মঙ্গলবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

এ কঠিন লড়াইয়ে জিততে হবে

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

এ কঠিন লড়াইয়ে জিততে হবে

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ ইশতেহারের বক্তব্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি ছিল সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি নির্মূল করে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে সুসংহত করার অঙ্গীকার। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও বিভিন্ন সভা-সমিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে তাঁর জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্বার তুলে ধরেছেন এবং তিনি উল্লেখ করেছেন জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই সম্প্রতি দেশে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে এবং তাতে বিপুলসংখ্যক মাদক পাচারকারী, ব্যবসায়ী ও আসক্তকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে; সেই সঙ্গে বিগত ২১৫ দিনে বন্দুকযুদ্ধে ২৭২ জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর মাদকবিরোধী অভিযানের তীব্রতা আরও বাড়ানোর নির্দেশ এসেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দফতর থেকে। সেই সঙ্গে এবার ব্লক রেইড পদ্ধতিতে ঝটিকা অভিযান চালানো হবে। আর মাদক মামলা, মাদকসহ গ্রেফতাররা যাতে জামিনে ছাড়া না পান, এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ এসেছে। অতএব, ২০১৯ সালের প্রথম দিন থেকেই মাদকবিরোধী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। মাদকবিরোধী যুদ্ধ যাতে শেষ না হয়, এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। মহাজোটের সংসদ সদস্যদেরও নিজ নিজ এলাকায় মাদকের বিষয়ে তীক্ষè নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের প্রথম দিন থেকেই সারা দেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান  চলছে এবং প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলবে। তাই বছরের শুরু থেকেই প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসায়ী নিহত হচ্ছেন এবং ইতিমধ্যে হাজারখানেক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতারও হয়েছেন। সেই সঙ্গে লাখ লাখ পিস ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক উদ্ধার হয়েছে। দেশের উন্নয়ন যেভাবে চলছিল তাতে মাদক অন্যতম বাধা বলে মনে করছে বর্তমান সরকার। তাই এ বাধা দূর করতে মাদক নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলার কথা ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে মাদকসহ গ্রেফতাররা এবং মাদক ব্যবসায়ীরা যাতে জামিনে ছাড়া না পান, এজন্য নানা কৌশল নেওয়া হচ্ছে। সরকার মাদক নির্মূলে শতভাগ আন্তরিক এবং এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও সিআইডি যৌথভাবে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। ফলে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযানের তীব্রতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে মাদক বিক্রেতা, মাদকের বড় বড় ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যদের পৃথক তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তালিকাভুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাদকের সঙ্গে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার যোগসূত্র রয়েছে। তাই মাদকের বিষয়টি বর্তমান সরকারের জন্য বিশেষভাবে জরুরি। সম্প্রতি সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে সবাই সাধুবাদ জানিয়েছে, বিষয়টি হচ্ছে : এখন থেকে সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করা হবে। যাদের ডোপ টেস্ট পরীক্ষার ফল পজিটিভ হবে, তিনি চাকরির জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মাদকাসক্তি থেকে তরুণদের রক্ষা করা, তা হচ্ছে ‘তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি’। ইশতেহারে শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচিত হলে ১ কোটি ২৮ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তিনি করবেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, মাদকাসক্তির অন্যতম প্রধান একটি কারণ হচ্ছে ‘বেকার জীবন’। সে হিসাবে এই ১ কোটি ২৮ লাখ তরুণ কর্মজীবী হতে পারলে মাদকের করাল গ্রাস থেকে তারা রক্ষা পাবে। তাই অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে দিন দিন অভিযানের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এটা আমাদের সবার জন্য খুশির খবর। বিশেষ করে তরুণ-যুব সমাজকে রক্ষা করতে মাদকবিরোধী অভিযানের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে মিডিয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। সরকারি হিসাবমতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ লাখ। এর অধিকাংশই বয়সে তরুণ। ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যদিও প্রকৃতপক্ষে দেশে মাদক সেবনকারীর সংখ্যা অন্তত দেড় কোটি। দিন দিন মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেসরকারি হিসাবে মাদকসেবীর মধ্যে ১ কোটি মাদকাসক্ত। বাকি ৫০ লাখ অনিয়মিত মাদকসেবী। তারা গাঁজা, সিসা, অ্যালকোহল, কোকেন, হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবার মতো ভয়ঙ্কর মাদকে আসক্ত। আমাদের পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে এসব মাদক আসছে। একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে মাদকের আগ্রাসন বন্ধ করা না গেলে মাদক দেশের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তবে এত অভিযানের পরও মাদক পাচার ও ব্যবসায়ীদের তৎপরতা দেশে এবং দেশের বাইরে যে অব্যাহত আছে তা সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায়; যেমন কলম্বোয় গত ৩১ ডিসেম্বর ২৭২ কেজি হেরোইন, ৫ কেজি কোকেনসহ ধরা পড়েন দুই বাংলাদেশি। শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ইতিহাসে মাদকের সবচেয়ে বড় চালান আটকের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ছয় বাংলাদেশি নাগরিকের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশটির পুলিশ মাদক চোরাচালানে জড়িত এক নারীসহ তিন বাংলাদেশির কথা বলেছিল। তারা এখন কলম্বোয় নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন। নতুন করে যে তিন বাংলাদেশির নাম প্রকাশ করেছে শ্রীলঙ্কা, তারা সবাই নারী। প্রায় দুই বছর ধরে অভিযুক্ত ওই বাংলাদেশি নাগরিকরা কলম্বোয় মাদক আনা-নেওয়া কাজে জড়িত। তারা কখনো ঢাকা থেকে সরাসরি কলম্বো আবার কখনো কুয়ালালামপুর থেকে কলম্বো হয়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া করেছেন। বাংলাদেশি আরও কয়েকজন নাগরিক কলম্বোয় মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকতে পারেন বলে সন্দেহ করছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শ্রীলঙ্কায় মাদকের সবচেয়ে বড় যে চালান ধরা পড়ে তাতে ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেন জব্দ করা হয়। কলম্বোর উপকণ্ঠ মাউন্ট লাভিয়ানা এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা মাদকের দাম প্রায় ১৫২ কোটি টাকা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাদকের বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি জঙ্গিদের মতো মাদককেও নির্মূল করার নির্দেশনাও দিচ্ছেন। সুতরাং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। মাদকবিরোধী লড়াই এক কঠিন লড়াই। এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে তাই জাতীয় অঙ্গীকার মনে করে সারা জাতিকে এর সঙ্গে একাত্ম হতে হবে।

 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর