রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেই তাণ্ডব নাচ যেন আর দেখতে না হয়

মাকিদ হায়দার

সেই তাণ্ডব নাচ যেন আর দেখতে না হয়

‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো ভাই

সবারে আমি প্রণাম করে যাই

ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি

রাখি না আর ঘরের দাবি’... রবিঠাকুরের এই কবিতাটির শেষ চরণে তিনি বলেছেন, ‘পড়েছে ডাক চলেছি আমি তাই’ যিনি ডেকেছেন, তার ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। কেননা কোরআন শরিফে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি যাদের প্রাণ দিয়েছি তাদের প্রত্যেকের মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ মৃত্যু অবধারিত জেনেই এ কবিতাটি রচনা করেছিলেন কবি এবং একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, এমনকি দ্বারের চাবি নিষ্প্রয়োজন। শেষের দিকে তিনি জানিয়েছেন প্রভাত হয়ে এসেছে, ঘরে বাতি নিভে গেছে, কেননা তার ডাক পড়েছে পরপারের, এমনকি শুনেও ছিলেন সেই ডাক। অনেক রাজনীতিবিদ কষ্টদায়ক সেই ডাক শুনেও না শোনার ভান যখন করেন তখনই সেই তিনি নিশ্চিত হন, সময় যখন ঘনিয়ে এসেছে তখন হাতে যেটুকু সময় আছে, এই সময়টুকুর মধ্যে এমনকি কিছু বাণী আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাই, যেন তারা কখনো কোনো দিন ভুলে যেতে না পারে আমাকে। তেমনি একটি মহান বাণী দিয়েছিলেন পলাতক দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানের লন্ডনে প্রদত্ত ৬/১/২০১৫ সালের মঙ্গলবারে যে বাণীটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক প্রথম আলোর লন্ডন প্রতিনিধির প্রেরিত সংবাদে। তাতে জনাব রহমান জানিয়েছিলেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ ছাড়া ঘরে ফেরা নয়।’ খবরটিতে বলা হয়েছিল, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করতে নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে তিনি নেতা-কর্মীদের ঘরে না ফেরার পরামর্শ দেন। পূর্ব লন্ডনের এট্রিয়াম হলে ৫ জানুয়ারি ‘গণহত্যা ও কালো দিবস’ শীর্ষক এক আলোচনায় এ আহ্বান জানান তিনি। গত বছরের (২০১৪) ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপি এ সভার আয়োজন করে। তারেক রহমান বলেন, ‘যখন খবর পাবেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন ঠিক তখনই রাজপথ ছাড়বেন।’

গতকাল বিএনপির ডাকা আন্দোলনে ঢাকাসহ সারা দেশে লাখ লাখ নেতা-কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বলে দাবি করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের নেতা-কর্মীরা রাস্তায়, তাদের গন্তব্য একটি। তা হচ্ছে দেশকে মুক্ত করা, গণতন্ত্রকে ফিরিয়া আনা।’ এ আন্দোলন থেমে গেলে দেশ এবং দেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বলে তিনি মন্তব্য করেন। আন্দোলনে নিরীহ মানুষের যাতে ক্ষতি না হয় সেদিকে সতর্ক থাকারও পরামর্শ দেন তিনি। এ সময় তিনি তরুণ প্রজন্মকে ফেসবুক বাদ দিয়ে দেশ রক্ষার আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। এ ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় এলে বেটার বাংলাদেশ বানানোর প্রতিশ্রুতিও দেন তিনি। সভায় সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী। সভা পরিচালনা করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমদ। এ ছাড়া গতকাল স্থানীয় সময় বেলা ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে যুক্তরাজ্য বিএনপির বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগও সেখানে ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্রের বিজয় দিবস পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। পুরো সংবাদটি পাঠান্তে আমার মনে হয়েছিল যিনি নেতা, তিনি তো তার নেতা-কর্মীদের উৎফুল্ল করার জন্য একবারের জন্য হলেও এসে উৎসাহিত করতে পারতেন, সুদূর লন্ডন শহরের অভিজাত এলাকায় বসবাস করে মাঝে মাঝে যে বাণী বিতরণ করবেন, সে কথা আমি যেমন জানি তার চেয়ে অধিক জানেন, তার দলের ব্যারিস্টার, ডাক্তার, সাংবাদিক, কবি এবং বিভিন্ন সময়ে দলবদলকারী, সুবিধাবাদী অবোধেরা। অবোধেরা বুঝতে পারলেন না, তার নিজের দল যতই ছোট হোক না কেন, ধরা যাক তিনি ছিলেন সেই দলের সভাপতি সিংহ। একদিন সেই সিংহ সভাপতি হয়ে গেলেন ইঁদুরের লেজ। হয়ে গেলেন চাটুকার। বিগত কয়েক বছরে অনেকগুলো ছোট ছোট দল তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে যুক্ত হয়ে বানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ১৪ দলের বিপরীতে ২০ দলের একটি জোট। সেই দলের এক নেতা নিজ নামের সামনে ডক্টরেট আরেকজন নেতা বড় বড় দুটি গোঁফ ঝুলিয়ে আরেক নেতার দল না থাকলেও তিনি ছিলেন স্বনামধন্য ডাক্তার। তাকে একদিন বিএনপি সম্মানের সঙ্গে দেশের রাষ্ট্রপতি বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পরে সেই রাষ্ট্রপতিকেই একদিন আমরা দেখলাম দৌড়ে রেললাইন পাড়ি দিচ্ছেন, তার পেছনে ছুটে আসছে বিএনপির তরুণ প্রজন্ম। যে প্রজন্মকে তারেক রহমান রাজপথে নামার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা আরও দেখলাম ২০-দলীয় জোট একদিন হয়ে গেল ঐক্যফ্রন্ট। যেমন হয়েছিল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের নেতা-কর্মীদের ভিতরেই ছিলেন মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অজস্র শিক্ষিত, বিশেষত তারা ছিলেন রাজনীতির ভাষায় অধিক শিক্ষিত। এবারের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো সমগ্র বাংলাদেশে- বিভিন্ন দলের বার্তা তখন শোনার পরে মনে হয়েছিল, এই বুঝি তারেক রহমানের সৈনিকরা থাকবেন রাজপথে। সেসব সৈনিকের জনাকয়েক সর্বদাই ব্যস্ত ছিলেন কখন তাদের সামনে টেলিভিশন, গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা এসে জানতে চাইবেন, আপনাদের পরবর্তী কর্মসূচি কী এবং রাজপথে নামবেন নাকি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেই কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করবেন? এই প্রশ্নের মিটিমিটি হাসি দিয়ে একজন ব্যারিস্টার নেতা, যিনি একাধিকবার দলবদল করেছেন। আবার পুরান দলে নতজানু হয়ে নত মাথায় প্রবেশ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, এভাবে গণতন্ত্রকে হত্যা করা যাবে না। প্রয়োজনে আমরা বিদেশি দূতাবাসের প্রধানদের নিয়ে গিয়ে জানিয়ে আসব আমাদের অভিযোগ। গত বছরের জাতীয় নির্বাচনের পরে তাদের দুজনকে বিশেষত একজন নামকরা ব্যারিস্টার সাহেব, ঐক্যফ্রন্টের নেতা, কখনো সাংবাদিকদের বলছেন ‘খামোশ’ পুলিশ প্রশাসনকে বলছেন ‘জানোয়ার’ অথচ একদা তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, জাতির পিতার অতি নিকটজন। ব্যারিস্টারের ওই অমোঘ বাণী শোনার কয়েকদিন পরে আমি একজন মানসিক রোগের চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মানুষ কখন সাংবাদিকদের খামোশ ও পুলিশবাহিনীকে জানোয়ার বলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানালেন, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক ভেইন ঝিমিয়ে যায়; যার ফলে খামোশ এবং জানোয়ার জাতীয় শব্দ আমরা শুনতে পেয়েছিলাম উক্ত ব্যারিস্টারের কাছ থেকে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সোমবার সারা দেশে অবরোধ শুরু করেছিল বিএনপি। সেই ৫ জানুয়ারি, ২০১৫ থেকে একটানা ১০ দিন অবরোধের মাঝে ১১ জানুয়ারি, ২০১৫ তারিখের রবিবারে গৃহবন্দী হলেন বেগম খালেদা জিয়া। সঙ্গে জনাকয়েক পুলিশ হয়েছিলেন আহত। ১২, ১৩, ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আহত-নিহত, গাড়ি পোড়ানো পেট্রোল দিয়ে ১৫ তারিখে বিএনপি হরতাল দিল। তবে ঢিলেঢালা এবং হরতাল মোটামুটিভাবে চলতে চলতে ৩০/১/১৫ তারিখে শুক্রবার জাতি জানতে পারল আগামী ১/২/১৫ ফেব্রুয়ারি মাসের রবিবার থেকে ৭২ ঘণ্টার হরতাল দিয়েছে জাতীয়তাবাদী দল। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দলের মান্যবর নেতারা কেউ কি জানতেন না, ২/২/১৫ তারিখ সোমবার থেকে সমগ্র বাংলাদেশে মাধ্যমিক পরীক্ষা? নিশ্চয়ই জানতেন না, জানলে কীই-বা হতো। যেহেতু লন্ডন থেকে নির্দেশ এসেছিল আগে হরতাল, অবরোধ, গাড়ি পোড়ানো, মানুষকে বাসে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারা। সরকার খালেদা জিয়ার গুলশানের অফিস ভবনের গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। তার পরও বিএনপি হরতাল-অবরোধে ৫/১/১৫ থেকে ৪/২/১৫ তারিখে সমগ্র বাংলাদেশে ৫৮ জন নিহত হয়েছিলেন। এমনকি কুমিল্লায় আটজন নিহত হয়েছিলেন পেট্রোলবোমায়। তার পরও মৃদুলয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবরোধ দিয়েছিল জাতীয়াতাবাদী দল। কিন্তু কোনো সুফল পায়নি বরং পেয়েছিল মানুষের কাছ থেকে ধিক্কার। সেটি ছিল ব্যর্থতার ধিক্কার। বিবিসি খবর দিয়েছিল ২৩ জনের মৃত্যুর। ইতিমধ্যে পাঁচ বছর পার হয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ তারিখের রবিবার দেখলাম ঐক্যফ্রন্টের বড় বড় নেতার ভরাডুবি। এমনকি জাতীয়তাবাদী দলেরও সাংসদ প্রার্থী প্রায় ১৫০ জনের জামানত বাতিলের দুঃখজনক ঘটনা। আরও দুঃখজনক বলে আমার কাছে যা মনে হয়েছে তা হলো ঐক্যফ্রন্টের প্রধান, তিনি নাকি জানতেন না, জামায়াতে ইসলামী ঐক্যফ্রন্টের অংশ হয়ে নির্বাচন করবে। ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে জামায়াত নির্বাচন করবে জানলে ঐক্যফ্রন্ট-প্রধান নাকি কিছুতেই আসতেন না ২০-দলীয় বিএনপি কিংবা ঐক্যফ্রন্টের উদ্ধারকর্মী হয়ে! গত বছরের ভোট নিয়ে পৃথিবীর বড় দেশ চীন, রাশিয়া, ভারত সুচারু বক্তব্য দিলেও ঐক্যফ্রন্ট নেতা এক গোঁ ধরে আছেন, পুনর্নির্বাচন দিতে হবে। জয়ী দল আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে মন্ত্রীদের শপথ শেষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে এবং ৪৭ জন নতুন মন্ত্রীর ভিতরে আছেন উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী- তাদের মন্ত্রণালয় বুঝিয়ে দেওয়ার পরও ঐক্যফ্রন্টের দাবি পুনর্নির্বাচন! কৈশোরে যখন আমাদের দোহারপাড়ার মাঠে ঘুড়ি ওড়াতাম কাচের গুঁড়োর মাঞ্জা দেওয়া সুতো দিয়ে সেই সাধের ঘুড়িকে যখন আবদুল কায়েস ঘনা, আমারই চাচার ছেলে তার ঘুড়ি দিয়ে প্যাঁচ খেলে কেটে দিল তখন দেখলাম আমার এক আনা দামের ঘুড়ি বাতাসে ভাসতে ভাসতে চলে গেল পাবনা শহরের দিকে। আরিফপুর দোহারপাড়া রাঘবপুর মিলিয়ে একটি ফুটবল দল [আদোরা ক্লাব] বানিয়েছিলেন খন্দকার গোলাম মোস্তফা মোগল, তিনি আমাদের ফুটবল, হা-ডু-ডু খেলায় উৎসাহ দিতেন। সেই তিনি আমার কেটে যাওয়া ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, কেটে যাওয়া ঘুড়ি আর কোনো দিন ধরা যাবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি তথা ২০ দল তথা ঐক্যফ্রন্টের মহান ব্যক্তিদের ওই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। আমি মনে করি কেটে যাওয়া ঘুড়ি ধরা যায় না, সেই ঘুড়ি ধরে অন্য মহল্লার কিশোররা। অথবা বট-পাকুড়ের বাঁশঝাড়ের মাথায় আমৃত্যু আটকে থাকে শখের ঘুড়ি। তবে ঘুড়ি দিয়ে প্যাঁচ খেলতে গেলে যার সুতোয় কাচের গুঁড়োর মাঞ্জা দেওয়া না থাকে, তার ঘুড়ি কাটবেই প্রতিপক্ষের কাচের গুঁড়োর মাঞ্জা দেওয়ার সুতোর ধারে। ভারতীয় পুরাণমতে, তাণ্ডব হচ্ছে ‘তণ্ডু’ নামক জনৈক মুনি প্রবর্তিত নৃত্য। পৌরাণিকমতে, শিব নাকি তাণ্ডব নাচে পারদর্শী। সেই তাণ্ডব নাচ যেন আর দেখতে না হয়। একটি ইহুদি প্রবাদ বলা যেতে পারে। হতাশাবাদীর সামনে দুটি সুযোগ। সে মৃত্যুই বেছে নেয়। 

            লেখক : কবি।

সর্বশেষ খবর