সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নির্বাচন নিয়ে কথা কম বলাই মঙ্গল

মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

নির্বাচন নিয়ে কথা কম বলাই মঙ্গল

একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সবাই যত কথা কম বলবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে বলে আমার ধারণা। বলা হচ্ছে, ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই হয়নি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ভোট কেন্দ্রে গিয়ে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসারের যোগসাজশে ৪০ ভাগ ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালট বাক্সে ভরা হয়েছে।  নির্বাচনের দিন কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মী ও ভোটারদের কোনো প্রকার পরিচিতি বা প্রতীক বা ব্যাজ লাগাতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ বিএনপির নেতা-কর্মীদের যেখানেই পেয়েছে সেখান থেকেই গ্রেফতার করে। একজন প্রার্থী হওয়ার পরেও আমাকে নির্বাচনে প্রচারণা করতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ শুধু আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহারই করেনি, আমাকে ও আমার ছেলেকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে এবং আমার স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তার সামনে থেকে বিএনপির নেতাদের ধরে নিয়ে গেছে, তাকেও পুলিশ গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছে।

কিন্তু আমার এ কথাগুলো একমাত্র বিএনপি ছাড়া আর কে শুনবে বা কেইবা বিশ্বাস করবে? তাছাড়া আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যেখানে সারা বিশ্ব বলছে একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে সেখানে আমার মতো একটি চুনোপুঁটি প্রার্থী যার কোনো পদ নেই, পদবি নেই, এমনকি দলের সাধারণ সদস্যপদও নেই তেমন একজনের কথা শুনতে কারই বা সময় আছে। আবার যদি আমাকে ও আমার ছেলেকে পুলিশের পেটানোর কথা বলি তাহলে অনেকে শুনিয়ে দেবে যে দেশের সেনাবাহিনীর কতিপয় অফিসার রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতার স্থপতি এবং জাতির পিতাকে নিষ্পাপ শিশু ও নারীসহ সপরিবারে হত্যা করতে পারে,  যে দেশের সেনা সদস্য অফিসাররা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করতে পারে, যে দেশের পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় বিরোধী দলের নেত্রীর সভায় গ্রেনেড হামলা হতে পারে, যেখানে আমার এলাকার বিশিষ্ট মহিলা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আইভি রহমানের মতো নেত্রীকে প্রাণ দিতে হয়, যে দেশে সীমান্তরক্ষীরা তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসার ও পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে, সেখানে আমার মতো এক নাদানকে স্ত্রী-পুত্রসহ হত্যা যে করা হয়নি তা আমার পূর্ব পুরুষদের নেক কাজের কারণেই হয়তো। তাই একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। সারা বিশ্ব নির্বাচন মেনে নিয়েছে। দেশের তাবৎ প্রশাসন, পুলিশ, আদালত, সশস্ত্র বাহিনী, প্রায় সমগ্র সংবাদ মাধ্যম, ব্যবসায়ী মহল, শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, সুশীল সমাজ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, নারী, পুরুষ এবং প্রায় তাবৎ জনগণ একাদশ সংসদ নির্বাচন মেনে নিয়েছে। এমনকি বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রায় সব নেতা-কর্মী নির্বাচন মেনে নিয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২৮৯ জন প্রার্থীসহ যারা নির্বাচনে হেরেছে তারাও প্রায় সবাই একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল দৃশ্যত মেনে নিয়েছে। আমার স্ত্রী ও পুত্রসহ যারা সবাই আমার নির্বাচনে মাঠে-ময়দানে কাজ করেছে তারাও ১০০ ভাগ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে বলছে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের সামনে নাকি আর কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাকে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে চুপ হয়ে যেতে উপদেশ দিচ্ছে। তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরা প্রায় সবাই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছি। হ্যাঁ, তবে এবারের নির্বাচনে যারা মনোনয়ন পায়নি বা দলের যেসব নেতা-কর্মী মাঠে ময়দানে তেমন সক্রিয় হয়ে নির্বাচনে কাজ করেনি বা নীরব থেকেছে এবং যারা দলের বিভিন্ন পদ-পদবিতে আছে তাদের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা তাদের কায়েমী স্বার্থে নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারে না এবং পারবেও না, উল্টো উসকানি দেবে- যদিও কিছু করার কোনো মুরোদও তাদের নেই এবং জনগণও তাদের কথার কোনো মূল্য দেয় না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেউই মন থেকে মেনে নেয়নি, নিতে পারেও না। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মন থেকে মেনে নিয়েছেন কিনা তা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন আছে, যদিও এ নির্বাচনের ১০০ ভাগ সুবিধাভোগী তিনি। কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো, সমসাময়িক প্রেক্ষাপট, বিশ্ব রাজনীতির নেতৃত্বের সংঘাত, ভৌগোলিক আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের নগ্ন প্রতিযোগিতার যৌথ সমঝোতার বহিঃপ্রকাশ একাদশ সংসদ নির্বাচন। তাই নির্বাচনের চরম বিতর্কিত ফলাফল মেনে নেওয়া ছাড়া জাতি এবং জনগণের সামনে আপাতত কোনো বিকল্প নেই। আঞ্চলিক ক্ষমতার পূর্ণ ভারসাম্য নিশ্চিত ও নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হলে ক্ষমতায় শেখ হাসিনাকে থাকতেই হবে। ক্ষমতার পালাবদলে এ মুহূর্তে জনগণ তেমন কোনো নিয়ামক নয়। ক্ষমতায় থাকা না থাকা এখন নির্ভর করছে মূলত আঞ্চলিক মোগলদের প্রয়োজনীয়তার ওপর। তাছাড়া সরকারবিরোধী শিবিরে ক্ষমতার হাল ধরার মতো বিকল্প কোনো নেতানেত্রী দৃশ্যমান নয়, যা ক্ষমতার পালাবদলে একটি বিশাল এবং অতি জরুরি আবশ্যকীয় ফ্যাক্টর। অথচ বিরোধীপক্ষে এ মুহূর্তে সে ধরনের কোনো নেতা নেই বললেই চলে। ফলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিদেশি শক্তি তাদের কায়েমী স্বার্থ আদায় করার বিকল্প কোনো পক্ষ না পেয়ে তাদের স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য বিগত নির্বাচনে যা করার দরকার ছিল তাই তারা করেছে এবং নির্বাচনকে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এখন যা যা করা দরকার তাও তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাচ্ছে। বিগত আমলে বিএনপির অতিমাত্রায় তাইওয়ান ও থাইল্যান্ড প্রীতি ও নীতির কারণে চীন যেমন আমাদের নেতৃদ্বয়ের বিরোধী তেমনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের প্রতি অতিমাত্রায় প্রীতি এবং ভারতের জাতীয় নেতাদের সঙ্গে কৌশলহীন রাজনৈতিক বৈরিতার কারণেও ভারত আমাদের বিশ্বাস করে না। তাই যেখানে দুই আঞ্চলিক পরাশক্তি প্রকাশ্যেই আমাদের বিপক্ষে সেখানে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের স্বার্থের বিপক্ষে ক্ষমতার পালাবদল হবে তা আশা করা দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকারই শামিল বৈকি। বাংলাদেশ একটি মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রকে প্রতিবেশী হিন্দু ও বৌদ্ধপ্রধান রাষ্ট্রের পাশে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাস্তবতার আলোকে টিকে থাকতে হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে আমাদের দেশে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা অলিক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। অন্য মুসলমান রাষ্ট্রগুলো থেকে ভৌগোলিকভাবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি মুসলমানপ্রধান জনগোষ্ঠী ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ভাবনায় ভুগলে সেটি যে তার নিরাপত্তার প্রতি অব্যাহত হুমকি তা যে দল বা তার নেতারা উপলব্ধি করতে পারে না, তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হয় না তা আমাদের কাছে ইতিহাসেই প্রমাণ রয়েছে। সমসাময়িক ভৌগোলিক রাজনীতির মোদ্দা কথা হলো- জনগণ কী চায় তা বিবেচ্য বিষয় নয়, চীন ভারত কী চায় তা-ই হবে আমাদের রাজনীতির মূল স্রোত। যে রাজনৈতিক পক্ষ চীন ভারতের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে বাংলার মসনদে তাকেই বসতে দেওয়া হবে। নির্বাচনের গণতান্ত্রিক ধারার মাধ্যমে এ রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে মুক্তির পথ যারা খুঁজছে তারা ভুল পথেই হাঁটবে। দলের একটি পদের জন্য যেমন আমাকে নেতানেত্রীর কৃপার জন্য সদাসর্বদা ভিক্ষা করে বেড়াতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কেরাও তথাকথিত নির্বাচনে বিজয়ের কৃপা পেয়েও সরকারে যেতে পারে না, তেমনি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েও আঞ্চলিক মোড়লদের কৃপা ছাড়া মসনদে বসতে পারবে না। গণতন্ত্র বা নির্বাচন নয়, উন্নয়নের রাজনীতি হবে রাজনীতির নিয়ামক যা নতশিরে মেনে নিতে হবে দেশের মধ্যে সবাইকে। না হলে আমার ভাগ্যের যে পরিণতি হবে, সরকারি কর্তা ও রাজনৈতিক চাঁইদেরও একই অবস্থা হবে। কারণ হুকুম, মনোনয়ন, নিযুক্তি সব হবে গায়েবি এবং আসবে সীমান্তের বাইরে থেকে।

আমি বিপ্লবী নই। নই রোমান্টিক হিরো। রাজপথে বা গুলিতে বা ফাঁসিতে মরার বয়স আমার চলে গেছে। এখন হাসপাতালে বা ঘরে বা বড়জোর চলন্ত অ্যাম্বুলেন্সে মরতে চাই। মরতে চাই হার্ট অ্যাটাকে বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে বা অনেক ভাগ্য হলে বয়স্কজনিত কারণে বা বার্ধক্যে। তাই সব কিছু মেনে নিয়েছি। মেনে নিয়েছি একাদশ সংসদের নির্বাচন, মেনে নিয়েছি ফলাফল, মেনে নিয়েছি তাবৎ পত্রপত্রিকা টেলিভিশনের সাংবাদিকদের বধিরতা, মেনে নিয়েছি অর্থবিত্ত বা পদ-পদবির কাছে মাথানত করার হীন প্রয়াস, মেনে নিয়েছি টকশোর ভ্রষ্টাচারদের প্রতিরাতের মানসিক ধর্ষণ, মেনে নিয়েছি পুলিশ, প্রশাসন, আদালতের আইনের অপপ্রয়োগ ও নির্লজ্জ অপব্যবহার, মেনে নিয়েছি আমাদের ত্যাগী দেশপ্রেমিকদের লাগামহীন ভোগবিলাসের নগ্ন লিপ্সা, মেনে নিয়েছি সুশীল সমাজের ক্ষমাহীন নির্লিপ্ততা। সবচেয়ে বেশি মেনে নিয়েছি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী তথা রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমার অযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেউলিয়াত্ব ও নিষ্ক্রিয়তা। কিন্তু তারপরেও কেন জানি ভয় হচ্ছে আমার বা আমাদের অনেকের হয়তো কাক্সিক্ষত মৃত্যু হবে না!! যতই নিজেদের রক্ষা করার জন্য আপস করার চেষ্টা করছি ততই নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি। কেন জানি মনে হচ্ছে সবাই সব কিছু মাথা নিচু করে মেনে হয়তো নেবে না। আমি মেনে নিলেও সবাই হয়তো তাদের জোর করে শাসন করার অধিকার মেনে না-ও নিতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস সবাই মেনে নেবে না। নিতে পারে না। সময় কথা বলবে।  আমার মধ্যেও হয়তো হঠাৎ করে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর বাসনা জেগে উঠতে পারে। তাই ভয় হয়!!!

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর