শনিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

কৃষিতে পর্তুগালের হুবেল কোম্পানির ১০০ কোটি টাকার বাণিজ্য

শাইখ সিরাজ

কৃষিতে পর্তুগালের হুবেল কোম্পানির ১০০ কোটি টাকার বাণিজ্য

আগস্টের মাঝামাঝি। সকালে লিসবন থেকে যাত্রার সময় মিষ্টি রোদ দুপুরে এসে তেতে উঠেছে। কাঠফাটা রোদ যাকে বলে, সে রকম রোদ উঠেছে পর্তুগালে। তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাস্তার পিচ গলতে শুরু করেছে। প্রায় ৩০০ মাইল অতিক্রম করে আলগার্ভের ওলহা শহরের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি তখন সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। পর্তুগালের রপ্তানিমুখী বাণিজ্যিক কৃষির একটি প্রতিষ্ঠান হুবেল। তাদের কাজকর্ম দেখতেই এতটা পথ ছুটে আসা। হুবেল গ্রুপের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও গবেষক তিয়াগো আন্দ্রাদের সঙ্গে পরিচয় হলো। কথা হলো তার সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি তাদের কৃষি খামার দেখতে। কীভাবে কৃষিটাকে তারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তা নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করাই আমার উদ্দেশ্য। ‘বাংলাদেশ’ নামটা তিয়াগোর কাছে পরিচিত। আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। প্রশাসনিক ভবন থেকে গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন গ্রিন হাউসে, যেখানে তাদের মাঠ পর্যায়ের কৃষি কারবার। যেতে যেতে অনেক কিছুই জেনে গেলাম তিয়াগোর কাছ থেকে। হুবেল একটা পারিবারিক কোম্পানি। ১৯৮২ সালে কোম্পানিটি যাত্রা করে পানি ও সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে। তখনই যুক্ত হয় টমেটো ও মেলোয়া চাষের সঙ্গে। ক্রমেই সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। ১৯৯২ সালে কোম্পানিটি পর্তুগালকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় হাইড্রোপনিক চাষবাসের সঙ্গে। মজার ব্যাপার হলো, তারা সাধারণত লালরঙা ফলের চাষ করে। আর তাই রাসবেরি ও স্ট্রবেরি তাদের প্রথম পছন্দের। ৪০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম রাসবেরি ফার্মে। দুপুর শেষে ফার্মে তেমন কর্মব্যস্ততা নেই। এরা সাধারণত ভোরেই কাজ শুরু করে। সকালের সূর্য ওঠার আগেই গাছ থেকে পাকা ফল তুলে বাগানেই বাছাই ও প্যাকেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন করে ফেলে। তখন মধ্যগ্রীষ্ম। বাইরের তাপমাত্রা ৪০-৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রিন হাউসে গরম আরও বেশি। প্রতিটি গ্রিন হাউস ২ একর জমিজুড়ে। মোট ৪৯ একর জমিতে তাদের রাসবেরি চাষ। চারটি ভিন্ন স্থানে তাদের পাঁচটি ফার্মে রাসবেরি আর স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। মাটিতে নয়, কোকোপিটে সারি সারি রাসবেরি গাছের চারা। ভালো চারা সব কৃষিরই মূল চাহিদা। তারা মূলত নার্সারি থেকে ছোট চারা সংগ্রহ করে। ফলে বেশ কিছু নার্সারির বড়োসড়ো ব্যবসার একটা ক্ষেত্র বলা চলে হুবেলকে। সেচই সমুদ্র উপকূলস্থ এই এলাকার প্রধান সমস্যা। আর তা-ও তারা সমাধান করেছেন ড্রিপওয়াটার ইরিগেশন সিস্টেমে। এ ছাড়া তাদের সেচ নিয়ে আছে নানা রকম গবেষণা। সারা বিশ্বই গ্রিন হাউসে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের দিকে ঝুঁকেছে। পাঠক! আপনাদের আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর নানা প্রতিবেদনে দেখিয়েছি বিভিন্ন দেশে গ্রিন হাউসে হাইড্রোপনিক কৃষি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার থেকে শুরু করে নেদারল্যান্ডস,  জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, লন্ডন এমনকি আমাদের দেশেও বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক কৃষি শুরু হয়েছে। ছোট চারার গ্রিন হাউস থেকে বের হয়ে ঢুকলাম অন্য এক গ্রিন হাউস শেডে। সেখানটায় বড় সব গাছের সারি। তিয়াগো জানালেন, সেখান থেকে প্রতিদিনই ফল সংগ্রহ করা হয়। কর্মীরা ফল সংগ্রহের পাশাপাশি প্রাথমিক প্যাকেজিংয়ের কাজটাও বাগানেই করেন। শুধু তাই নয়, করা হয় মান নিয়ন্ত্রণও। তিয়াগো জানালেন, গ্রীষ্মে নয়, শীতেই মূলত বেশি ফলনের প্রধান টার্গেট তাদের। একটা গাছ বছরে দুবার ফলন দেয়। প্রতিটি গাছ থেকে শীতকালে মেলে ২ কেজি ফল আর গ্রীষ্মে পাওয়া যায় ১ কেজি। শীতে শুধু ফলই বেশি পাওয়া যায় না, ফলের পাশাপাশি বাড়তি পাওনা মধু। নিজেরাই গবেষণা করে গ্রিন হাউসে চাষ করা যায় এমন একটি মৌমাছির জাত উন্নত করেছেন তারা। মৌমাছি ফুলের পরাগায়ণেও সহায়তা করে। তিয়াগোর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, শীতে ফল উৎপাদন হুবেল কোম্পানির মূল টার্গেট কেন? তিনি জানালেন, গ্রিন হাউসে শীত বা গ্রীষ্ম যে কোনো সময়ের আলো ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তারা ইচ্ছা করেই শীতে বেশি ফলাতে চান। কারণ তাদের এই উৎপাদন মূলত রপ্তানির জন্য। শতকরা ৯০ ভাগ ফল তারা রপ্তানি করেন। আর শতকরা ৭০ ভাগ ফলই রপ্তানি হয় শীতকালে। ইংল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শীতে যখন স্থানীয় ফল মেলে না, তখনই তাদের রপ্তানির মৌসুম। রপ্তানিনির্ভর বলেই কমপ্লায়েন্সের নিয়ম তাদের মেনে চলতে হয় শতভাগ। তাই জৈব বালাইনাশকের নানা পদ্ধতি চোখে পড়ল গ্রিন হাউসে। হলুদ আর নীল রঙের আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করছেন তারা। এ ছাড়া এক প্রকার বিশেষ রকমের ফাঁদ দেখলাম। সেখানেও নানা রকম থ্রিপস ও মাইটস আকৃষ্ট হয়ে ফাঁদে আটকে আছে। জানতে চাইলাম, আপনারা কি প্যাটার্ন ব্যবহার করেন না? তিয়াগো জানালেন, তারা প্যাটার্ন সম্পর্কে খুব একটা জানেন না। আমি তাকে গেল্ট ইউনিভার্সিটির গবেষণার কথা জানালাম। শুধু জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাণ্ ুশতভাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে তারাও কিছু রাসায়নিক প্রয়োগ করেন। তবে তা নিয়ম মেনে। ফুল আসার ছয় সপ্তাহ আগে থেকেই কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করে দেন। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে কৃষির জন্য এটা আরও বেশি। আর তাই তারা এখনই ভাবছেন ২০ বছর পরের কৃষি নিয়ে। এ নিয়ে চলছে তাদের নানামুখী গবেষণাও। তিয়াগোর মতে, পর্তুগালের আগামীর কৃষির মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে সেচব্যবস্থা। সেচের পানি ভয়াবহরকম কমে আসছে। তাই তারা লবণাক্ত পানিসহিষ্ণু জাত তৈরির বিষয়ে গবেষণা করছেন। বেশ সাফল্যও পেয়েছেন। কিছু জাত তারা উন্নত করেছেন, যেগুলোয় সেচ হিসেবে সমুদ্রের পানি দেওয়া যায়। তিয়াগো জানাচ্ছিলেন, রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য তাদের নিয়মগুলো মেনে চলতে হয় কঠিনভাবেই। সেখানে আর সব নিয়মের সঙ্গে কর্মীদের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির বিষয়টিও রয়েছে। জানতে চাইলাম, কোন কোন দেশের কর্মী আছে আপনাদের কোম্পানিতে? তিয়াগো জানালেন, নেপাল, ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, স্পেন, আর্জেন্টিনা থেকে শুরু করে বিশ্বের নানান দেশের ৯০০ কর্মী তাদের রয়েছে। এর মাঝে ৬০ জনের মতো বাংলাদেশের কর্মী রয়েছে। আমাদের দেশের কর্মীদের পারফরম্যান্স সম্পর্কে জানতে চাইলে তিয়াগো বাংলাদেশি কর্মীদের প্রশংসা করেন। শুধু রাসবেরি নিয়ে হুবেলের ১১ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার রাসবেরিই উৎপাদন করছেন তারা। তাদের লক্ষ্য আরও বড় বাণিজ্যের। ভবিষ্যতে নিজস্ব ব্র্যান্ড করার পরিকল্পনার কথাও বলছিলেন তিয়াগো। শুধু পর্তুগালে নয়, সারা বিশ্বে এক নম্বর ফল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হওয়ার স্বপ্নের কথা জানালেন তিয়াগো। ঘুরে দেখলাম সেখানকার ১০ একর জমিতে গ্রিন হাউসগুলোর সেচ পদ্ধতি। ছয়টি বড় ট্যাঙ্কে থাকা পুষ্টি উপাদানের সঙ্গে পানি মিশিয়ে সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড উপায়ে চলে রাসবেরি গাছে পুষ্টি ও সেচ দান। তাদের মূল প্যাকেজিং কেন্দ্র মাদ্রে ফুতায়। সেখানেই কমপ্লায়েন্সের নিয়ম মেনে রাসবেরি প্যাকেটজাত করা হয় রপ্তানির জন্য। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি সারা পৃথিবীই এখন নিরাপদ খাদ্য নিয়ে চিন্তিত। সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকেও নিচ্ছে গুরুত্বের সঙ্গে। টেকসই উন্নয়নের জন্য এ দুই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে আমাদেরও। সেই সঙ্গে কৃষি ফসলের মূল্য সংযোজনও আমাদের দেশের জন্য খুবই প্রয়োজন। আগামীর কৃষি নিয়ে ভাবতে হবে এখন থেকেই। উন্নত প্রযুক্তি ও পদ্ধতির আওতায় কৃষিকে নিয়ে এলে একই সঙ্গে আসবে সাফল্য ও আগামীর নিরাপত্তা। আশা করি, নতুন সরকার আমাদের কৃষিকে নতুন বছরে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারবদ্ধ হবে।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর