শনিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

অনিশ্চয়তার দোলাচলে রাজনীতি

নূরে আলম সিদ্দিকী

অনিশ্চয়তার দোলাচলে রাজনীতি

বিপর্যস্ত বাংলাদেশের রাজনীতি। ৩০ ডিসেম্বর এ দেশের রাজনীতিতে যে অভূতপূর্ব আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর ঝড় বয়ে গেল, তার আকস্মিকতায় মানুষ হতবিহ্বল আশ্চর্যান্বিত না বিস্ময়াভিভূত- এটি সঠিকভাবে নিরূপণ করা আমার তো দূরে থাক, যে কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের পক্ষেও দুরূহ ও দুঃসাধ্য তো বটেই, এটি তাদের কল্পনার আবর্তে আনাও অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। দুটি আসন বাদে আওয়ামী লীগের সব প্রার্থীর বিজয় দেশের মানুষকে যতখানি না অবাক করেছে, ভোটের ব্যবধান তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্মিত করেছে। শুধু রাজনৈতিক মহলকেই নয়, প্রান্তিক জনতাকেও। আওয়ামী লীগের নিজস্ব কর্মীবাহিনী দুর্গম পথযাত্রায় স্বাধীনতা-উত্তর ৪৭ বছরে তো বটেই, পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনৈতিক পথ পরিক্রমণে শত নির্যাতন নিগ্রহ নিপীড়ন অম্লান বদনে সহ্য করে অকুতোভয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে দুর্গম অভিযাত্রায় অজেয় মশাল হাতে শরিক ছিলেন, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব শঙ্কা-সংশয় ভয়-ভীতি প্রাপ্তি-প্রত্যাশা যাদের নির্ভীক যাত্রাপথে কোনো দিনই বাদ সাধতে পারেনি, তারাও যেন এবারের নির্বাচনের ফলাফলে বিস্ময়াভিভূত আশ্চর্যান্বিত ও হতবিহ্বল। অনেক আসনে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোট ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোট ১০ হাজারের নিচে। এই অলৌকিক কারবারে সংগ্রামী বাংলার জাগ্রত জনতা শুধু বিস্মিতই নয়, হতচকিতও। এটা লৌকিক না অলৌকিক, তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। দুটি আসন বাদে সবকটি আসনে বিজয় লাভ কল্পনাতীত, সেটি আমি বলছি না। আমার প্রশ্ন হলো, ভোটের এই বিশাল ব্যবধানটি তৈরি হলো কীভাবে? নির্বাচনে এ বিস্ময়কর বিজয় আওয়ামী লীগের বিজয়, এটি সাংগঠনিকভাবে তারা দাবি করতে পারে না। যদ্দুর মনে পড়ে, এ দাবি তারা করেও নি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের যে প্রেক্ষাপট, জনগণের ঐক্যের যে উদ্বেলিত সত্তা, তা এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে তো ছিলই না, বরং মৌলিক অধিকারবিবর্জিত প্রবহমান রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ম্লান মূক মুখে অভিযুক্তের কাঠগড়ায় অনেকটাই স্বৈরাচারের ভূমিকায় দন্ডায়মান ছিল। মনোনয়নের ক্ষেত্রেও তেমন একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়নি। সেখানেও ব্যবসায়ী ও বিত্তশালীদের আধিক্য এতটাই বেশি ছিল যে, দলের ত্যাগী ও দুর্দিনে লেগে থাকা কর্মীরা মনঃক্ষুণ্ন ও হতাশই হয়েছিলেন। তাই নির্বাচনী মাঠে প্রচন্ড উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়নি কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে। তবু তারা একটা ভয়ভীতির পরিবেশ তো তৈরি করেছিলেনই, উপরন্তু বিএনপির এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্ব করলে হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। বলতে গেলে বিরোধী পক্ষের কর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান নিতে দেওয়াই হয়নি। ধানের শীষের পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাওয়া তো দূরে থাক, ভোট কেন্দ্রে বিএনপির উপস্থিতি দৃশ্যমান তো হয়ইনি, বরং বিএনপির এজেন্টবিহীন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের জন্য ভোট কেন্দ্রগুলো যা ইচ্ছা তাই করার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। তান্ডবলীলা না চালিয়েও তারা অবলীলাক্রমে তাদের অভিলাষ চরিতার্থ করতে নির্বিঘ্নে সক্ষম হয়েছে।

বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের অভিযোগ, আগের দিন রাতে প্রশাসনের বদান্যতায় ৪০ ভাগের মতো ভোট ব্যালটবাক্সে নৌকায় সিল মেরে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ভোটে এই বিশাল ও অভূতপূর্ব ব্যবধানের মূল কারণ এটি বলে তারা মনে করে। এ অভিযোগ কতটা সত্যি জানার উপায় নেই। তবে যে ভোটবাক্সগুলো ভোট কেন্দ্রে প্রতিস্থাপিত ছিল সেগুলো সিল মারা ব্যালট পেপারে ভর্তি ছিল কিনা, এটি নিরীক্ষা বা যাচাই করে দেখার মতো কোনো প্রতিনিধিত্ব ভোট কেন্দ্রে বিএনপির ছিল না। এটা শতভাগ নিশ্চিত, সেই পাকিস্তান আমল থেকে আজ পর্যন্ত এটি একটি অভূতপূর্ব অকল্পনীয় বেহাল অবস্থা। ’৫৪ সালে নির্বাচনে মুসলিম লীগের যে ভরাডুবি হয়েছিল, তার পেছনে যে গণজাগরণ বা জাগ্রত জনতার উদ্বেলিত হৃদয়ের যে বিস্ফোরণ, তা কোনোভাবেই কি এবারের নির্বাচনে সরকারের সপক্ষে পরিলক্ষিত হয়েছে? আওয়ামী লীগের একজন অন্ধভক্ত এমনকি প্রার্থীরাও প্রশাসনের গৃহীত এ ব্যবস্থার পক্ষে স্বস্তির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তারা নিজেদের বলির পাঁঠা মনে করছেন। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নিজেদের মধ্যে অনেকের কথোপকথনে শোনা যায়, ভোটবাক্স নিয়ে ‘উপরের নির্দেশে’ স্থানীয় প্রশাসন যদি ৪০ ভাগ ভোট আগে থেকে ভোটবাক্সে ভরেই রাখবে, তাহলে প্রার্থীরা দুয়ারে দুয়ারে ভোটভিক্ষা করতে গেলেন কেন? এত পোস্টারই বা ছাপলেন কেন? সভা-মিছিল প্রচার-প্রচারণা মিলিয়ে এভাবে অর্থ ব্যয় করার কোনো যৌক্তিকতা ছিল কি? এক হিসাবে নির্বাচিত প্রার্থীরাও ভোটারদের কাছে লজ্জিত হয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গৃহীত এই নব্যকৌশল ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করায় এটা উদ্বেগের বিষয়।

এবারের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফরমটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। এ জোট গঠনের পেছনে ড. কামাল হোসেনের অন্তর্নিহিত মতলব কী ছিল জানি না, তবে শেষ বয়সে এসে তিনি একটি জুতসই খেলাই খেলেছেন। তার নেতৃত্বে জোটটি গঠিত না হলে এ রকম নির্ঝঞ্ঝাট নির্বাচন হতো কিনা, তা হলফ করে বলা যায় না। বিএনপি-জামায়াত হঠাৎ করেই যে কোনো অজুহাতে বেঁকে বসতে পারত। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবল আশঙ্কা ছিলও। সে ক্ষেত্রে বিশ্বজনগণ এবং বাংলাদেশের মানুষের কাছে যে অনিশ্চয়তার দোলাচল তৈরি হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে ধূমকেতুর মতো ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে দৃশ্যপটে আগমন অবশ্যই একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে ড. কামাল হোসেন কৌশল ও বিচক্ষণতার সঙ্গে শেখ হাসিনাকে হ্যান্ডেল করতে পারলে নির্বাচনের ফলাফলটি এমন নিদারুণ না-ও হতে পারত। কোনোরকম আলোচনায় না থেকেও যেখানে অতিকথনের জাতীয় পার্টি ফাঁকতালে বিস্ময়করভাবে ২০টি আসন পেয়ে যায়, সেখানে ঐক্যফ্রন্টের ৮টি আসন নিতান্তই হাস্যকর। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ড. কামাল হোসেনের ব্যর্থতারই উদাহরণ এটি।

নির্বাচনের ফলাফল পরিদৃষ্টে সারা বিশ্বের চোখ যখন কপালে উঠেছে, তখন শেখ হাসিনা হঠাৎ করেই একটা প্রচ- বিস্ময়কর রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তার দলের এবং জোটের বড়, মাঝারি, এমনকি উদীয়মান নতুন নেতৃত্বকেও তিনি সমূলে বধ করলেন। আমু, তোফায়েল, মতিয়া, নাহিদ, এমনকি দৃশ্যত তার সবচেয়ে আস্থাভাজন নাসিমসহ আওয়ামী লীগের পরিচিত সব নেতৃত্বকে মন্ত্রিপরিষদের বাইরে রেখে যে নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলেন তা অভাবনীয়। শুধু নবীনই নয়, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও প্রায় অচেনা মুখগুলো মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সুযোগ পেলেন। কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই এ দুস্তর দুর্বার কাণ্ডটি শেখ হাসিনা ঘটিয়েছেন, এটি ভাবা আহাম্মকি হবে। বরং তিনি স্থির প্রত্যয়ে এ কর্মটি করে জানান দিয়েছেন, এ অভূতপূর্ব বিজয়ে তিনি ছাড়া আর কেউই কোনো ফ্যাক্টর নয়। তিনি প্রথম, তিনিই শেষ। বিষয়টি অবলোকন করে দেশের জনগণ হয়তো বা চমকে উঠেছে। কিন্তু যাদের ওপর খড়্গ চালিয়েছেন, তারা এতটাই অবলীলাক্রমে ম্লান মূক মুখে বিনম্র ও বিনীত চিত্তে সিদ্ধান্তটি মেনে নিয়েছেন যে, তাতে মনে হয়েছে শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তটি নিতান্তই স্বাভাবিক ও সময়োপযোগী হয়েছে। জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বকে মন্ত্রিসভার বাইরে রাখার একটা চিরায়ত স্লোগান শেখ হাসিনাও ব্যবহার করেছেন। দল ও মন্ত্রিসভাকে আলাদা রাখতে হবে এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বে অবস্থান করবেন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরাই।

পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন, ক্ষমতায় আসীন হয়ে তার চেতনাকে অথবা তার এলাকাকে ক্ষমতার সদ্ব্যবহারে উন্নত ও আলোকিত করার জন্য। সে ক্ষেত্রে এই শ্লোকবাক্য বঞ্চিতদের হৃদয়কে দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে তিলে তিলে দগ্ধীভূত করে। এই দগ্ধীভূত হৃদয় নিয়ে তারা কতটুকু পরিতৃপ্তির সঙ্গে দলে অবদান রাখতে পারেন, বিষয়টি সর্বদাই প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু যা করেননি বা করতে পারেননি, শেখ হাসিনা তা প্রতিষ্ঠিত করে শুধু সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরই নয়, দেশবাসীকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি চারবারের প্রধানমন্ত্রী। সব মিলিয়ে হায়াত থাকলে ২০ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তারপর অনন্তকাল তো পড়েই রইল।

বিএনপি আজ এতটাই বিকলাঙ্গ ও ভঙ্গুর যে, শেখ হাসিনার কঠোর মানসিকতার কাছে সোজা হয়ে তারা দাঁড়াতেই পারছে না। তাদের নেতৃত্বের যে গা-ছাড়া ভাব, জনগণের কাছে এটা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, রাজনীতিতে তারা আর আদৌ সিরিয়াস নন। বিগত নির্বাচনে যেসব প্রার্থী সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে তারা পরাজিত হলেও লক্ষাধিক ভোট সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর যেসব আসনে তাদের ঢিলেঢালা প্রার্থী ছিল, তাদের অনেকেই নির্বাচনী পোস্টার ছাপেননি, ব্যানার করেননি, কোনো মিছিল বা সভা করেননি এমনকি কোনো ভোটারের কাছে ভোট চাইতেও যাননি। আর কেন্দ্রের অবস্থা তো তথৈবচ। এ রকম একটা হ-য-ব-র-ল নির্বাচনেও সারা বাংলাদেশে তাদের প্রাপ্ত ভোট ২০%। এ সংখ্যা নিঃসন্দেহে জানান দেয়, সারা বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বিএনপির সমর্থন ৩০% থেকে ৪০%-এর কাছাকাছি রয়েছে। তবে সেই ভোটারদের জাগ্রত করতে হবে, সক্রিয় করতে হবে, যা বিগত নির্বাচনে তারা করতে পারেননি। নেতৃত্বশূন্যতার সন্ধিক্ষণে নেতৃত্ব খুঁজে পেতে তারা হাওলাত করে আনলেন আওয়ামী লীগ নেতা ড. কামাল হোসেনকে। তিনিও সময়মতো তার ক্যারিশমা দেখিয়ে গেলেন। রাজনীতির কোনো ব্যক্তির কাছেই এটি আজ আর বাস্তব নয় যে, বিএনপি কার্যকর বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারবে। দলটি এখন তো মাজাভাঙা। কালের স্রোতধারায় মুসলিম লীগের মতো ক্রমান্বয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলেই মনে হয়। এখন জাতির সামনে একটি প্রশ্ন মারাত্মকভাবে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটুকু? জাতীয় পার্টিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের ভূমিকা সুস্থির নয়। বরং প্রায় সর্বক্ষেত্রেই স্ববিরোধী এবং ক্ষণস্থায়ী। তার সকালের কথা দুপুরে, দুপুরের কথা বিকালে এবং বিকালের কথা সন্ধ্যায় পাল্টে যায়। এ যেন রাজনৈতিক আকাশে রংধনুর বিচিত্র রঙের খেলা। মেঘমুক্ত আকাশে রংধনু অনেকটাই দৃষ্টিনন্দন কিন্তু রাজনীতিতে এ রঙের খেলা ভয়াবহ ও মারাত্মক। বেগম রওশন এরশাদ সচেতনভাবেই শেখ হাসিনার আঁচলতলে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। জাতীয় পার্টির প্রায় সব নেতাই শেখ হাসিনার অনুগ্রহ ও অনুকম্পার প্রত্যাশী। জাতীয় পার্টির কাছ থেকে স্বাভাবিকভাবেই সরকারবিরোধী কোনো বলিষ্ঠ আন্দোলন প্রত্যাশা করা যায় না।

দেশে জনবিচ্ছিন্ন ভোটবিহীন কিছু বাম সংগঠন আছে। কথাবার্তায় তারা চৌকস। দ্বিধাবিভক্তিতেও তারা বহু রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, আদর্শ ও কর্মসূচির বিশ্লেষণ নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি তো রয়েছেই। আমার এক রাজনৈতিক বন্ধু কৌতুক করে বলেন, কোনো রাজনৈতিক বিষয়ের বানান ভুল নিয়েও তাদের সংগঠন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেতে পারে। এরা সারা জীবন ঘরে বসে বিপ্লবের নীলনকশা আঁকেন। সমাজবিবর্তনের স্বপ্নিল মাদকতায় বুঁদ হয়ে থাকেন। এক কমরেড আরেক কমরেডকে জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড আবেগ-আহ্লাদে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, চল না কমরেড, সর্বহারার রাজ কায়েমের লক্ষ্যে একটা শ্রেণিবিপ্লব ঘটিয়ে ফেলি! অবশ্যই এখানে কারোর দ্বিমত নেই, কিন্তু যত বিরোধ বিপ্লবের সময় ও ধরন নিয়ে। সুতরাং বামধারার রাজনীতির কাছ থেকেও আওয়ামী লীগের রাজনীতির মোকাবিলায় একটি সফল বিরোধী দলের ভূমিকা প্রত্যাশা করার কোনো সুযোগ নেই। এ যেন কল্পনার ফানুসে চড়ে মহাকাশ পরিভ্রমণের অভিলাষ।

বঙ্গবন্ধু ৩৫ বছর রাজনীতি করে সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি শাসনতন্ত্র সংশোধন করে সব দলকে বিশেষ করে বাম জোটকে একত্রিত করে বাকশাল নামে যে সংগঠনটি গঠন করেছিলেন, সেটিরও আয়ুষ্কাল ছয় মাসের বেশি ছিল না। শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিতে হয়নি, দেশের শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করারও প্রয়োজন পড়েনি। অথচ বাস্তবিক অর্থে একদলীয় শাসনই প্রচলিত হয়েছে এবং অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আমলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান- এই পাঁচ নেতার একটি কমান্ড কাউন্সিল ছিল। যদিও বঙ্গবন্ধুর কথাটি দেশ শাসনের প্রশ্নে শেষ কথা ছিল, তবু নীতিনির্ধারণে এ কমান্ড কাউন্সিলের প্রভাব ছিল অসাধারণ। সর্বজনবিদিত আরেকটি সারকথা হলো, তদানীন্তন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত বা চার খলিফার অভিমত ও অভিব্যক্তিকে অগ্রাহ্য করে দেশ শাসন বা প্রশাসন পরিচালনা অসম্ভবই ছিল। তখনকার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বা চার খলিফা দেশ শাসনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রচন্ড ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতিতেও ছাত্রনেতৃত্বের প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হতো। শেখ হাসিনার শাসনামলে এসবের কোনোই বালাই নেই। এবারের অলৌকিক বিজয়ের পর শেখ হাসিনা দলের প্রবীণ নেতাদের একযোগে যেভাবে বিদায় করেছেন, চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমেও মাও সে তুংয়ের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের পর লেনিন, স্ট্যালিন, ট্রটস্কির মতো শক্তিমান কমিউনিস্ট নেতারাও এমন নিরঙ্কুশ ও একচ্ছত্র আধিপত্য কখনো ভোগ করেননি। কঠোর হস্তে তারা শাসন করেছেন বটে, কিন্তু একটা ক্ষোভ বা যে কোনো সময় একটা বিস্ফোরণের আশঙ্কা থেকেই গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জীবিতাবস্থায় এ আশঙ্কা নেই। এখন তার উত্তরাধিকার নির্ধারণে কোনো আইন করার দরকার নেই। রাজনৈতিক অঙ্গন, সামাজিক সুশীলসমাজ, সংবাদমাধ্যম চিত্তের আকুল ব্যাকুলতায় তার উত্তরসূরি খুঁজতে ব্যস্ত। হাওয়া কেবল তার অনুকূলেই বইছে না, হাওয়া যেন তার জন্যই বইছে। সবকিছুর নিমিত্ত তিনি এবং তিনিই একমাত্র নিমিত্ত। আমার স্পষ্ট মনে আছে, বঙ্গবন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরীকে তথ্যমন্ত্রী থেকে যখন সরিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থ করেন, তখন মাখন, শহীদ, রশীদ, আমি রাশিয়ায় সাংগঠনিক সফরে ছিলাম। যেহেতু মিজান ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের সখ্য খুব গভীর ছিল, তাই রাশিয়া থেকে জরুরি ভিত্তিতে তলব করে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্তটি তিনি জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। রাশিয়ায় থাকতেই সেখানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান জনসন ভাই আমাকে একান্তে বিষয়টি অবহিত করায় ঢাকায় অবতরণ করেই এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি মাখন আর আমি সিদ্ধেশ্বরীর একটা বাড়িতে মিজান ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। বিষয়টি তাকে অবহিত করলে তিনি এতটাই অবলীলাক্রমে ঘটনাটিকে গ্রহণ করেন যে, আমরা দুজনই বিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম। তবু তার একটা প্রতিক্রিয়া আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব থেকে কর্মী পর্যন্ত অনুভূত হয়েছিল।

নির্বাচনে অলৌকিক বিজয়ের পর ভারত মহাসাগর থেকে উত্থিত সুনামির মতো দল থেকে পরিচিত সব নেতৃত্বকে বিদায় করার পরও কি মন্ত্রিপরিষদে, কি সংসদে, কি সাংবাদিকতার অঙ্গনে, কি রাজনৈতিক পরিম-লে কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া তো দূরে থাক, এতটুকু গুঞ্জনও শোনা গেল না। জোটের ভিতর ও বাইরে থেকে একটা বিবৃতি পর্যন্ত এলো না। এ সুনামি কেন হলো, এর উৎপত্তি কোথায়- কেউ কিছু অবহিত না হয়েও গোটা জাতি বিনম্রচিত্তে হজম করে গেল। এটি বিদায় করা নেতৃত্বের দুর্ভাগ্য না শেখ হাসিনার অভূতপূর্ব সৌভাগ্য তা এখনো সঠিকভাবে নিরূপণ করা না গেলেও শেখ হাসিনা এ সিদ্ধান্তটির মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন, দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনিই সব, এখানে আর কারও এবং অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। মজার কথা হলো, নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা তার ক্ষমতার এতটাই দাপট দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যে, নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠনে কারও মতামত ও পরামর্শ নেওয়ার তিনি কোনো প্রয়োজনবোধ করেননি। রাজনৈতিক ইতিহাসের পর্যালোচনায় এতখানি ক্ষমতা প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত আর কেউ কখনো রাখতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর