শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমরাই পারি

অধ্যাপক ডা. কামরুজ্জামান চৌধুরী

আমরাই পারি

ক্যান্সার, একটি অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধিজনিত রোগ, যা শরীরের অন্যান্য অংশের ওপর আক্রমণ বা বিস্তার লাভ করে। ক্যান্সারের সচেতনতা বৃদ্ধি, শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ এবং চিকিৎসায় উৎসাহিত করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখ বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবারের ক্যান্সার দিবসের থিম হলো-

‘I am and I will’. এর মানে হলো আমি এবং আমার মধ্যে ক্ষমতা রয়েছে আমার এবং আমার প্রিয় মানুষদের ক্যান্সার থেকে প্রতিরোধ করার।

সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ ক্যান্সার এবং বিশ্বব্যাপী জনগোষ্ঠীর মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো এই ক্যান্সার। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ৯.৬ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে শরীরের যে কোনো অঙ্গেই এ রোগ হতে দেখা যায়। তবে সঠিক সময়ে এ রোগ শনাক্তকরণ ও যথাযথ চিকিৎসা, মানুষকে অনেকাংশে সুস্থ করে তোলে। ধূমপান, মদ্যপান, জর্দা-তামাকপাতা, কিছু প্রক্রিয়াজাত খাবার, রেডমিট, পোড়া খাবার খাওয়া; এ ছাড়া আঁশযুক্ত খাবার, সবজি, ফলমূল, ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম কম খাওয়া, শারীরিক ব্যায়াম না করা, শারীরিক ¯ূ’লতা বা বেশি ওজন, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি, এক্স-রেডিয়েশন, কিছু রাসায়নিক পদার্থ, কিছু ভাইরাস ও অন্যান্য কারণে ক্যান্সার হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৮ সালে অন্য সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে দুটি প্রধান ক্যান্সার হলো-১. ফুসফুসের ক্যান্সার (২.০৯ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ১.৭৬ মিলিয়ন মানুষ ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে। ২. ব্রেস্ট (স্তন) ক্যান্সার। ২.০৯ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ০.৬ মিলিয়ন মানুষ স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরও এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে ক্যান্সারের কারণে ০.৮ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। যার মধ্যে ৪৮ হাজার পুরুষ এবং ৪১ হাজার নারী। এ ছাড়া, প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, বাংলাদেশে পুরুষদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সার এবং নারীদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারের হার তুলনামূলক অন্য ক্যান্সারের তুলনায় বেশি।

দেশে সরকারি পর্যায়ে প্রধানত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের ক্যান্সার বিভাগ। এ ছাড়া কিছু দাতা সংস্থা যেমন আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল এবং ৮-৯টি বেসরকারি হাসপাতালে চলছে ক্যান্সারের চিকিৎসা। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত বছর ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার যা এই বছর আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা যা আছে, তা একদিকে অপ্রতুল এবং অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে সারা বিশ্বে এই চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে এত বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও যে হারে আমাদের চিকিৎসা খাত এবং হাসপাতালগুলোর উন্নত হওয়ার কথা তেমনটি হয়ে ওঠেনি। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োজন। যার মধ্যে রয়েছে সার্জিক্যাল অনকোলজি (শৈল্য চিকিৎসক), মেডিকেল অনকোলজি, রেডিয়েশন অনকোলজি, পেডিয়াট্রিক অনকোলজি, নিউক্লিয়ার মেডিসিন, ডায়াগোনস্টিক সার্ভিস। এ ছাড়াও ফিজিওথেরাপি, ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল, পরামর্শদাতা দল (Counseling Team), পুষ্টিবিদ, প্যালিয়েটিভ সাপোর্ট কেয়ার এবং জরুরি কেয়ার টিম ইত্যাদির সমন্বয়ে একটি ক্যান্সার চিকিৎসা সম্পন্ন হয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ১০টিও বিকিরণ যন্ত্র (রেডিয়েশন মেশিন) সমন্বয়ে ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। বাংলদেশে সরকারি পর্যায়ে ১১টি এবং বেসরকারি পর্যায়ে আটটি রেডিওথেরাপি সেন্টারের মধ্যে Cobalt Teletherapz Machine আছে ১৩টি; Brachztherpaz Machine আছে ১৬টি; Linac Machine আছে ২০টি; যা আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ ছাড়াও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটের কারণে বিশেষায়িত হাসপাতাল সেভাবে গড়ে উঠছে না। সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সমন্বয়ে রেডিয়েশন অনকোলজিস্টের সংখ্যা মাত্র ১০০-১৫০ জন। যা বাস্তবতার সাপেক্ষে খুবই নগণ্য। প্রতি বছর মাত্র ৫ জন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট এবং ৩-৫ জন মেডিকেল অনকোলজিস্ট তৈরি হচ্ছে, যা আমাদের দেশে এই বিশাল ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য অনেক কম। ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর এই দেশে যেখানে ১৬০টি ক্যান্সার সেন্টার প্রয়োজন সেখানে আমাদের হাতে গোনা কয়েকটি ক্যান্সার সেন্টার দিয়ে সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা কল্পনাতীত। ক্যান্সার চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায়ে সার্জিক্যাল অনকোলজিস্টরা একটি গুরুতপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যে শৈল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয় তা অন্য শৈল্য চিকিৎসা থেকে ভিন্ন। কারণ এর জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ দক্ষতা এবং নিখুঁত নৈপুণ্যতা। কিন্তু এই ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ শৈল্য চিকিৎসক তৈরিতে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। বাংলাদেশে দুটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে মাত্র ৩-৫ জন সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট বের হন যা আসলে আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এ ছাড়াও বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীদের ওপর নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। এর কোনো উদ্যোগ কখনো নেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালে ক্যান্সার প্রতিরোধে একটা নীতিমালা করা হয়েছিল যেটা আর আপডেট করা হয়নি। এর জন্য সবার আগে দরকার আমাদের নিজস্ব একটা পরিসংখ্যান। রোগীর সংখ্যা কত কী ধরনের ক্যান্সার বেশি হচ্ছে, এগুলো যদি জানা যায় তবেই ক্যান্সার মোকাবিলায় সঠিক পরিকল্পনা নেওয়া যাবে। আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে ক্যান্সার চিকিৎসা মোকাবিলায় ৫০ বছরের একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং বর্তমানে ভারতের ক্যান্সার সেন্টারগুলো সেই পরিকল্পনার ফসল আর সেখানে আমাদের দেশে তেমন কোনো পরিকল্পনা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্যান্সার পরিকল্পনা তৈরি করা এখন সময়ের দাবি।

অতএব, আমি, আপনি এবং আমাদের সবাইকে হাতে হাত রেখে ক্যান্সার মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা যদি এগিয়ে আসে তাহলে এ দেশে সম্ভব ক্যান্সার চিকিৎসার একটি শক্ত ভিত গড়ে তোলা। ক্যান্সার প্রতিরোধে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে- ১। ক্যান্সার প্রতিরোধে বাংলাদেশের সব বিভাগীয় শহর, মেডিকেল কলেজ এবং জেলা শহরে একটি করে দক্ষ সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট, মেডিকেল অনকোলজিস্ট এবং রেডিয়েশন অনকোলজিস্টদের সমন্বয়ে একটি করে আধুনিক ক্যান্সার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। যাতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষকে কষ্ট করে ঢাকা না এসে নিজের বাড়ির পাশেই চিকিৎসা নিতে পারে। ২। কেমোথেরাপি রোগীদের জন্য একটি অ্যাসেনশিয়াল ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করতে হবে, যা দেশের সব সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে পাওয়া যাবে। ৩। সার্জিক্যাল অনকোলজিস্টদের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা যার মাধ্যমে সাধারণ শৈল্য চিকিৎসকরাও নিজেদের এই ব্যাপারে দক্ষ করে তুলতে পারেন এবং প্রাথমিক অবস্থায় নিজেরা ভূমিকা রাখতে পারেন। ৪। প্যালিয়েটিভ কেয়ার স্থাপন : প্যালিয়েটিভ কেয়ার ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ অধিকাংশ রোগী অ্যাডভান্স স্টেজে চিকিৎসা নিতে আসেন। বাংলাদেশে একমাত্র বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর পেলিয়েটিভ কেয়ারে মাত্র ১৯টি শয্যা রয়েছে যা দ্বারা এত বিশালসংখ্যক ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ক্যান্সার রোগীদের ব্যথা নিরামক হিসেবে মরফিন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ। এ জন্য চিকিৎসকদের অবশ্যই মরফিন এবং এর ব্যবহার পদ্ধতির সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে যাতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার এই ড্রাগটি চিকিৎসকরা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যদি আমাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করে তবে আমরা নিজেদের আরও ক্যান্সার মোকাবিলায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আসুন আজ এই বিশ্ব ক্যান্সার দিবসে সবাই মিলে সচেতন হই, অন্যকে সচেতন করি, আর সমাজ থেকে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা করি।

লেখক : পরিচালক, মেডিকেল সার্ভিসেস আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর