শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সফল সিরাজুল

শাইখ সিরাজ

সফল সিরাজুল

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া হিসাবমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার; যা আগের বছরের চেয়ে ৮৭ হাজার বেশি। দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মঠ মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখ, যার বড় একটি অংশ পুরোপুরি বেকার। বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ছে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বেকারত্ব দূর করার কোনো বিকল্প নেই। যে করেই হোক বেকারত্ব দূর করতে হবে। দেশে বেকারত্বের মূল কারণগুলো কী গবেষকরা বা বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। তবে গত মাসে (জানুয়ারিতে) যশোরের চৌগাছার ফকিরাবাদ গ্রামের এক তরুণের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, বেকারত্বের অন্যতম কারণ আমাদের অধিকাংশ তরুণের উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস কম। সাহস করে পরিকল্পনামাফিক দৃঢ়চিত্তে উদ্যোগ নিতে পারলে সফলতা আসবেই। আর এরই প্রমাণ তরুণ সিরাজুল ইসলাম। বয়স আর কত হবে! ত্রিশের বেশি হবে না। পড়াশোনা খুব একটা করা হয়নি, তাই নেই কোনো শিক্ষা সনদ। বাবার কাছ থেকে কোনো সম্পত্তিও পাননি। নেই এক শতাংশ নিজস্ব জমি। এমনকি মামা-চাচার খুঁটির জোরও নেই। কিন্তু নিজস্ব উদ্যোগে, শ্রমে-ঘামে তৈরি করে নিয়েছেন আয়-রোজগারের পথ। প্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের সফল সিরাজুলের গল্পই শোনাব। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে গত মাসে সফল কুলচাষি হারুন-অর-রশীদের গল্প বলেছিলাম। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে বিশেষ প্রতিবেদনও প্রচারিত হয় হারুনের কৃষি উদ্যোগ নিয়ে। নিজের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে মাত্র সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে বাউকুল চাষ করে পেয়েছেন দারুণ সাফল্য। সিরাজুলের গল্প অনেকটা সে রকমই। মাঘের মাঝামাঝি যখন সিরাজুলের কুলের বাগানটিতে পৌঁছাই তখন মধ্যদুপুর। আমাদের আসার খবর শুনে সামনের রাস্তায় ভিড় করে আছেন শতাধিক কৃষক আর আশপাশের লোকজন। কথা হলো তাদের সঙ্গে। কথা বলে বুঝতে চেষ্টা করলাম সেখানকার কৃষির কী অবস্থা, কৃষি নিয়ে কী ভাবছেন তারা। বাংলাদেশের কৃষি পাল্টে গেছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের কৃষিতে এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। মাটি থেকে বিচিত্র ফসল ফলিয়ে আনছেন এখানকার কৃষক। শুধু ধান বা পাট নয়, শিম, কপি, মুলা, গাজর, লাউ, ঢেঁড়স, বেগুন থেকে শুরু করে নানান শাক-সবজি তো আছেই, আছে রংবেরঙের ফুলের চাষ। আর ফল তো এ অঞ্চলের লাভজনক অর্থকরী ফসল। মাল্টা, পেয়ারা, লেবু, কমলা থেকে আম, কুল কী নেই! কৃষকরা বললেন, খুব ভালো আছেন তারা। বাজার বুঝে, চাহিদা দেখে হিসাব করে ফল-ফসল চাষ করেন। ফলে লোকসানের সম্ভাবনা থাকে কম। আর নতুন সব কৃষি সম্পর্কে জানার জন্য টেলিভিশনের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অনলাইনেও খোঁজখবর রাখেন তারা। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে মন ভরে উঠল। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এসব উদ্যোগী কৃষকের হাত ধরেই। যাই হোক, বলছিলাম কুলচাষি সিরাজুলের কথা। সিরাজুলের বাগানটি ছেয়ে আছে লালচে রঙের আপেলের মতো কুলে। ১০ মাস বয়সি ছোট্ট একেকটি কুল গাছে অসংখ্য লালচে রঙের কুল ধরে আছে। দেখলে মনে হয় কুল নয়, লালচে আপেল ধরে আছে গাছে গাছে। গাছে পাতার চেয়ে ফলই যেন বেশি। সিরাজুল ইসলাম ৪ বিঘা জমিতে চাষ করেছেন কাশ্মীরি আপেলকুল। নতুন এ জাতের কুল চাষ এবারই তার প্রথম। কুলের ফলন দেখে বেড়েছে তার স্বপ্নের পরিধি। প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ৬০ কেজি করে ফল পাওয়ার আশা করছেন তিনি। ফলন বলছে তার এ প্রত্যাশা মোটেও অমূলক নয়। বরং আরও বেশি পরিমাণের ফল তিনি পেতে পারেন। ফলগুলো তখনো পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি। এর ভিতর থেকে বেছে সবচেয়ে বড় একটি কুল সিরাজুল আমাকে দিলেন। মুখে দিলাম, স্বাদ কোনো অংশেই আপেলের চেয়ে কম নয়। কথা বললাম সিরাজুলের সঙ্গে। জানতে চাইলাম, ‘এই কুলের সন্ধান আপনি কোথায় পেলেন?’ তিনি উত্তরে জানালেন, ‘ফেসবুকে একজনের এক পোস্টে প্রথম কাশ্মীরি আপেলকুলের ছবি দেখি বছর দুয়েক আগে। এর পর থেকেই আমি খুঁজতে থাকি। গত বছর এক নার্সারিকে বলি যে আমার এই কুলের চারা লাগবে। তারা আমাকে চারা এনে দেন।’

সিরাজুলের কাছ থেকে আরও জানলাম, এই ৪ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন তিনি। লিজ নিতে বিঘাপ্রতি খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। একেকটি কুল গাছ রোপণ করেছেন ৯ ফিট দূরত্বে। ৪ বিঘা জমিতে মোট রোপণ করেছেন ৬০০ চারা। প্রতিটি চারা কিনেছেন ৬০ টাকা দরে। এ হিসাবে তার প্রাথমিক বিনিয়োগ জমিতে ৪০ হাজার টাকা। আর চারায় ৩৬ হাজার টাকা। সব মিলে এই ১০ মাসে এ বাগানে বিনিয়োগ ২ লাখের বেশি হবে না। গেল তো বিনিয়োগের হিসাব, এবার তার কাছে জানতে চাই কী পরিমাণ লাভের আশা তিনি করছেন। লাভের হিসাবটাও তার কাছে সহজ, একেবারে গোছানো।

বললেন, ‘প্রতিটি গাছ থেকে গড়ে আশা করছি ৬০ কেজি করে ফল পাব। ৬০০ গাছ থেকে মোট ৩৬ হাজার কেজি ফল আশা করতেই পারি। নতুন ফল হিসেবে কমপক্ষে ১০০ টাকা কেজি হিসাবে বাজার পেলেও আমার হিসাবে ৩৬ লাখ টাকা পাওয়ার কথা।’ শুনে অবাক যেমন হলাম, আনন্দও তেমন পেলাম। গ্রামের এক তরুণ কৃষি-বাণিজ্যের বিষয়টি বেশ বুঝে গেছে। কৃষির সঙ্গে প্রাণ মেশালে সেখান থেকে লাভ আসবেইÑ এ সত্যই আবার প্রমাণ করলেন সিরাজুল। বাগানটির সামনে রাস্তার ওপাশেই সিরাজুলের ১০ বিঘা জমির পেয়ারাবাগান। এটাও তার লিজ নেওয়া। এখান থেকেও সব খরচ বাদ দিলে লাখ পনেরোর মতো টাকা থাকবে। এই তরুণের উদ্যোগ দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণে কৃষিতে বিনিয়োগ হতে পারে লাভজনক এক ক্ষেত্র।

শুধু উচ্চমূল্যের কথা চিন্তা করেই নয়, সুস্বাদু রঙিন ও বৈচিত্র্যময় ফল-ফসল আবাদের উদ্যোগ গ্রহণের প্রশ্নে বাংলাদেশের শৌখিন চাষি থেকে বড় চাষি তারপর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে বড় উদ্যোক্তা সকল পর্যায়েই দারুণ আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখেছি দেশে বাউকুল, থাইকুল, আপেলকুল, থাই পেয়ারা এবং সর্বশেষ ড্রাগন, স্ট্রবেরি, মাল্টা, অ্যাভোকাডো আবাদের সম্প্রসারণ। কৃষক পর্যায়ে অর্থ, সময়, প্রযুক্তি সব বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে এসব ফলের আবাদ করে অনেকেই সফল। তবে বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছেন। মৌসুমি ফলচাষিরা তাদের পণ্য বাজারজাত করতে না পারায় দুর্ভোগের শিকার হতে হয়Ñ এমন খবরও আমরা জানি। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি ভরা মৌসুম শুরুর আগেই, এলসির মাধ্যমে ওই ফলই আমদানি করতে। সেখানে অসম বাজার প্রতিযোগিতায় কৃষক বার বার পরাজিত হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তনের তাগিদেই দেশীয় ফল-ফসল উৎপাদনের মৌসুমকে হিসাবে রেখে সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। কৃষক ও উদ্যোক্তার সাহসী উদ্যোগকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে বাজারকে আরও অনুকূল করা দরকার। এমন ভাবনায় নতুন ফল কাশ্মীরি আপেলকুলের বাণিজ্যিক দিকেও আগেভাগে সংশ্লিষ্টরা নজর দেবেনÑ এই প্রত্যাশা।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর