শনিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

সৃষ্টির সেবা ও সুন্দর আচরণ

মুফতি এহসানুল হক জিলানী : পেশ ইমাম

একজন মুসলমান তার পার্থিব জীবনে যে মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে খুব দ্রুত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ করতে পারে, সৃষ্টির সেবা ও সুন্দর আচরণ তার মধ্যে অন্যতম। সৃষ্টির সেবা ও সুন্দর আচরণ একজন ইমানদারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এ ইবাদত তাকে কেবল আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্তই করে না, বরং তাকে জগদ্বাসীর কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান ও অপরিহার্য করে তোলে।

বিপদে-আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অভাবীর অভাব মোচন করা, সমাজের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের প্রতি দানের হাত প্রসারিত করা, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা, কারও ঋণের প্রয়োজন হলে তাকে করজে হাসানা তথা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া ইত্যাদিই হচ্ছে সৃষ্টির সেবা।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন কোরআনে কারিমের অসংখ্য জায়গায় তাঁর বান্দাদের সৃষ্টির সেবার প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং এ মহৎ কাজে নিবেদিতদের জন্য মহান সব পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। এক আয়াতে তিনি করজে হাসানা বা বিনা সুদে ঋণ দেওয়াকে উৎসাহিত করে ইরশাদ করেন, ‘এমন কে আছে যে আল্লাহকে করজে হাসানা দেবে, ফলে তিনি তার জন্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন। এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান।’ সূরা হাদিদ, আয়াত ১১। উল্লেখ্য, কোনো বান্দাকে তার প্রয়োজনে ঋণ দেওয়া মানেই আল্লাহকে ঋণ দেওয়া।

এমনিভাবে আল্লাহ রব্বুল আলামিন অনেক আয়াতে বান্দাদের দানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং দাতা ব্যক্তিকে তার দান কয়েক গুণ বৃদ্ধি করার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর পথে তাদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উপমা একটি বীজের মতো, যা উৎপন্ন করল সাতটি শীষ, প্রতিটি শীষে রয়েছে এক শ দানা। আর আল্লাহ যাকে চান তার জন্য বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ সূরা বাকারা, আয়াত ২৬১।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জিন্দেগির পুরোটা জুড়েই সৃষ্টির সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। নবুয়ত লাভের প্রাক্কালে তিনি যুবকদের নিয়ে এ উদ্দেশ্যে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে সংগঠনের কর্মসূচি ছিল অসহায় ও অভাবীদের পাশে দাঁড়ানো, জালিমের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা এবং গোত্রে গোত্রে সম্প্রীতি ও বন্ধন সৃষ্টি করা। বলা বাহুল্য, এসব কর্মসূচিই সৃষ্টিসেবার অন্তর্ভুক্ত। নবুয়ত-পরবর্তী জীবনেও রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন মহৎ কাজের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন। বরং নবুয়তের পর তাঁর এসব কাজ আরও বেগবান হয়ে ওঠে। নবম হিজরিতে যখন গোটা আরব উপদ্বীপ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুগত হয়, তখন মদিনায় চারদিক থেকে বানের মতো ধনদৌলত আসতে থাকে। কিন্তু রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবই অকাতরে বিলিয়ে দেন। হজরত আয়েশা (রা.)-এর ভাষ্য হচ্ছে, ‘রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন যে, তাঁর পরিবার দুই দিনও তৃপ্তি মিটিয়ে যবের রুটি খেতে পারেনি।’

প্রখ্যাত সাহাবি হজরত জাবের (রা.)-এর ভাষ্যমতে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে কখনো কোনো সাহায্য প্রার্থীকে ‘না’ বলেননি। যেভাবেই সম্ভব হয়েছে, যতটুকুই সম্ভব হয়েছে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সৃষ্টিসেবার এ মহৎ কাজগুলো রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কর্মের মাধ্যমে কেবল উম্মতকে শিক্ষাই দেননি, বরং তাঁর হাদিসের মাধ্যমে তিনি উম্মতকে এসব কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহিতও করেছেন, এর জন্য তিনি উম্মতের সামনে আল্লাহর পক্ষ থেকে নানাবিধ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি কেউ সৃষ্টিসেবার কাজে অবহেলা করলে তার প্রতি হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। এক হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব কষ্ট থেকে কোনো কষ্ট দূর করবে, কেয়ামতের কষ্ট থেকে আল্লাহ তার একটি কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো অভাবীকে দুনিয়ায় ছাড় দেবে আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে ছাড় দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্য করে যায়।’ মুসলিম।

এক হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কসম! সে ইমান আনেনি, আল্লাহর কসম! সে ইমান আনেনি, আল্লাহর কসম! সে ইমান আনেনি।’ সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কারা হে আল্লাহর রসুল? তিনি বললেন, ‘সেই ব্যক্তিরা যাদের হঠকারিতা থেকে প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ মুসনাদে আহমদ।

অন্য এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।’ (বর্ণনাকারী বলেন) আমার ধারণা তিনি আরও বলেন, ‘সে ওই সালাত আদায়কারীর মতো, যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর মতো, যার সিয়ামে বিরাম নেই।’ বুখারি।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, একজন মুসলমানের জীবনে সৃষ্টিসেবা ও উত্তম আচরণের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহর নৈকট্য লাভ, ইহকালীন সফলতা ও পরকালীন মুক্তির জন্য সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ ও মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণের বিকল্প নেই। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ ও মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফিক দান করুন।

সর্বশেষ খবর