মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

মোবাইল কোর্ট : আইনের শাসনের শক্তি

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী

মোবাইল কোর্ট : আইনের শাসনের শক্তি

যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের এক মামলায় মি. ডারহামকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, এ মামলায় জুরিরা যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। ঘটনাস্থলে আসামি ছিল, এমন প্রমাণ নেই। আদালতে ১৯ জন সাক্ষী শপথ নিয়ে বলেছিলেন, মি. ডারহাম একটি ক্রীড়া অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বিচারকরা এসব সাক্ষীকে ‘ভুয়া ও সাজানো’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে ডিএনএ পরীক্ষার পর আসামি খালাস পায়। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এমন অজস্র গলদ আছে। ১৯৯১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ লাপাত্তা হয়ে যাওয়া তিন আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যুর জন্য সিএমএমকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১১ বছর পর এ নির্দেশ মামলার নথিপত্রসহ পৌঁছে সিএমএম-এর কাছে। একই ভবনের ওপরে আর নিচে ছিল এ দুটি আদালত। এ এক অদ্ভুত রহস্য! এসব বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র বিচারপতি লর্ড উলফ বিচার ব্যবস্থার সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ‘বিলম্ব’ এবং ‘ব্যয়’-কে। যে কারণে তিনি বিকল্প উপায়ে মামলা নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ সমাজে অপরাধের অন্তর্নিহিত স্বরূপ কতটা আমরা উদঘাটন করতে পারি? আমাদের চিন্তা ও মনন মানবীয় আবেগ ও প্রবৃত্তি দ্বারা প্রভাবিত। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার নিয়ত পরিবর্তনশীলতার ধারায় যুক্ত হয় নতুন সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা এবং বিচার ব্যবস্থা। তারই আলোকে ‘ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে’ মোবাইল কোর্ট ব্যাপকভাবে সমাদৃত বিচার কার্যক্রম। যেখানে অপরাধ, সেখানেই বিচার। মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে যাওয়া বিচার, অর্থাৎ চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অপরাধের প্রকাশ্য বিচার। এটিই মোবাইল কোর্টের রূপরেখা। ১৯৫০ সালে মাদ্রাজ হাই কোর্ট যার প্রবক্তা। ট্রায়াল অ্যাট দ্য পিস অব অকারেন্স, না দেখা অপরাধ এবং বাস্তবে দেখা অপরাধ, এ দুইয়ের মাঝে রয়েছে বিশাল তফাত। বাস্তবে যা দেখা হয়নি, তার বিচারে প্রয়োজন বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণ। বাস্তবতা হলো, বিচার আদালত বিচার দিতে ইচ্ছুক, কিন্তু আদালতে বাদী বা সাক্ষী নেই, তারিখ পড়ছে বারবার, সমন বা ওয়ারেন্ট দিয়েও সাক্ষী আনা যাচ্ছে না, আবার আদালতে এসে ঘটনার সময়কার স্মৃতি ভুলে দুর্বল সাক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরাও মুখ খুলছে না। এ ছাড়া আছে অজ্ঞাতনামা আসামি, তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও ত্রুটি, অভিযোগনামায় সত্য গোপনের চেষ্টা, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ মুছে ফেলা। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ২০১০ সালে পরিবেশ অধিদফতরের দায়ের করা এক মামলায় এখনো চার্জশিট উপস্থাপন হয়নি। একটি মামলায় ৫৩ বার তারিখ পড়েছে, অথচ আদালতে প্রসিকিউশন অনুপস্থিত। বছর গড়িয়ে যায়, অপরাধীও অদৃশ্য বালিয়াড়িতে হারিয়ে যায়। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যময় ট্র্যাপের মতো এভাবে হারিয়ে গেছে বহু সাক্ষ্য-প্রমাণ। ফলে বিচার অনিষ্পন্ন রয়ে যায়। বিচারের পথটি এভাবে ক্যাক্টাসের মতো কণ্টকময় হয়ে আছে। এরপর আছে সমাজের দুষ্টক্ষত, মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা। মিথ্যা মামলার ফাঁদে ফেলে অজস্র অর্থ ও সময়ের অপচয় সম্পর্কে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি এম রুহুল আমীন দুঃখের সঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সত্য গোপন করে এবং জাল কাগজ দিয়ে যে কেউ তার অনুকূলে আদালতের রায় নিতে পারে।’ ব্রিটিশ পূর্ব উপমহাদেশের মুসলিম ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় দেশের কোথাও ডাকাতি, দস্যুতা বা খুনের মতো গুরুতর অপরাধ ঘটলে তাৎক্ষণিক জেলা কাজী সার্কিট অধিবেশন বসিয়ে অকুস্থলে সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে বিচার করতেন। আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫২ ধারা আদালতকে তাঁর অধিক্ষেত্রের যে কোনো স্থানে বসে বিচার করার এখতিয়ার দিয়েছে। বিচার উপেক্ষা বা বিলম্বিত বিচারের সংস্কৃতি সৃষ্টি করে অপরাধের ক্রমবৃদ্ধি। এসব প্রেক্ষাপটে সরকারি সম্পদ, জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশ কেন্দ্রিক অপরাধ দমনে মোবাইল কোর্ট অনন্য শক্তি। মোবাইল কোর্টের হাতে প্রকাশ্যে অপরাধীর দৃশ্যমান শাস্তির ইতিবাচক প্রভাব পড়ে আইনের শাসনের সূচকে। মোবাইল কোর্টের সেতু বেয়ে বিএসটিআই, পিডিবি, বিআরটিএ, ওয়াসা, ডিপিডিসি, রাজউক, বন্দর, তিতাস গ্যাস, পরিবেশ অধিদফতরসহ বহু প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বাস্তবতায় দেশের উচ্চ আদালত খাদ্য ও সড়ক নিরাপত্তা, পরিবেশ ও নদ-নদী রক্ষাসহ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয়ে নির্বাহী বিভাগকে যে নির্দেশনা দিচ্ছে, তার সফল বাস্তবায়নে নিরন্তর কাজ করছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রসিকিউশন, সংস্থার প্রতিনিধি বা বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে যৌক্তিক প্রমাণসহ গভীর অনুসন্ধানী চোখ ও মন নিয়ে মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচার কাজ করতে হয়। অপরাধকে সামনে রেখেই অপরাধীর স্বীকারোক্তি, তাই অপরাধ ঘটিয়ে মোবাইল কোর্টের সামনে মিথ্যা বলার বা মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। নির্দোষ ব্যক্তি ভুলক্রমে মোবাইল কোর্টে দণ্ডিত হলেও উচ্চ আদালত থেকে অবধারিতভাবে মুক্তি পাবে। এমনকি ন্যায়বিচারের প্রশ্নে ডিএম/এডিএম আদালত থেকেও জামিনে মুক্তি পাবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের আদেশের বিরুদ্ধে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আপিল, এরপর বিজ্ঞ দায়রা জজের কাছে রিভিশন, সর্বশেষে আছে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে রিট দায়ের। সুতরাং মোবাইল কোর্টের আদেশ বা রায় অপরিবর্তনীয় নয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা খাদ্যে ভেজাল, বাল্যবিয়ে, ইভ টিজিং, ভূমি দস্যুতা, পরিবেশ দূষণ, হাসপাতালে অপচিকিৎসা, সিন্ডিকেট ব্যবসা, অবৈধ ভবন নির্মাণ, মানহীন পণ্য উৎপাদন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ চুরি, অবৈধ ইটভাটা, নদ-নদী দখল, মাদক সেবন ও ব্যবসা, নিষিদ্ধ ইলিশ শিকারসহ অগণিত দিগন্তে ছড়িয়ে থাকা অপরাধের বিরুদ্ধে নিরন্তর অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কত নিষ্ঠায়, ত্যাগে ও শ্রমে মানুষের কষ্ট লাঘব এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতি রোধ করছে মোবাইল কোর্ট, তার হিসাব অপরিমেয়। মোবাইল কোর্টে এমন কিছু প্রভাবশালী অপরাধী ধরা পড়ে, যারা তাৎক্ষণিক জামিন চাইলেও পায় না। কারাগারে পাঠালেই চূর্ণ হয় এসব অপরাধীর স্পর্ধা। জেল-জরিমানা যত স্বল্পই হোক, মোবাইল কোর্টের অভিঘাত পড়ে নাগরিক জীবনে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, অর্থনীতিতে। তবে শুধু দণ্ড প্রদানে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। মোবাইল কোর্টের বৈপ্লবিক ভূমিকায় অপরাধ থেকে সমাজকে পরিত্রাণ দেওয়া সম্ভব, যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সুশাসনের উচ্চ মাত্রিকতায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। চট্টগ্রাম বন্দর, পরিবেশ অধিদফতর ও বিদ্যুৎ সেক্টরে মোবাইল কোর্টের সাফল্য তার উজ্জ্বল প্রমাণ। নাগরিকদের মধ্যে শানিত হচ্ছে আইন মান্যতার চেতনা, সেটিও মোবাইল কোর্টের সার্থকতা। প্রতিটি মোবাইল কোর্টই আইনের ক্যাম্পেইন। এতে ভোক্তা অধিকার, নাগরিক অধিকার সম্পর্কে মানুষ সচেতন হচ্ছে। খাদ্যে ভেজালের অনেক অজানা তথ্য জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে মোবাইল কোর্ট। তাই পরিবেশ দূষণ ও খাদ্যে ভেজালের বেদনা ও যন্ত্রণায় দগ্ধ মানুষ মোবাইল কোর্টের নিরবচ্ছিন্ন অভিযান চায়, এর ছন্দপতন হলে জ্যামিতিক হারে বাড়ে অপরাধ।

ফৌজদারি অপরাধে ১১০টি আইনের আওতায় বিচার করছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। তাঁদের সঠিক পথ-নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা দিলে অসাধারণ সাফল্য আসবে। অকাট্যভাবে প্রমাণিত অপরাধে জড়িতদের মোবাইল কোর্টে দণ্ডের পর বিচারের পরবর্তী ধাপে দণ্ডাজ্ঞা বহাল না থাকলে মোবাইল কোর্টের চেতনা অর্থহীন হয়ে যাবে। তবে জরিমানার চাইতে কারাদণ্ডের প্রভাব বেশি। কারাদণ্ডের যে গ্লানি, তা ট্রান্সমিট হয়ে সামাজিকভাবে শিক্ষণীয় হচ্ছে। সুতরাং বড় মাত্রার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলে কারাদণ্ড প্রদান অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। দণ্ড প্রদানের ক্ষমতা বা এখতিয়ার নেই, তফসিল বহির্ভূত এমন অপরাধ কিন্তু বিচারিক আদালতে যাচ্ছে। শুধু ২০১৩ থেকে ২০১৮ ইং সালের পরিসংখ্যান মতে, মোবাইল কোর্টে ৬ লাখ ৩৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, জরিমানা আদায় হয়েছে ২০৯ কোটি টাকা। এ বিপুল সংখ্যক অপরাধের মামলা বিচার বিভাগের ওপর এক বাড়তি চাপ হতে পারত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রতি পরামর্শ থাকল, মাসে কতটি মোবাইল কোর্ট হলো, কত জরিমানা হলো, তার সংখ্যাগত মূল্যায়ন নয়। মানদণ্ডের ভিত্তি হতে হবে ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক মান।

গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র পরিচালনার সফলতার জন্য ত্রিমাত্রিক ক্ষমতা বিভাজনের কথা বলেছিলেন : পাবলিক অ্যাসেম্বলি, ম্যাজিস্ট্রেট এবং জুডিশিয়ারি এবং এখানে ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাহী শাসনের প্রতীক। ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তাঁর বিখ্যাত The Spirit of Laws বইয়ে Theory of Separation of powers সম্পর্কে বলেছেন : Each power should be checked & balanced. যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ফেডারেল জুডিশিয়াল সিস্টেমে সর্বোচ্চ আপিল আদালত, যা যুক্তরাষ্ট্রের Constitution, Federal Legislation Ges Treaties-এর ব্যাখ্যা প্রদান করে। এখানে বলা হয়েছে, ÔLegislative Makes the Law, Executive Enforces the Law & Judicial Interprets the Law. কিন্তু কোনো বিচার কাজেই কোনো বিভাগ সর্বশক্তিমান নয়। প্রত্যেকের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সংবিধান ও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যে যার যার অবস্থানে সবাই বিচারক, কিন্তু প্রত্যেকে একে অন্যের পরিপূরক। তবে সবার ঊর্ধ্বে আছেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহ। এ দৃঢ় বিশ্বাস বিচারিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শক্তিশালী আধার। প্রধান বিচারপতির পদ অলঙ্কৃত করার পর মরহুম বিচারপতি মইনুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সততা ও যোগ্যতার অভাব ঘটলে কোনো নীতি-ব্যবস্থাই শেষ পর্যন্ত সুফল আনতে পারে না, তা যতই উত্তম হোক না কেন।’ সুতরাং ন্যায় বিচার এবং সততা ও যোগ্যতা এক সূত্রে গাঁথা। আসুন, মোবাইল কোর্টের অভিযাত্রায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সিভিল সোসাইটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিকরা একাত্ম হই। আইন না মানার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট শক্তিশালী অস্ত্র। এর যথার্থ প্রয়োগে সম্ভব সমাজের অবক্ষয় দূর করা। ২০১৯ সালকে স্বাগত জানিয়ে নবীন ম্যাজিস্ট্রেটদের আহ্বান জানাব, ‘জলপ্রপাতের মতো তীব্র স্রোতে এগিয়ে সমাজের পচন ধুয়ে ফেল, শুভ্র ও সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তোল।’

লেখক : মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন।

e-mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর