সোমবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সামাজিক বন্ধন

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালি

কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সামাজিক বন্ধন

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, হে মানবসমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন আর বিস্তার করেছেন তাদের দুজন থেকে অনেক পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের কাছে চেয়ে থাক এবং আত্মীয়স্বজনদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন। (সূরা নিসা-১)। উল্লিখিত আয়াত থেকে আমরা সংক্ষেপে দুটি বিষয় বুঝতে পারি, তা হলো- এক. আল্লাহতায়ালা সমগ্র মানবজাতিসহ সবার মালিক ও প্রভু। দুই. সব মানুষ হজরত আদম ও হজরত মা হাওয়া (আ.) এর সন্তান। সুতরাং সব মানুষের মাঝে পারস্পরিক সমতার সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা খুবই জরুরি। এখন আমাদের বুঝতে হবে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? দেখুন! মানবভ্রাতৃত্বের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে একটি সমাজ ও একটি সুসংগঠিত জাতি। আলোচ্য আয়াতে মহান রব্বুল আলামিন মানবজাতিকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। সেখানে আহ্বানমূলক শব্দ হলো ‘ইয়া আইয়ুহান নাস’ হে মানব সমাজ। অর্থাৎ, তিনি মানুষ হিসেবে সবাইকে একই ভ্রাতৃত্বের মাঝে আবদ্ধ করে সবাইকে সমমর্যাদায় স্থান দিেেয়ছেন। মৌলিকভাবে ইসলামে জাতিগত, বর্ণ, ধনী-গরিবের কোনো ভেদাভেদ নেই। মানুষ হিসেবে সবার মান আল্লাহর কাছে সমান। তবে যিনি পরহেজগার ও মুত্তাকি তার মর্যাদা আল্লাহতায়ালার দরবারে অনেক বেশি। যেমনটি পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মানব, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান যার তাকওয়া বেশি।’ (সূরা আলহুজরাত : ১৩)। আরও দেখুন! স্বয়ং রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইমান ও মানবভ্রাতৃত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখেই। যেমন এক. বড় বড় সাহাবায়ে কেরাম থাকতে রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সর্ব প্রথম মসজিদে নববীর মুয়াজ্জিন ঠিক করেছিলেন হজরত বেলাল (রা.)-কে। দুই. পারস্য দেশে ইসপাহান শহরের নাগরিক ছিলেন হজরত সালমান ফার্সি (রা.) রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তাঁর বদলে কিতাবাত তথা গোলামি থেকে মুক্তির জন্য ৩০০ খেজুর গাছের চারা তালাশ করার জন্য সাহাবায়ে কেরামদের বললেন এবং গর্ত খনন করার জন্য আদেশ করলেন। যখন চারা জমা হয়ে গেল এবং গর্ত খোদাই হলো তখন তিনি নিজে বাগানে তাসরিফ নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে সব চারা লাগালেন। ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম হজরত সালমান ফার্সি (রা.) এর মতকে প্রাধান্য দিতেন। তিন. মহান রব্বুল আলামিনের নির্দেশে রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজির এই দুই মকবুল জামাতদ্বয়কে এমনভাবে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিলেন যার ফলে তারা একে অপরের উত্তরাধিকার সাব্যস্ত হলেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে ইসলাম কোনো জাতিগত বিভক্তিতে বিশ্বাসী নয়। বরং ইসলাম সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার শিক্ষা দেয়। মূলত সব মানুষের পারস্পরিক একসঙ্গে চলাফেরা থেকেই সমাজের গোড়াপত্তন। যদি সংসারবিমুখতা মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাসে পরিণত হতো তখন কিন্তু কোনো সমাজ কখনো গড়ে উঠত না। বৈরাগ্যবাদ, সন্ন্যাসবাদ কিংবা একাকী চলাকে ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। বরং রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন ‘লা-রুহ্বানিয়্যাতা ফিল ইসলাম’, ইসলামে কোনো বৈরাগ্যবাদিতা নেই। সব মানুষ সংঘবদ্ধভাবে চলবে। তাদের দিন দিন কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সামাজিক উন্নতি-অগ্রগতিই ইসলামের মূল লক্ষ্য। তবে ইসলামে বন্ধু নির্বাচনে সীমারেখা বলে দেওয়া হয়েছে। রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মানুষ তার বন্ধুবর্গের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়, সুতরাং, তোমরা বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হও।’ মানুষ হিসেবে মানুষের কিছু সামাজিক কর্তব্য ও দায়িত্ব রয়েছে। যেমন, মানুষ হিসেবে একে অপরের খোঁজখবর নেবে। মুসলমান হিসেবে অপর মুসলমানের সুখ-দুঃখের সাথী হবে।

অপরের ইমান-আমানের ব্যাপারে যত্নবান হবে। কারণ ইসলাম পুরো সামাজিক পদ্ধতিকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে উন্নতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিতে চায় যাতে ইসলামের সুমহান বাণী সবার কাছে সমভাবে পৌঁছানো যায়। প্রিয় পাঠক! ইসলাম একজন মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবনবিধান সাব্যস্ত করে। ইসলামে যেমনিভাবে ইবাদতের অধ্যায় রয়েছে। অনুরূপ পরস্পর লেনদেন আচার-বিচারেরও অনেক বড় অধ্যায় রয়েছে। এই অধ্যায়সমূহের মাঝে অসংখ্য-অগণিত বিধানাবলি বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে মানুষের সামাজিক অধিকারের কথা সবিস্তারে বর্ণিত হেেয়ছে। এসব বিধান ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই একটি উন্নত, সুন্দর ও সমৃদ্ধশীল সমাজ গড়ে তোলা খুবই সহজ ব্যাপার। চলুন! মহান রব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদের সবাইকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে এমন একটি সমাজ গঠন করার তৌফিক দান করেন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির, খতিব ও টিভি উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর