মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নাম : দেশি বনাম বিদেশি ভাষা

অর্ক কিরণ

আমি যখন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র তখন আমার এক সহপাঠী প্রায় দুই বছর একসঙ্গে পড়ার পর একদিন অকস্মাৎ আমাকে মুসলমান হিসেবে আবিষ্কার করে আশ্চর্যান্বিত হলো। তাকে প্রশ্ন করে জানলাম, গত দুই বছর যাবৎ সে আমাকে হিন্দু হিসেবে জানত এবং তার এই ভুল ধারণা জন্মানোর জন্য দায়ী আমার মাতৃভাষায় রাখা নাম, যে ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা আন্দোলন করেছি, প্রাণ দিয়েছি। সত্যিই কী অদ্ভুত মানসিকতা আমাদের! সারা বিশ্বের সব কটি দেশেই বেশির ভাগ মানুষই যেখানে তাদের নামকরণ মাতৃভাষায় (এখানে নাম বলতে আমি Certificated Name-কেই বোঝাচ্ছি) করে; যা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। সেখানে এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশি বাঙালিদের বেলায় অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার কারণে আমরা গর্ববোধ করি, অথচ সেই ভাষাতেই নামকরণের মাধ্যমে নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ি।

দ্বাদশ শ্রেণির সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমার জীবনে একবার নয় বহুবার হয়েছে। শুধু আমার নয়, আমার সন্তানদের বেলায়ও হয়েছে যেহেতু তাদের নাম মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষায়। আমার বাবা-মাকে অনেকেই দোষারোপ করেন সন্তানের বাংলা নাম নয়, ‘হিন্দু নামকরণের’ অপরাধে। বাংলা নামকরণের অর্থ যদি হিন্দু নামকরণ হয় তবে বাংলা ভাষার নাম বদল করে রাখা উচিত ‘হিন্দু ভাষা’। সন্তানের নামকরণ মানুষ যে কোনো ভাষায় করতে পারে, এটা যার যার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা যেন আমাদের বেলায় একটু ভিন্ন। আমরা যারা বাংলাদেশি বাঙালি তারা বেশির ভাগই সন্তানের নামকরণ বিদেশি ভাষায় করি। যেমন আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজি ইত্যাদি এবং এসব ভাষায় নামকরণ করলে আমাদের কেউ দোষারোপ করে না, দোষারোপ করে শুধু বাংলা ভাষায় অর্থাৎ মাতৃভাষায় নামকরণ করলে। আহসান, শফিক, আলমগীর, সুইটি, বিউটি, ন্যানসি, মাইকেল, ইভান ইত্যাদি নামে কেউ কখনো আরবি, ইরানি, ইংরেজ বা খ্রিস্টান কিংবা রাশিয়ান হয়ে যান না। কিন্তু অর্ক, অনন্যা, প্রতীক, সায়ন, প্রজ্ঞা ইত্যাদি বাংলা শব্দ নামের জন্য বেছে নিলে আমরা বাঙালির বদলে ‘হিন্দু’ হয়ে যাই! মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই তাঁর মাতৃভাষা আরবি ছিল। তিনি যদি আরব দেশে জন্মগ্রহণ না করে ইংল্যান্ডে কিংবা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করতেন, তবে তাঁর মাতৃভাষা ইংরেজি কিংবা বাংলা হতো এবং তা হলে এই ইংরেজি কিংবা বাংলাই হয়ে যেত আমাদের ইসলামের ভাষা। কেউ যদি কোনো বিদেশি নাম (আমাদের দেশে বেশির ভাগ মুসলমান পিতা-মাতা আরবি ভাষায় সন্তানের নামকরণ করেন) শব্দগত বা অর্থগত কারণে পছন্দ করেন, তবে অবশ্যই তিনি সেই ভাষায় তার সন্তানের নামকরণ করতে পারেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেই যে তাকে বাধ্য হয়ে আরবি নাম (অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে নিজের নামের অর্থটুকুও অনেকেই জানেন না) রাখতে হবে এবং আরবি নামধারী হলেই যে তাকে মুসলমান হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, এ ধারণা ঠিক নয়। মিসর, সিরিয়া, লেবানন এসব দেশের নাগরিকের মাতৃভাষা আরবি এবং এদের নামকরণও আরবি ভাষায় করা হয় কিন্তু এদের অনেকেই ধর্মে খ্রিস্টান। উদাহরণস্বরূপ ইরাকের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারেক আজিজ, লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বশির জামাল ও তার ভাই আমির জামাল- এরা সবাই আরবি ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের নামকরণও হয়েছে আরবি ভাষায় অর্থাৎ মাতৃভাষায়। কিন্তু এদের কেউই মুসলমান নন, খ্রিস্টান। পক্ষান্তরে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, তুরস্ক, আমাদের বাংলাদেশের মতোই মুসলিমপ্রধান দেশ। ওইসব দেশের নাগরিকের বেশির ভাগই ধর্মে মুসলমান কিন্তু তাদের নামকরণ বেশির ভাগ তাদের স্ব স্ব মাতৃভাষায় করা। ব্যতিক্রম বোধহয় একমাত্র বাংলাদেশ। ইরানিদের নামকরণ সাধারণত ফারসি ভাষায় হয়। যেমন রেজা, পাহলভি, ফিরোজ ইত্যাদি। এগুলো আরবি শব্দ নয়। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র অথচ সুকর্ন, সুহার্তো, সুজিপতো, মাহাথির, জয়ন্ত এ নামগুলোর কোনোটিই আরবি শব্দ নয়। অথচ এসব নামধারী ব্যক্তি বেশির ভাগই ধর্মে মুসলমান। আলবেনিয়া, বসনিয়ায় বসবাসকারী মুসলমানদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আলেপ্তগিন, সুবক্তগিন, ইলতুতমিশ প্রমুখ মুসলমানের নাম যখন পাঠ করা হয় তখন লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, এ নামগুলোও আরবি শব্দ নয়। সুতরাং একজন আরবীয় খ্রিস্টানের আরবি নামকরণ যেমন স্বাভাবিক ব্যাপার তেমনি ইরানি, তুর্কি, ইন্দোনেশিয়ান কিংবা মালয়েশিয়ান মুসলমানের মাতৃভাষায় নামকরণও খুবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক হয় না শুধু বাংলাদেশি বাঙালিদের বেলায়। আরব্য খ্রিস্টানদের আরবি নামকরণের মতো বাঙালি মুসলমানদেরও বাংলা নামকরণ একটি সহজ-স্বাভাবিক ব্যাপার হওয়াই যুক্তিগতভাবে সমীচীন। বিশেষত বায়ান্নর ৮ ফাল্গুনের পর। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভাষার কোনো ধর্ম নেই, তেমনি ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও ভাষার কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ভাষার সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে ভাষা ও ধর্ম দুটোকেই জটিল করা হয় মাত্র। ভাষা ও ধর্ম দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার। দুটোকে যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দুটোরই মর্যাদা বাড়ে বই কমে না। বাংলা পৃথিবীর অষ্টম বৃহৎ ভাষা। এ ভাষার জন্য আমরা দিয়েছি রক্ত। জীবন দিয়ে মাতৃভাষার প্রতি এমন করে চূড়ান্ত সম্মান দেখিয়েছে বোধ করি একটি মাত্র জাতি- সে বাঙালি জাতি। অথচ এ ভাষাতেই কেউ সন্তানের নামকরণ করলে (এ প্রসঙ্গে আমি আমার বাবা-মাকে আমার বাংলা নামকরণ করার জন্য জানাই আমার পরম শ্রদ্ধা) তাকে নানা সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। দেশে ও প্রবাসে ২১ ফেব্রুয়ারির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মঞ্চে, টিভিতে কিংবা রেডিওতে যেসব গুণী বক্তা বাংলা ভাষা নিয়ে মনকাড়া বাংলা শব্দে আদর্শের বক্তব্য দেন, জানতে ইচ্ছে করে সেসব সুধীজনের কজন তাদের নিজেদের সন্তানের নামকরণে শ্রুতিমধুর একটি বাংলা শব্দ বেছে নিয়েছেন। আশা রাখছি একুশে ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতার সীমানা পেরিয়ে সচেতনভাবে মর্যাদা দিয়ে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসব বাংলা ভাষাকে- আমি, আপনি, আমরা সবাই।

               লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর