রবিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
স্মরণ

ইতিহাসের নায়ক শহীদ আসাদ

ডা. এ এম নূরুজ্জামান নূর

ইতিহাসের নায়ক শহীদ আসাদ

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা পৃথিবীতে ক্ষণকালের জন্য আসেন আবার তারা ইতিহাস সৃষ্টি করে চলে যান। ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে। শহীদ আসাদ এমনই একজন যিনি আজ ইতিহাসের নায়ক হিসেবে অমর হয়ে আছেন। শহীদ আসাদ ছিলেন এক অনন্য সংগ্রামী; যার মৃত্যুতে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। লৌহমানব হিসেবে পরিচিত আইয়ুব শাহির নির্মম পতন হয়েছিল। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-অনাচার, জেল-জুলুম, গুলি, হত্যা পূর্ব বাংলার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ১৯৪৭-এ দেশ ব্রিটিশের অত্যাচার থেকে মুক্ত হলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-অবিচার থেকে মুক্ত হতে পারল না। কত আশা-ভরসা ছিল মুক্ত স্বাধীন দেশে মানুষ এবার অন্তত শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু না! স্বৈরাচারী আইয়ুব শাহির দুঃশাসন দিনের পর দিন বাড়তেই থাকল। মানুষের মনের স্বাধীনতার স্বাদ ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় বাংলার ছাত্রসমাজ। ছাত্রনেতা আসাদ ছিলেন তাদেরই অগ্রভাগে। আসাদের জন্ম এক শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত পরিবারে, বাবা সুশিক্ষিত মানুষ গড়ার কারিগর, যুক্তফ্রন্টের নেতা, ঋণসালিশি বোর্ডের চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট সমাজসেবক, লেখক, রাজনীতিবিদ। মা নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণ আন্দোলনের অনুসারী। বাবা-মার সেই দামাল ছেলে আসাদ একদিন দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে ইতিহাস রচনা করবেন সেটাই স্বাভাবিক। ১৯৬০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাস করেন, ’৬২ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্সে ভর্তি হন। তরুণ আসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। দেশপ্রেমিক বাবা-মার সচেতন সন্তান ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন কলেজে পড়ার সময়ই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অত্যাচার-অবিচার দেখে ব্যাপকভাবে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় তিনি ঢাকা হলের নির্বাচিত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। শহীদ আসাদ প্রগতিশীল রাজনীতি করতেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন তার আদর্শ। তাঁরই নির্দেশে ১৯৬৬ সালে অনার্স পরীক্ষা দিয়ে গ্রামে চলে যান কৃষক সমিতি সংগঠন করার জন্য। মওলানা ভাসানী জানতেন তার যোগ্য অনুসারী আসাদ কৃষকদের সংগঠিত করতে পারবেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে শিবপুর মনোহরদীর হাতিরদিয়া বেলাব রায়পুরা চরসিন্দুর নরসিংদী এলাকায় ব্যাপক কৃষক জাগরণ সৃষ্টি করেন। ’৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী আহূত হাট হরতাল করতে গিয়ে হাতিরদা হাটে পুলিশ ও জনতার সংঘর্ষ বাধে, একপর্যায়ে পুলিশ আসাদকে গুলি করতে উদ্যত হয়। অন্য একজন পুলিশ কনস্টেবল আসাদের মাথায় বন্দুক দিয়ে আঘাত করে, তাতে আসাদ আহত হন। ঘটনাস্থলে পুলিশের গুলিতে এক কৃষকনেতা নিহত হন। এ ঘটনা সমগ্র পূর্ব বাংলায় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এরপর ’৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা আন্দোলনের সূচনা করে। ২০ জানুয়ারি ঐতিহাসিক বটতলা থেকে ছাত্রছাত্রীদের একটি মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শহীদ মিনার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে পৌঁছালে জনৈক পুলিশ অফিসার ডিএসপি বাহাউদ্দিন জিপ থেকে নেমে আসাদের বুক লক্ষ্য করে পিস্তল দিয়ে গুলি ছোড়েন। আসাদকে ধরাধরি করে জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আসাদের মৃত্যুর খবর শুনে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো হাজার হাজার মানুষ ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে ছুটে আসে। সরকার সন্ধ্যায় অনির্ধারিত জরুরি আইন ঘোষণা করে। পরদিন পল্টন ময়দানে লাখো লোকের উপস্থিতিতে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ২১ ও ২২ জানুয়ারি শোক ঘোষণা করা হয়। ২৩ তারিখ প্রতিবাদ সভা ও ২৪ তারিখ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। কর্মসূচি শেষে দিনটি স্বতঃস্ফূর্র্ত গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ফলে স্বৈরাচার আইয়ুব শাহির একনায়কত্বের পতন ঘটে এবং তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়। এবং আমরা লাভ করি স্বাধীন বাংলাদেশ। আইয়ুব শাহির পতনের প্রতীক হিসেবে দেশের সব স্থানে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইয়ুবের নামফলক সরিয়ে আসাদের নাম সংযোজন করে। এভাবে আইয়ুব গেট আসাদ গেট, আইয়ুব এভিনিউ আসাদ এভিনিউ নামে রূপান্তরিত হয়। শহীদ আসাদের মৃত্যুর পর পূর্ব বাংলায় স্লোগান উঠেছিল- শহীদ আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র কায়েম হোক, কায়েম হোক। আসাদ একটি সংগ্রামের নাম। আসাদ আন্দোলনের নাম। আসাদ বিপ্লবের নাম। আসাদ স্বাধীনতার নাম। কবি শামসুর রাহমানের কবিতা আসাদের শার্ট আমাদের প্রাণের পতাকা। আসাদরা যুগে যুগে পৃথিবীতে আসেন আবার ইতিহাস সৃষ্টি করে চলে যান। তাই তো শহীদ আসাদ ইতিহাসের নায়ক। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকার গত বছর শহীদ আসাদকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান মরণোত্তর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ পদক প্রদান করেছে। শহীদ আসাদ অমর হোক।

 

লেখক : শহীদ আসাদের ছোট ভাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর