শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রাণিসম্পদের অন্যরকম এক সংগ্রহশালা

শাইখ সিরাজ

প্রাণিসম্পদের অন্যরকম এক সংগ্রহশালা

আমি নিজে আজও একটি খামার গড়তে পারিনি। তবে গত প্রায় ৪০ বছর ধরে খামারিদের সঙ্গে আমার ওঠাবসা। চোখের সামনে এ দেশে হাজার হাজার খামার গড়ে উঠতে দেখেছি, টেলিভিশনের পর্দায় তুলে ধরেছিÑ একটি দেখে আরেকটি খামার গড়ে উঠেছে। কোনোটি সফল হয়েছে, কোনোটি বিফল। যাই হোক, ‘গরু-ছাগলে আজ দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ’- এমন খবর বেশ স্বস্তিদায়ক, আনন্দেরও বটে। সার্বিকভাবে কৃষিতে আমাদের এ অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। প্রাণিসম্পদ খাতে একটা বিপ্লব যে ঘটে গেছে গত কয়েক বছরে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কাগজ-কলমের পরিসংখ্যান আর মাঠের চিত্রের মাঝে কিছুটা দূরত্ব থাকে। বিগত বছরগুলোয় ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেশের নানা প্রান্তের খামারির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ কিংবা সিলেটসহ দেশের নানা জেলার খামারির কণ্ঠে হতাশার সুর ছিলÑ দুধের দাম নেই, প্রাণিখাদ্যের সংকট, প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব, চোরাই পথে ভারত থেকে গরু আমদানি প্রভৃতি। পাশাপাশি আশার সুরও যে ছিল না তা নয়, নতুন নতুন খামারি তৈরি হয়েছে। অসংখ্য বেকার যুবক খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ছাগল পালন করে নারীরা সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেনÑ এমন সংবাদ দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা থেকেই এসেছে। সব মিলিয়ে কিছু বিষয় বাদ দিলে প্রাণিসম্পদ নিয়ে আমাদের যে উন্নয়নযাত্রা তার শুরুটা দুর্দান্তই বলা চলে।

ছাগল পালন আমাদের দেশে বেশ লাভজনক। পৃথিবীব্যাপী আমাদের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের খুব সমাদর রয়েছে। প্রজনন ক্ষমতা, মাংসের গুণ ও চামড়ার জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল সবার কাছেই  সমাদৃত। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা (এফএও) এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ২০১৫ সালের তথ্যানুযায়ী, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। তাদের হিসাবে দেশে প্রতি বছর ২৫ শতাংশ হারে গবাদিপশুর খামার বাড়ছে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখন খামারের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। আর গত তিন বছরে দেশে গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ। যেখানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৪৭ লাখ ৪৫ হাজার। এর মধ্যে গরু ২ কোটি ৩৯ লাখ, মহিষ ১৪ লাখ ৭৮ হাজার, ছাগল ২ কোটি ৫৯ লাখ ও ভেড়া ৩৪ লাখ। এসব তথ্যই প্রমাণ করে, শুধু উৎপাদনের দিক থেকে নয়, গবাদিপশুর জাতগত বৈচিত্র্যের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বেশ সমৃদ্ধ। পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, দেশের গরু ও ছাগলের সম্ভাবনা নিয়ে বিশেষ করে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর অঞ্চলের ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের ঐতিহ্যগত ও বাণিজ্যিক দিক চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘কৃষি দিবানিশি’ অনুষ্ঠানে বেশ কিছু প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে মাঠে কাজ করতে করতে একটা বিষয় বুঝেছি খুব ভালোভাবেই। তা হলো, মানুষ বৈচিত্র্য পছন্দ করে। নতুন কিছুর প্রতি মানুষের ঝোঁক চিরকালের। আর সেই নতুন যদি হয় প্রয়োজনের বিকল্প তাহলে তো কথাই নেই। গত জানুয়ারির শেষ দিকে যশোরে গিয়েছিলাম। শুনলাম যশোরের এক খামারির কথা যিনি কিনা আর সব খামারি থেকে ভিন্ন। কেন ভিন্ন সে বিষয়টা পরে বলছি। খামারির নাম মাহমুদুল ইসলাম। আমাদের হাতে তখন সময় কম। দৃশ্য ধারণ করতে সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছাতে হবে। সূর্য অনেকখানি হেলে পড়েছে। মাঘের মাঝামাঝিও শীতের প্রকোপ নেই। তবে হালকা কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারপাশ। যখন যশোরের চাঁচারা পুলেরহাট এলাকায় পৌঁছলাম, তখন একেবারে বিকালের শেষ লগ্ন। মাহমুদুলের খামারটির বাইরে থেকে সাদামাটা। বাঁশ-কাঠের বেড়া আর দরজা দেখে বোঝার উপায় নেই ভিতরে কী আছে। পাঠক, বলছিলাম মাহমুদুলের খামারটি একটু ভিন্ন রকম। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিভিন্ন জাতের প্রাণী। এটি রীতিমতো বিরল প্রজাতির পশুসম্পদের একটি খামার। বাংলাদেশেও পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সংগৃহীত এত ধরনের পশু নিয়ে খামার গড়ে উঠেছে, খবরটি ছিল আমাদের জন্য দারুণ আগ্রহের।

কথা হলো মাহমুদুলের সঙ্গে। ২০০৮ সালে শখ করে মাত্র দুটি হরিয়ানি ছাগল পালন শুরু করেন তিনি। তখন থেকেই তাকে পেয়ে বসে পশু পালনের বাণিজ্যিক নেশায়। দিনে দিনে খামারে ছাগলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে তিনি সংগ্রহ করতে থাকেন পৃথিবীর বিভিন্ন জাতের গরু, ছাগল, দুম্বা, গাড়ল, ভেড়াসহ নানান প্রাণী। সব মিলে এক শর মতো প্রাণী রয়েছে খামারটিতে। এক বিঘা আয়তনের খামারে বিভিন্ন ভাগে রাখা হয়েছে প্রাণীগুলোকে। টিনের ছাউনির ঘর, তার সামনে ঘের দেওয়া খোলা জায়গা। অনেকটা উন্মুক্ত অবস্থাতেই তিনি লালনপালন করছেন ভিন্ন ভিন্ন এসব পশু প্রাণী।

কয়েক বছর ধরেই কোরবানির সময় ভুট্টি গরু বা ভুটানি গরু নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। গরুগুলো বড় আকারের ছাগলের মতো। মাহমুদুলের খামারে তিনটি গাভী আর একটি ষাঁড় রয়েছে এই জাতের। বছর দুয়েক আগে শখ করে ভুটান থেকে সংগ্রহ করেছেন তিনি। সেই গল্পটাও শোনালেন। বেড়াতে গিয়েছিলেন দার্জিলিং। দার্জিলিং থেকে এক দিনের জন্য গিয়েছিলেন ভুটান। সেখানে এই গরু দেখে তার আগ্রহ জন্মে। বৈধভাবেই তিনি ভুটানি গরু আমদানি করেন। গরুর দাম ৩০ হাজার টাকা, দেশে আনতে খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। সব মিলে একটা গরুতে তার খরচ পড়ে মোট ৫০ হাজার টাকা। আকৃতিতে ছোট হলেও বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের দেশে এখন এসব গরুর দাম বেশি বলে জানিয়েছেন খামারি মাহমুদুল ইসলাম। আড়াই বছরে একেকটা গরুর দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। মাহমুদুলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, মানুষ তো বড় গরু খোঁজে, মাংস বেশি এমন গরুর দামই বেশি হওয়ার কথা। ছোট আকৃতির এ গরুর দাম কেন বেশি? তিনি জানালেন, ব্যতিক্রমী বলে এ গরুর চাহিদা বেশি। আর মাংসও বেশ টেস্টি। চিড়িয়াখানা বা শহরাঞ্চলে প্রদর্শনীর জন্যও এ গরুর বেশ চাহিদা।

এ সংগ্রহশালায় রয়েছে চাইনিজ বারবারা জাতের বিশেষ প্রজাতির ছাগলও। বিশ্বের সেরা ছাগলগুলোর মধ্যে এটিও একটি; যার বাজারমূল্য যথেষ্ট ভালো বলছেন খামারি। তিনি বলছেন, এ জাতের ছাগলের জোড়া বিক্রি করেন ৬০ হাজার টাকায়। আর বাচ্চার জোড়া বিক্রি করছেন ২৫ হাজার টাকা করে। রাজস্থানি, হরিয়ানি, তোতাপুরি, নেপালিসহ মোট ১৩ প্রজাতির ছাগল রয়েছে এ খামারে। রয়েছে তুর্কি ও নাগলপুরি দুম্বা, গাড়ল। নিজেই এসব পশুর নিয়মিত ব্রিড করছেন। ফলে এখানে দিনে দিনে পশুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বাচ্চা বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছেন খামারি মাহমুদুল। সব মিলে এ খামারে সৃষ্টি হয়েছে বাণিজ্যিক আয়ের উৎস। সব খরচা বাদ দিয়ে গড়ে প্রতি মাসে লাভ থাকছে ৪০ হাজার টাকার ওপরে। প্রশ্ন হলো, এসব ভিন্ন দেশের প্রাণী আমাদের দেশের আবহাওয়ায় কতটা লাভজনক হয়ে উঠবে? খামারি মাহমুদুল জানালেন, দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়েই তিনি বাজারজাত করেন। আর এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে পাচ্ছেন প্রয়োজনীয় সহযোগিতা। তবে সবকিছুর মধ্যে দুম্বা ও গাড়লই আমাদের দেশের জন্য বেশি লাভজনক বলে মনে করছেন তিনি। কারণ এদের তেমন অসুখ যেমন হয় না, খাবার নিয়েও এদের কোনো ঝামেলা নেই। বিরল প্রজাতির পশুসম্পদ দেশের খামারিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই এখন কাজ করছেন মাহমুদুল। বলছেন ভবিষ্যতে সিমেন ল্যাব দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার। আগামীতে এসব জাতের মানোন্নয়ন করে আরও বেশি বেশি আয়ের পথ সৃষ্টিতে কার্যকর গবেষণার দরকার মনে করছেন তিনি। দিনে দিনে দেশের পশুসম্পদ ক্ষেত্রের পরিধি বাড়ছে। বাড়ছে খামারির সংখ্যা। বহুমুখী লাভের কথা বিবেচনা করে এ খাতের উদ্যোক্তারা যুক্ত করছেন পৃথিবীর নানা বৈচিত্র্যের প্রাণী। আর তাতে মিলছে লাভ। এমন লাভের হিসাব মেলাতে গিয়ে সাফল্যের দৃষ্টান্ত গড়েছেন মাহমুদুল ইসলাম। একান্ত ইচ্ছা ও সুপরিকল্পিত উপায়ে কৃষি সব সময়ই লাভজনক। প্রাণিসম্পদ খাতে রয়েছে কর্মসংস্থানের অমিত সম্ভাবনা। সরকারি-অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এলে সুপরিকল্পিত উপায়ে এ খাত থেকে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব তেমনি সম্ভব দেশের যুবশক্তিকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর