শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নতুন কৌশলে কুল চাষ : হারুনের সাফল্য

শাইখ সিরাজ

নতুন কৌশলে কুল চাষ : হারুনের সাফল্য

গত সপ্তাহের কথা। ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি গ্রামে সোনালি রোদের সকাল। মাঘের মাঝামাঝি, শীতের দেখা নেই, আছে কুয়াশা। ছয় ঋতুর এই দেশে কয়েক বছরের ব্যবধানে শরৎ আর শীত ঋতু দুটি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এ বিষয়গুলো আমি খুব অনুভব করতে পারছি। সেই আশির দশক থেকে অদ্যাবধি নিয়মিত মাঠে যাই, কীভাবে যে এই পরিবর্তনগুলো হচ্ছে তা বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করছি। দেশে শীতকালে গড় তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে রাজধানী ও শহরাঞ্চলের গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। যাই হোক, রাখালগাছি গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগোচ্ছি। খবর পেয়েছি এ গ্রামের এক সফল তরুণ কৃষকের। তার উদ্দেশেই যাত্রা। দেশের এই অঞ্চলটায় ফসল বৈচিত্র্যের অপরূপ সম্মিলন। একটা সময় এ অঞ্চলের মাঠের পর মাঠ শুধু ধান চাষ হতো। এখন পাল্টে গেছে ফসলের মাঠগুলো। কৃষক আর কেবল একটি ফসলেই নির্ভরশীল নয়। কৃষক তার নিজের প্রয়োজনেই খুঁজে নিয়েছে বিকল্প আর রকমারি ফসল। মাঠ ভরে আছে মৌসুমি ফলে, এমনকি ফুলেও। যে ফল ও ফুল একসময় ছিল শুধু নিজ বাগানের শৌখিনতা। কৃষকই সেটাকে চাষের মাঠে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেছে অর্থকরী ফসলে। যাই হোক, স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছি। কৃষিতে সম্ভাবনা, কৃষি নিয়ে তাদের স্বপ্ন ও সমস্যা নিয়ে কথা হচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলেন এক তরুণ। কিছুটা বিস্মিত হলাম। কৃষকরা প্রায়ই এমনটা করেন, সেটা আমার কাছে বিস্ময়ের নয়। অবাক হয়েছি এ কারণে, সে পেছন থেকে ধরে রীতিমতো আমাকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তরুণের বয়স ত্রিশের বেশি হবে না। আমাকে পেয়ে সে কি উচ্ছ্বাস তার! বলল, ‘সিরাজ ভাই, ১৩ বছর ধরে আপনাকে সামনাসামনি দেখার বড় শখ আমার। আজ আপনাকে কাছে পেয়ে আনন্দ ধরে রাখতে পারছি না।’ তরুণের নাম হারুন-অর-রশীদ। তার সাক্ষাৎ পেতেই আমার এই গ্রামে আসা। বিষয়টা ভেঙে বলি, পাঠক। হারুন-অর-রশীদের গ্রাম রাখালগাছি নয়। তার বাড়ি পাশের গ্রাম সানবান্ধায়। এ বছর এই গ্রামে সাড়ে চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি চাষ করেছেন বাউকুল। ১৩ বছর আগে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে কুল চাষের ওপর একটি প্রতিবেদন দেখে সিদ্ধান্ত নেন কুল চাষই হবে তার জীবিকা। সেই থেকে লেগে আছেন। জেনে অবাক হবেন, তার গ্রামে তিনিই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কুল চাষ শুরু করেন। তার দেখাদেখি পুরো গ্রাম এখন কুল চাষ শুরু করেছে। সানবান্ধা গ্রামটিকে এখন লোকজন কুলের গ্রাম নামেই চেনে। তবে হারুন এ বছর কুল চাষে পেয়েছেন আশাতীত সাফল্য। এ সাফল্যের পেছনেও রয়েছে নতুন এক উদ্ভাবনী চিন্তা।

প্রিয় পাঠক, আমি আগে থেকেই বলে আসছি বাংলাদেশের কৃষক দারুণ উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন। তাকে সামান্য একটু খেই ধরিয়ে দিতে পারলেই নিজের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে ফেলতে পারেন। হারুনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আর তাতেই হারুন পেয়েছেন কুলের বাম্পার ফলন, দারুণ সাফল্য। হারুনের গল্পই শোনাতে চাই। তার আগে বাংলাদেশে কুল উৎপাদনের একটা পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখি। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৭-১৮ সালে সারা দেশে মোট ১৭ হাজার ৫৮৬ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৬১ মেট্রিক টন। প্রতি বছরই দেশব্যাপী বাড়ছে কুলের আবাদ। এখন শীত মৌসুমে কৃষকের অর্থকরী ফসলের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ একটা জায়গা নিয়ে নিয়েছে কুল। ক্ষুদ্র চাষি থেকে শুরু করে নতুন উদ্যোক্তা অনেকেই শুরু করেছেন কুল চাষ। কুল চাষ এখন অনেক কৃষকের বার্ষিক আয়ের অন্যতম উৎস। আবার অনেকেই একে শুধু টাকা আয়ের ক্ষেত্র হিসেবে নয়, দেশীয় ফল আবাদের মাধ্যমে দেশের ফলের চাহিদা মেটানোর বড় উপায় হিসেবেও দেখছেন। কম সময়ে কম বিনিয়োগ করে বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার জন্য দারুণ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ফল কুলকে বেছে নিচ্ছেন তারা। এতে বাণিজ্যিক গুরুত্বে আবাদি খেতেও ঢুকে পড়ছে কুল চাষ। দেশের বহু এলাকাতেই বিঘার পর বিঘা জমিতে গড়ে উঠেছে কুলবাগান। অনেকেই আবার নিজের আবাদি খেতে উদ্ভাবনী ধ্যান-ধারণা প্রয়োগ করে অধিক লাভ ঘরে তুলছেন। কালিগঞ্জ উপজেলার রাখালগাছি গ্রামের হারুন-অর-রশীদ তেমনই একজন কুল চাষি। বলছিলাম হারুনের উদ্ভাবনী কৌশলের কথা। যে কৌশল ব্যবহার করে এ বছর বাম্পার ফলনের পাশাপাশি পেয়েছেন বড় ধরনের লাভ। হারুন লক্ষ্য করলেন, পেয়ারাবাগানের যে পেয়ারাটাকে পলিব্যাগিং করা হয়, সেটা আকারে বড় হয়, স্বাদেও হয় মিষ্টি এবং কীটনাশক পেয়ারার গায়ে লাগে না। একেবারে নিজের ধারণা থেকেই এ পদ্ধতিটা তিনি প্রয়োগ করলেন কুলের ক্ষেত্রে। দেখলেন তার চিন্তাই ঠিক। সত্যি সত্যি যে কুলটাকে পলিব্যাগিং করা হয়েছে, সেই কুলটা আকারে আর সব কুলের চেয়ে বড় হচ্ছে, স্বাদেও বেশি মিষ্টি। শুরু করলেন পলিব্যাগিং। গত বছরই ১০০ কেজি পলিব্যাগ কিনে প্রায় ১ লাখ কুলে তিনি পলিব্যাগিং পদ্ধতি প্রয়োগ করলেন। আর পেলেন অভাবনীয় সাফল্য। ৫-৬টি কুলেই ওজন পেলেন ১ কেজি। এই হিসাবে প্রতিটি কুলের ওজন হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ গ্রাম। প্রতি কেজি কুল বিক্রি করছেন সর্বনিম্ন ৭০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১১০ টাকায়। মাঠেই কুল বিক্রির প্রস্তুতি চলছিল। বাগানের পাশেই চলছিল প্যাকিং কার্যক্রম। এক দিনে ৯ কার্টন কুল প্যাকিং করলেন। প্রতি কার্টনে রয়েছে ৫৫ কেজি করে ফল। তার মানে গড়ে প্রায় ৫০০ কেজি ফল পাচ্ছেন প্রতিদিন। পলিব্যাগিং করার কারণে কুল পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে। কোনো ধরনের কীটনাশকও প্রয়োগ করতে হয় না। কুলের গায়ে কোনো দাগও পড়ে না। ফলে বাজারে তার কুলের চাহিদা যেমন বেশি, দামটাও পাচ্ছেন ভালো। পাঠক, কৃষিতেই কপাল খুলেছে হারুনের। তার সঙ্গে কথা বলার এক ফাঁকে তিনি বলছিলেন, ‘১৩ বছর আগে টেলিভিশনে দেখা অনুষ্ঠানে স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে থাকিনি। জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছি কুল চাষকে। জমি লিজ নিয়ে শ্রমে ঘামে তিল তিল করে গড়ে তুলেছি নিজের স্বপ্নকে। আমি এখন জানি কেমন করে মাটি থেকে ফসল ফলিয়ে নিতে হয়।’ আত্মবিশ্বাসী হারুন মাত্র সাড়ে চার বিঘার ৭৬৫টি এক বছর বয়সী কুল গাছ থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ হাজার টাকার ফল পাচ্ছেন। একটা গাছ থেকে তিনি এক বছরের বেশি ফল নেন না। প্রতি বছরই নতুন গাছ রোপণ করেন।

পাশের ধান খেত দেখিয়ে হারুনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এই যে ওই কৃষক ধান চাষ করছেন, কুলে যেহেতু লাভ বেশি, তিনিও তো কুল চাষ করতে পারতেন? হারুন বললেন, ‘আগামী বছর এসে দেখবেন আশপাশের সবাই কুল চাষ করছেন। আমার গ্রামে আমিই কুল চাষ শুরু করি। এখন সারা গ্রাম শুধু কুলের বাগান। তাই এ গ্রামে এসে জমি লিজ নিয়ে কুল চাষ করছি। আগামী বছর দেখবেন, এ জমিগুলোতেও কুল চাষ শুরু হবে।’

দুই বিঘা আর আড়াই বিঘা পরিমাপের দুই খ-ের জমিতে পাঁচ থেকে ছয় ফুট উঁচু সাইজের একেকটি কুল গাছ। প্রতিটি গাছে ব্যাপক সংখ্যায় কুল ধরেছে এবার। দেখলে মনে হয় সবুজ রঙের আপেল ধরে আছে থোকায় থোকায়। এটি আপেলের থেকেও রসালো, মিষ্টি ও সুস্বাদু। কুল চাষি হারুনের দাবি, ভোক্তাদের উচিত বিদেশি ফলের পরিবর্তে দেশ ফল বেশি বেশি খাওয়া। এতে দেশের ফলকে যেমন উৎসাহিত করা হবে, একই সঙ্গে দেশি উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতেও তা হবে কার্যকর এক উদ্যোগ।

শুধু কুল চাষ নয়, হারুনের রয়েছে পেয়ারা ও শরিফার বাগানও। মোট কথা উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদই হারুনের মূল লক্ষ্য; যা থেকে আজ জীবনের অনেকটাই গুছিয়ে নিতে পেরেছেন হারুন। পরিবারের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে আছেন তিনি। ছোট ভাইকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সাত শ্রমিক খাটছেন তার কুলের খেতে। তাদেরও ভরসার জায়গা হারুন।

আজকের দিনে খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজনেই একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে জ্ঞান সম্প্রসারিত হচ্ছে। কৃষি ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সম্প্রসারকের ভূমিকা পালন করছেন কৃষক নিজেই। হারুনের এই কুল চাষের গল্পটিও তেমনি। ফলে এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কুলবাগান। কুল শুধু হারুনের জীবনের পরিবর্তনই করছে না, গোটা এলাকার কৃষিবৈচিত্র্যে এটি হয়ে উঠেছে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। বহু মানুষের অনুপ্রেরণার ক্ষেত্র।

সূর্য তখন পুবাকাশে তেজ ছড়াতে শুরু করেছে। তাপমাত্রা বাড়ছে। মাঠের পাশের ফাঁকা খেতে বসে হারুন ও তার ভাইসহ কুল বেছে বেছে কার্টনে ভরছেন। স্তূপ করে রাখা কুলের ওপর সূর্যের আলোর ঝলকানি আমার মনে আরও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল। হারুনকে বললাম, তোমার এই কুলের আকার আপেলকেও হার মানায়। হারুন বললেন, ‘যারা আপেল আমদানি করে তারা যদি আমার কুল খেতেন তাহলে আর আপেল আমদানি করতেন না।’ হারুনের কথা শুনে তাকে বললাম ১০ কেজি করে পাঁচটি কার্টনে তোমার খেতের কুল প্যাকেট করে দাও, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দু-এক জনকে পাঠাব যাতে তারা কুলের আকার দেখে স্বাদ নিয়ে বিদেশ থেকে ফল আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গ্রামের সাধারণ কৃষক এখনো মাটির মতো নরম, দারুণ অতিথিপরায়ণ, নিজের উৎপাদিত ফল-ফসল উপহার দিতে উন্মুখ। হারুন পাঁচটি কার্টনে ৫০ কেজি কুল আমাকে দিলেন। কিন্তু কিছুতেই এগুলোর দাম রাখবেন না। এই ৫০ কেজি কুলের সেদিনের পাইকারি মূল্য ১০০ টাকা কেজি দরে হয় ৫ হাজার টাকা। কিন্তু অনেক জোরাজুরির পর তিনি অর্ধেক মূল্য ২ হাজার ৫০০ টাকা রাখেন। সেই সঙ্গে বললেন, ‘ভাই, আপেল আমদানির বদলে মানুষ যদি কুল খায়, তাহলে দেশের টাকা দেশে থাকবে। আমাদের সবার উপকার হবে। এ উপকারের কোনো দাম হয় না।’

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর