বৃহস্পতিবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমাদের ভাষা আমাদের গর্ব

ড. মুহম্মদ মনিরুল হক

বাংলা ভাষায় রচিত আমাদের জাতীয় সংগীত পৃথিবীর মধুরতম সংগীতের একটি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সামনে রেখে বিশ্বের ৪৯টি ভাষায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত প্রকাশ করেছে বেলারুশের একটি প্রকাশনী সংস্থা। অতিসম্প্রতি ইউনেস্কোর জরিপে পৃথিবীর মধুরতম ভাষারও স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা। বাংলা ভাষায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ইউনেস্কোর ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা বাংলা। মাতৃভাষার দিক থেকে চতুর্থ এবং জনসংখ্যার বিচারে এ ভাষা সপ্তম অবস্থানে। বাংলাভাষী মানুষের প্রধান আবাসভূমি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা হলেও উড়িষ্যা, আসাম, বিহারসহ আরও কয়েকটি প্রদেশের মানুষ বাংলা ভাষার চর্চা করে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াা, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশে অসংখ্য বাংলাভাষী মানুষ বাস করে। এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, কানাডাসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশ হচ্ছে। বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে বিশে^র বিভিন্ন রাষ্ট্রের টেলিভিশন ও বেতারে। ইউরোপ-আফ্রিকাসহ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করছেন বাংলাদেশের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ফলে সেখানেও বাংলা ভাষা চর্চা হচ্ছে নানাভাবে। সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আশা করা যায়, জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে শিগগিরই বাংলা স্বীকৃতি পাবে। অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রবাসী, প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন ও পরিবেশগত প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের মূর্খ, অর্ধশিক্ষিত, শিক্ষিত সব শ্রেণিকেই প্রতিনিয়ত নতুন শব্দের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ফলে ভাব প্রকাশের জন্য তৈরি হচ্ছে নতুন বাক্য। মৌখিকভাবে প্রয়োগে এসব শব্দ-বাক্যের যোগ্যতাহানি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও লিখিতরূপে এগুলোর প্রয়োগে ভাষার ব্যাকরণ বা নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা থাকছে না। উপরন্তু ব্যাকরণবিদ বা ভাষাবিজ্ঞানীরাও এসব নিয়মনীতির বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করছেন না। তাই, নিয়মানুসারে শব্দশৈলীর ন্যূনতম বিধিও অক্ষুণœ থাকছে না। প্রচারমাধ্যম বা নেটওয়ার্কের আওতায় অন্তর্ভুক্ত মানুষগুলোর ইংলিশ-বাংলিশ ব্যবহার চোখে পড়ছে খুব বেশি। খুব দ্রুত মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ‘বাংলিশ’, ‘লাভিজ’, ‘ফাউদিস’ জাতীয় শব্দের ব্যবহার চলছে অহরহ। ফেসবুক, টুইটার ও প্রযুক্তিগত অন্যান্য বার্তায় উদ্ভট শব্দের ব্যবহার অত্যধিক। সাম্প্রতিক উদীয়মান কিছু লেখকের  প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাস পড়ে মনে হয়, বাংলায় যথাযথ অনুশব্দ-প্রতিশব্দের দীনতায় তারা ভাষার লিপ্যন্তরীকরণ করছেন বা ইংরেজি শব্দ বাংলায় বসিয়ে দিচ্ছেন। বাংলা-ইংরেজিমিশ্রিত পঙ্ক্তিই যেন তাদের ভাবপ্রকাশের অতি যোগ্য মানদন্ড। এমনকি বিশ^বিদ্যালয়, বিভাগ, চলচ্চিত্র-নাটক, গল্প-উপন্যাস, কবিতা-কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ-সংকলন, সাময়িকীর শিরোনামও লেখা হচ্ছে প্রতিবর্ণীকৃতভাবে।

এ কথাও স্বীকার্য যে, ভাষা একটা চলন্ত ব্যাপার। ইতিহাস, সভ্যতা, সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য কিংবা রাজনীতির মতো ভাষাও তার নির্দিষ্ট গতিপথে চলে। তাতে জোর খাটানো চলে না। সর্বজনশ্রদ্ধেয় আনিসুজ্জামানের ভাষায়, ‘এমনিভাবে বাংলা ভাষাও একদিন স্বতন্ত্র চেহারায় দেখা দিল প্রায় বারো-তেরো শ বছর আগে।’ বর্তমানে বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানেই শব্দ সংখ্যা ৭৩ হাজার ২৭৯টি। রয়েছে শব্দগুলোর অভিধানও। বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানে শব্দের সংখ্যা প্রায় সোয়া লাখ। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে আধুনিক বাংলা অভিধান। বর্তমানে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডারও অনেক সমৃদ্ধ। বাংলা একাডেমির অভিধানই আছে ২৪টির বেশি। রয়েছে বাংলা ভাষাবিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থ। কিন্তু অভিধানে উল্লিখিত ও প্রচলিত উপযোগী শব্দ বাদ দিয়ে প্রয়োগ হচ্ছে নতুন শব্দ-বাক্যের। এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাপ্রীতি বা বাংলার জন্য নিষ্ঠা এমনকি ভাষান্তরের কোনো প্রয়োজনীয়তাও অনেককে স্পর্শ করছে না। উপরন্তু প্রতিবর্ণীকৃত শব্দের সঙ্গে বাংলার ‘ই’, ‘ঈ’ ‘উ’ কার বসিয়ে যত্রতত্র পরিবর্তন করা হচ্ছে শব্দের উচ্চারণ। ফলে ব্যত্যয় ঘটছে অর্থেরÑ একই শব্দের বিভিন্নরূপ প্রয়োগ ঘটছে মাত্রাতিরিক্ত। নিয়মনীতির বাইরে তৈরি হচ্ছে নতুন শব্দ-বাক্য; যার অধিকাংশই ঘটছে বাংলা+ইংরেজি ও ইংরেজি+ বাংলা শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলোও অনেক সময়ে বোঝা কঠিন।

একটি ভাষার অভিভাবক বিবেচনা করা হয় কবি ও সৃষ্টিশীল লেখকদের। ধারণা হয়, সমাজজীবনের প্রাত্যহিক ব্যবহার্য ভাষার চেয়ে কবি-সাহিত্যিকের ভাষা-শব্দ অধিক যত্নে বুনিত। কবি-লেখকের ভাষা ও শব্দের প্রতি অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট থাকে পাঠক। বাংলা ভাষায় যেমন বিভিন্ন ভাষার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে তেমনি এ দেশের শিল্প-সাহিত্যের ভাষাও সাধারণ মানুষের ভাষার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে এবং করে চলেছে। সাধারণ পাঠক অনেক সময় অভিধানের মতো নির্ভর করেন শিল্পী-সাহিত্যিকের ভাষা ও রচনাশৈলীর ওপর। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব কারণেও সংবাদপত্র বা শিল্পী-সাহিত্যিকরা অধিক দায়বদ্ধ থাকেন ভাষার বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে। একসময়, বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ ঢোকানোর প্রবণতা যেমন একটা বিশেষ গোষ্ঠীর ছিল, তেমনি আরবি, ফারসি শব্দ ঢোকানোর প্রবণতাও অন্য গোষ্ঠীর ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ বিশেষ করে ইংরেজি শব্দ-বাক্য ঢোকানোর প্রবণতাকে সে ধারায় ব্যাখ্যা করা সমীচীন হবে না। বরং এ প্রবণতাকে বাংলা ভাষার শব্দভা-ারের প্রতি উদাসীনতা বা বাংলা ভাষা ও দেশের প্রতি নিষ্ঠাহীনতা বলাটাই অধিক শ্রেয়।

লেখক : জেন্ডার, স্থানীয় সরকার ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর