালের শুরুতে প্রকাশিত আইএমএফের হিসাবমতে এ ‘আইডিআই’ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। তার মানে সব মিলে অর্থনীতির বাড়ন্ত কেকটির ভাগ সমাজের নিচের দিকের মানুষও পাচ্ছে। আয়বৈষম্য বাড়লেও ভোগবৈষম্য ততটা বাড়েনি। আশা করছি, এ বছর আর কদিনের মধ্যে যে হিসাবটি বের হবে তাতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সূচকের উন্নতিই হবে। লিঙ্গসাম্যের সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ১ নম্বর। বিশ্বে ৪৮তম। জীবনের গড় প্রত্যাশিত আয়ু, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, দম্পতিপ্রতি সন্তানের সংখ্যা বিচারেও বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়া তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের গড় অবস্থানের চেয়ে অনেক ওপরে। এ অগ্রগতি এমনি এমনি হয়নি। গত এক দশকে সরকারের ধারাবাহিকতা, ভোগ ও বিনিয়োগের ঊর্ধ্বগতি এবং সামাজিক সংরক্ষণ সমর্থন ছাড়াও অসরকারি ও ব্যক্তি খাতের সামাজিক দায়বদ্ধ কর্মকান্ডের ভূমিকাও ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পে ব্যাপক হারে নারীর কর্মসংস্থান, কৃষির ধারাবাহিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতির কারণেও এমন অগ্রগতি অর্জন করা গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সিইবিআরের এ প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এই ধারাবাহিক উন্নতির পেছনে যেসব কারণ কাজ করেছে তার মধ্যে রয়েছে ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ ভোগের চাহিদা, সরকারি ব্যয়, প্রবাসী আয়, রপ্তানি, ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগসহ অর্থনীতির আধুনিকায়ন। বিদ্যুৎ সরবরাহেও ঘটেছে ব্যাপক উন্নতি। তা ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও ছিল উল্লেখ করার মতো। এসবের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি ওপর। রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বিনা শুল্কে ভারতে আমাদের পণ্যের ক্রমবর্ধমান প্রবেশ। গত বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই আমরা ভারতের কাছে ৩৭৫ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে নিশ্চয়ই বছর শেষে ভারতে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তবে এ প্রতিবেদন বাড়ন্ত আমদানির কারণে আমাদের রপ্তানি যে ঝুঁকিতে পড়তে পারে সে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে। ২০১৭ সাল থেকে আমাদের চলতি লেনদেনে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা ২০১৮ সালে আরও বেড়েছে। তাই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার জন্য বলেছে এ প্রতিবেদন। একই সঙ্গে এ প্রতিবেদন কর বাড়ানোর দিকে বাংলাদেশ সরকারকে মনোযোগী হতে বলেছে।

এ প্রেক্ষাপটেই যাত্রা করল নয়া মন্ত্রিসভা। আমরা নতুন সরকারের কাছে অগ্রগতির এ অভিযাত্রা ধরে রাখার জন্য বেশ কিছু প্রত্যাশা করতেই পারি। বিশেষ করে বেশ কিছু কাঠামোগত সংস্কার ত্বরান্বিত করে দ্রুত বাড়ন্ত এই অর্থনীতির চাকাকে আরও বেগবান করার জনপ্রত্যাশা যে বেড়ে গেছে তা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই। এসব কাঠামোগত সংস্কার বিষয়ে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে যে ইশতেহার উপস্থাপন করেছেন তাতেও আছে। সেই জনপ্রত্যাশার আলোকেই এ সরকারকে নিরন্তর কর্মতৎপর থাকতে হবে। সুশাসন ও গুণমানের জনসেবা দিয়েই এ প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে।

নিঃসন্দেহে নতুন সরকারের মূল ফোকাস থাকতে হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। সর্বশেষ নির্বাচনের ফলাফলের মূল বার্তাও কিন্তু এটিই। জনগণ আশা করছে, উন্নয়নের চলমান ধারা যেন চালু থাকে এবং আরও গতি পায়। সেজন্য ইতিমধ্যে নেওয়া প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগী হতে হবে। সেসব প্রকল্প আগে বাস্তবায়ন করতে হবে যেগুলোয় বেশি বেশি কর্মসংস্থান হয়। যেমন আমরা ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার কাজে হাত দিয়েছি। সব তো একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। শুরুতেই মিরসরাইসহ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন করে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করার জন্য এবং তাদের চাহিদামতো সম্পূরক অবকাঠামো নির্মাণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সহজীকরণের ‘টাইম-বাউন্ড’ সংস্কার কর্মসূচির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য আমরা দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়ন কৌশলের দিকে মনোযোগ দিতে পারি। এ কৌশলে ‘ফার্মের’ চেয়ে ‘সাবস্ট্যান্স’ বেশি গুরুত্ব পায়। আমরাও ‘ফলাফলধর্মী’ কৌশলের দিকে ঝুঁকতে পারি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এরই মধ্যে যথেষ্ট ক্ষিপ্রতা দেখিয়েছেন এবং কাক্সিক্ষত ফল অর্জন করেছেন। দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু প্রকল্পের অগ্রগতি তিনি নিজে মনিটর করেন। আর সে কারণেই পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প দ্রুত দৃশ্যমান হচ্ছে।

একই সঙ্গে আমরা যে উন্নত দেশে পরিণত হতে চাই সে স্বপ্নও তিনি তার দীর্ঘমেয়াদি ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় এরই মধ্যে জনমনে গেঁথে দিতে পেরেছেন। এ পরিকল্পনার সূত্র ধরেই আমরা আমাদের আগামী দিনের শিল্পায়নের নয়া কৌশল নির্ধারণ করতে পারি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে তরুণদের ডিজিটাল উদ্যোক্তা বানানো এবং এদের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তিনি এরই মধ্যে করে ফেলেছেন। এই ‘ইউনিক’ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা আরও বেশি উদ্যোক্তা সৃষ্টির কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারি। সেজন্য আমাদের আগামী দিনের শিল্পের পথনকশা নির্মাণের সময় প্রযুক্তির ভূমিকা, শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি জ্ঞান বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তাবান্ধব গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা, শিল্পের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বৃদ্ধি করা এবং প্রবাসে অবস্থানরত আমাদের শিক্ষক, বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের এ মানবসম্পদ উন্নয়নের উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করার সাহসী উদ্যোগ আমাদের নেওয়ার সুযোগ এবার এসেছে। আমার বিশ্বাস, নতুন সরকার নিশ্চয় এ সুযোগ হাতছাড়া করবে না।

সময়টা এখন অর্থনৈতিক কূটনীতির। বাংলাদেশ কী করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও কয়েক ধাপ ওপরে উঠতে পারে সেজন্য আমাদের সারা বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে হবে। ভিয়েতনাম যদি ৩৫ বিলিয়ন ডলার ও মিয়ানমার যদি ৫ বিলিয়নের বেশি এফডিআই আকর্ষণ করতে পারে তাহলে আমরা কেন ২-৩ বিলিয়ন ডলারের গন্ডিতে আটকে থাকব? নিশ্চয়ই আমরাও বিদেশ থেকে পুঁজি ও সাপ্লাই চেইন আকর্ষণের এ দৌড়ে সফল হব। সেজন্য সময় বেঁধে দিয়ে আমাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে (যেমন বিডা, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিরিউটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন) প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কারের জন্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী করতে হবে। এজন্য উপযুক্ত তথ্যের আদান-প্রদান ও নাগরিকদের ‘ফিড ব্যাক’ দেওয়ার ডিজিটাল সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে মানুষের মতামত দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। পুলিশ এখন ‘৯৯৯’ হটলাইনে জনগণের অভিযোগ ও পরামর্শ নিচ্ছে। প্রশাসনও ‘৩৩৩’ হটলাইনে অনুরূপ সেবা সহজীকরণে উদ্যোগী হয়েছে। নাগরিকদের জন্য এ ধরনের নাগরিক সুযোগ সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় থাকতে হবে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে গ্রাহকস্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে ‘১৬২৩৬’ হটলাইন চালু করে ব্যাংকিং গ্রাহকদের অভিযোগ ও মতামত সংগ্রহের যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এমন উদ্যোগ সব প্রতিষ্ঠানই নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ‘এ টু আই’ প্রকল্পও অনেক উদ্ভাবনীমূলক ডিজিটাল সেবা প্রদানের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

একেবারে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়ার জন্য সিঙ্গাপুরের মতো ‘ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ধারা পর্যালোচনা কমিটি’, দক্ষিণ কোরিয়ার ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বিষয়ক সংসদীয় কমিটি’ কিংবা জাপানের ‘অ্যাবানিক্স রূপরেখা নির্ধারণ’ কমিটির মতো অথবা জাপানের খাতওয়ারি পরামর্শক কমিটির মতো নীতি-উদ্যোগ আমরাও নিশ্চয়ই নিতে পারি। পাশাপাশি, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে সর্বক্ষণ জনগণের পরামর্শ সংগ্রহ করে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়াকে আরও জনবান্ধব ও প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারি।

আমাদের বড়ই সৌভাগ্য যে, আমাদের রয়েছেন একজন দূরদর্শী ও কর্মতৎপর প্রধানমন্ত্রী। তিনি সারাক্ষণ প্রশাসন ও সমাজে ‘টোন সেট’ করে দিচ্ছেন। তার নয়া মন্ত্রিসভা ও বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। বিশেষ করে বিদেশি উদ্যোক্তা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সময় আমাদের প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের যথেষ্ট সতর্ক ও কৌশলী থাকতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও উপযুক্ত জ্ঞানের সমাবেশ করার লক্ষ্যে তাদের উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো আমরাও পেশাদার প্রবাসীদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও পরামর্শের ওপর নির্ভর করতে পারি। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সর্বদাই তৎপর থাকতে হবে। বিশেষ করে, দ্রুত অগ্রসরমান দেশের অর্থনীতিতে ঋণখেলাপিসহ নানা ধরনের ভারসাম্যহীনতা ও ‘ডিজলোকেশন’ দেখা দিতেই পারে। এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য মুদ্রানীতি, লেনদেনের ভারসাম্য ও আর্থিক স্থিতিশীলতা আমাদের সর্বক্ষণের নজরে রাখতে হবে। নিঃসন্দেহে, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রক্রিয়ায় যে সাফল্য আমরা অর্জন করেছি তার সুফল আমাদের জনগণ এরই মধ্যে পেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া আমাদের ডিজিটাল অর্থনীতিতে চালু হয়েছে তার গতি যাতে আরও বাড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে। একই সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে। সেজন্য তাদের সেবা সরবরাহ আরও গুণমানের করার প্রয়োজন রয়েছে। কতজন মানুষ এ সেবা পাচ্ছে তা-ই বড় বিষয় নয়। কতটা ভালো মানের ডিজিটাল সেবা আমরা দিতে পারছি তা-ই বড় প্রশ্ন। তাই প্রশাসনিক ও আর্থিক ডিজিটাল সার্ভিসের গুণমান নিরন্তর পর্যবেক্ষণ এবং এসব সেবাকে আরও উন্নতমানের করার প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব।

আমরা সর্বদাই চেষ্টা করব যাতে আমাদের শিল্পকে পরিবেশবান্ধব ও নগরায়ণকে সুশৃঙ্খল করার জন্য সুদূরপ্রসারী নীতিমালা করতে পারি। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা সেজন্য ভালো একটি নীতিমঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে। এজন্য আমাদের করকাঠামো পুনর্বিন্যাস ও প্রযুক্তিনির্ভর করে বিপুল অর্থায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে পুঁজিবাজার, বীমা ও প্রবাসীদের কাছ থেকে বন্ডসহ নানাভাবে বাড়তি অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে হবে। একটু নীতি-উদ্যোগ নিলেই ডিজিটাল লেনদেন সক্রিয় করে আমরা এখনই প্রবাসী আয় আরও ১০ বিলিয়ন ডলার বাড়াতে পারি। নারীর ক্ষমতায়ন, প্রশিক্ষণ, অর্থায়নের সুযোগ বাড়িয়ে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়াতে পারি। সেজন্য উপযুক্ত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, সুদ ভর্তুকি, ভেঞ্চার ক্যাপিটালসহ নানা সৃজনশীল উদ্যোগ নিশ্চয়ই আমরা গ্রহণ করতে পারি।

সবশেষে বলব, নতুন বছরে আমরা নতুন সরকার পেয়েছি। অর্থনীতির নতুন সন্দেশ পেয়েছি। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা যে আমাদের আছে পদ্মা সেতু নির্মাণে আমরা তার প্রমাণ করেছি। তাই ভরসার পরিবেশ বজায় রেখে আসুন এগিয়ে যাই জোর কদমে।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ।

ইমেইল : [email protected]

 

সর্বশেষ খবর