রবিবার, ৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা রাসায়নিকের হাবিয়া সরবে কবে?

তুষার কণা খোন্দকার

নিমতলী থেকে চুড়িহাট্টা রাসায়নিকের হাবিয়া সরবে কবে?

২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষ পুড়ে মারা গিয়েছিল। নিমতলীর ভয়াবহতার ধরন দেখে দেশব্যাপী মানুষ চমকে উঠে ভেবেছিল এ কীসের আগুন! এত ধোঁয়া, এত ভয়ঙ্কর দ্রুতবিস্তার কি স্বাভাবিক দুর্ঘটনা? বাড়িঘরে আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা দেশজুড়ে মাঝেমধ্যে ঘটে। দু-চার জন মানুষ আগুনে পুড়ে মারা গেলে লোকে দুঃখ পায় কিন্তু দিন শেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়েই মানুষের জীবন। যাক, হয়তো অসাবধানতা থেকে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। ২০১০ সালে নিমতলীর আগুনে দোজখের ভয়াবহতা দেখে মানুষ সান্ত্বনা খুঁজবে কী ভরসায়; বরং তারা আতঙ্কে কুঁকড়ে গিয়েছিল। আগুনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেশবাসী জেনেছিল পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যে কোনো বসতবাড়ি কিংবা বসতবাড়ির আশপাশের যে কোনো বাড়িতে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম আছে। সেই রাসায়নিক পদার্থের বেশির ভাগ ভয়ঙ্কর দাহ্য। কোনোটি আগুনের ছোঁয়ায় জ্বলে ওঠে কোনোটি জ্বালানোর জন্য কয়েক ফোঁটা পানিই যথেষ্ট। সরকারি প্রশাসন, বাড়িওয়ালা এবং ব্যবসায়ীদের সীমাহীন দায়িত্বহীনতা দেখে দেশবাসী আতঙ্কিত বোধ করেছিল। দুর্ঘটনার পর রাজনীতিবিদদের মায়াকান্না দেখে দেশবাসী ভেবেছিল নিমতলীর আগুনের মতো ভয়াবহ ঘটনায় সরকার বড় একটা ঘা খেয়ে হলেও সজাগ হয়েছে। মানুষ এবার প্রতিকার পাবে। দেশবাসীকে আর কখনো দুনিয়ায় হাবিয়া দোজখের আগুন দেখতে হবে না। সরকারের কাছে মানুষের প্রতিকারের প্রত্যাশা ছিল, কারণ ঘুণে ধরা প্রশাসনের কাছ থেকে মানুষ এখন আর ভালো কিছু আশা করে না। দেশের মানুষ জানে প্রশাসনের লোকজন গুদাম সরানোর ভয় দেখিয়ে নিজেদের কপাল ফেরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিন্তু জনগণের প্রতিনিধি যারা সরকার চালান তারা হয়তো মানুষের দুঃখকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন এবং সমস্যা নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নেবেন। তৎকালীন সরকার নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কেমিক্যাল গুদামগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তারপর সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিমতলীর আগুনে ১২৪ জন মানুষের পুড়ে মরার ঘটনা আমরা ভুলে গেছি। সেই সঙ্গে সরকারের তদন্ত প্রতিবেদন ও প্রতিকারের সুপারিশের ফাইলের গায়ে পুরু ধুলার পরত জমেছে। ২০১৯ সালে চকবাজারের চুড়িহাট্টার নারকীয় ঘটনায় ৬৯ জনের প্রাণহানি প্রমাণ করল নিমতলী ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কেউ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। আসলে লোক দেখানো কান্নাকাটির মধ্য দিয়ে ঘটনার অবসান হয়েছে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চকবাজারের চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬৯ জন মানুষ মারা যাওয়ার পর সরকারের লোকজন ঘটা করে সংবাদমাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন। এমন ফরমাল শোকবাণীর সান্ত্বনায় দেশবাসীর মনে জ্বলে ওঠা ক্ষোভ নেভানো কঠিন হতে পারে ঠাওর করে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদরা নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইতে এগিয়ে এসেছেন। চকবাজারের আগুনে ৬৯ জন মানুষ মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের দুজন সাবেক শিল্পমন্ত্রী পরস্পরকে দোষারোপ করার কাজে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ২০০৯-১৪ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া চকবাজারের চুড়িহাট্টার দুর্র্ঘটনাস্থল দেখতে গিয়ে ২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্মরণ করলেন। ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় নিমতলীর মতো ভয়ানক ঘটনার পুনরাবৃত্তির জন্য তিনি তার উত্তরসূরি ২০১৪-১৮ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করলেন। বললেন, সদ্যবিদায়ী শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু সিরিয়াস হলে হয়তো এত দিনে পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম সরানোর কাজ শেষ হয়ে যেত। গুদাম সরানোর কাজটি সঠিকভাবে করা হলে এ বছর হয়তো ৬৯ জন মানুষকে এভাবে আগুনে পুড়ে মরতে হতো না। তার দাবি অনুযায়ী মনে হয় তিনি মন্ত্রী থাকাকালে পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম সরানোর কাজে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এটি যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের প্রশ্ন- দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হলেন ২০০৯ সালে। ২০১০ সালে নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন মানুষ প্রাণ হারাল। তর্কের খাতিরে আমরা মেনে নিলাম ২০১০ সালে দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হিসেবে শিশু ছিলেন। কিন্তু তিনি ভুলে যাচ্ছেন কেন ২০১০-এর পরে তিনি আরও চার বছর মন্ত্রী হিসেবে গদিতে বসে ঝিমিয়েছেন। সেই চার বছরে কি তিনি পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম সরানোর মতো দরকারি কাজে হাত দিয়েছিলেন? নাকি তিনি দাবি করবেন, এক মেয়াদে মন্ত্রী থাকলে মন্ত্রী হিসেবে দরকারি কাজ সেরে ফেলার মতো সাবালকত্ব পাওয়া যায় না। আমরা দিলীপ বড়ুয়ার বালখিল্য বাহানার জবাবে বলতে পারি, পাঁচ বছর মন্ত্রী থাকাকালে দিলীপ বড়ুয়ারা শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ভিন্ন স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। জনবিচ্ছিন্ন নামসর্বস্ব অখ্যাত পার্টির নেতা দিলীপ বড়ুয়া নিজ যোগ্যতায় মন্ত্রী হওয়া অনেক দূরের কথা, স্বচ্ছ নির্বাচন হলে তিনি জনগণের ভোটে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদেও জিততে পারবেন না- এই সত্য দিলীপ বড়ুয়া নিজেও ভালো করে জানেন। জনগণের কাছে তার এবং তার পার্টির কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই জানতেন বলে জনগণের ভাবনা ভাবার কোনো দায় তার ছিল না। মন্ত্রিত্বকে তিনি কর্তাভজার চাকরি হিসেবে দেখেছেন এবং সেভাবেই দিনগত পাপক্ষয় করে বিদায় হয়েছেন। চৌদ্দ দলের তকমার জোরে দিলীপ বড়ুয়ারা আবার মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমি আবার মন্ত্রী হব ভাবনায় মশগুল দিলীপ বড়ুয়া রাসায়নিকের গুদাম সরানোর কাজ ভুলে দিনভর জামায়াত-বিএনপির গিবত গাওয়ার কাজে মত্ত ছিলেন। ২০১৪ থেকে ’১৮ মেয়াদকালের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলছেন, দিলীপ বড়ুয়া নিজ দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায় নাহক অন্যের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের আরেক নেতা সদ্যবিদায় হওয়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম বলেছেন, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের জন্য সরকারেরও দায় রয়েছে। সরকারি দলের নেতা নাসিমের সাবধানী শব্দচয়ন দেখে মনে হয়, এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের জন্য যৎসামান্য হলেও সরকারের দায় আছে! আওয়ামী সরকারের বর্তমান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন। কয়েকদিন আগে তার জায়গায় আরেকজন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে নিজের নাকটা মুছে ফেলার উপক্রম করেছিলেন। আহারে বেচারা! গত কয় বছরে তিনি এত গন্ধ শুঁকেছিলেন যে উনি মুখ খুললেই চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। সেজন্যই বোধহয় লোকটা মন্ত্রিত্বের বলয় থেকে ছিটকে পড়েছেন।

ফেব্রুয়ারি মাসে চকবাজার চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাতে পড়লাম শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি চুড়িহাট্টা এলাকায় কোনো রাসায়নিক গুদামের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। যে ভবন থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা সেই ভবনের নিচতলায় সংরক্ষিত কেমিক্যালের বস্তার ছবি পত্রিকার পাতায় দেশবাসী দেখেছে। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টার-ফটোগ্রাফার সবাই দেশবাসীকে ভুল খবর ভুল ছবি দিয়ে প্রতারণা করল! নাকি সরকারি প্রশাসন সরকারভক্তির প্রমাণ দিতে গিয়ে জনগণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতেও দ্বিধা করছে না! সরকারি প্রশাসনের এমন ইতর অধঃপতন খতিয়ে দেখার কি কেউ আছে? আমার মনে হয় জনবসতি থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর প্রয়োজন এবং সরাতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে যেহেতু সরকারের সমালোচনা হচ্ছে সেজন্য সরকারকে উদ্ধার করার জন্য একজন মহৎপ্রাণ আমলা ত্যাগের মহিমা নিয়ে সরকারের সেবায় এগিয়ে এসেছেন। আহারে! এ যেন হিন্দু পুরাণের ঋষি দধীচি! আপনারা ভেবে দেখুন। উনার রিপোর্টের মর্মার্থ একটি শিশুও কত সহজে বুঝবে। তিনি বলতে চেয়েছেন, যেহেতু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলের আশপাশে কোনো রাসায়নিক মালামালের গুদাম নেই অতএব ২০১০-এর নিমতলী অগ্নিকাণ্ড কিংবা ২০১৯-এর চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে রাসায়নিক গুদামের কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারের অতিরিক্ত সচিব যেহেতু রাসায়নিক গোডাউনের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি তাহলে আর সরকারের অতীত কিংবা বর্তমান মন্ত্রীরা কেন এমন ঝগড়া করছেন? সরকারের একজন দায়িত্ববান আমলা অতীত-বর্তমান মন্ত্রীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায়মোচন করে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন এ দেশের আমলারা সরকারের মাথার ওপরে ছাতার কাজ করছেন। আমলাদের ছাতার তলে সরকার নিরাপদ, কিন্তু পুরান ঢাকার মাথার ওপরে রাসায়নিক গুদামের মৃত্যুখাঁড়া ঝুলেই থাকল!

            লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর