সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

জননিরাপত্তা ও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

জননিরাপত্তা ও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র

সাম্প্রতিক সময়ের দুটি বড় ঘটনা আমাদের সবাইকে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকি দিয়ে গেল। ঘটনা দুটির জের ধরে প্রশ্ন উঠেছে, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র হিসেবে নিজের ও সামষ্টিক নিরাপত্তার জন্য আমরা প্রত্যেকে কতটুকু সচেতন। ঘটে যাওয়া দুটি দুর্ঘটনা রোধে যেসব রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তি রয়েছেন তাদের পারস্পরিক দোষারোপ ও লুকোচুরির দৃশ্য দেখে দীর্ঘদিন আগে মাধ্যমিকে পড়ার সময়ের আমার একজন প্রিয় শিক্ষকের বলা একটা গল্পের কথা মনে পড়েছে। আমার সেই স্যার গল্প বলায় খুব পটু ছিলেন। সঙ্গত কারণে তার ক্লাসে আমরা খুবই মনোযোগী ছিলাম যাতে স্যার খুশি হয়ে আমাদের গল্প শোনায়। তাতে দুটো কাজই ভালোভাবে হতো, পড়ালেখা ভালো হতো এবং তার সঙ্গে গল্পের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু শিখতাম। স্যারও আমাদের কাছে খুবই পছন্দের ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে ওই গল্পটির বিষয়বস্তু একটু সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। প্রাচীন যুগের এক ক্ষমতাশালী রাজা-প্রজাদের পানির অভাব দূর করার জন্য বড় আয়তনের একটা দিঘি খোঁড়ার কাজ শুরু করলেন। অনেকখানি গর্ত করার পরেও দিঘিতে পানি উঠছে না। রাজা খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে এক রাতে স্বপ্ন দেখলেন পানি পেতে হলে প্রথমে দুধ ঢেলে দিঘি ভর্তি করতে হবে এবং তাতে দিঘি পবিত্র হয়ে দুধ মাটির নিচে চলে যাওয়ার পর তার স্থলে পানি এসে দিঘি ভর্তি হয়ে যাবে। রাজা পরের দিন দরবারে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে একটা দিন ঠিক করলেন এবং হুকুম জারি করলেন ওইদিন সব প্রজা প্রত্যেকে এক জগ দুধ এনে দিঘিতে ঢালবে। রাজার হুকুম অমান্য করার সাধ্য কারও নেই। তবে প্রত্যেকের মনে একইরকম ভাবনা এলো এই মর্মে যে, এত মানুষ দুধ নেবে তার মধ্যে আমি একা এক জগ পানি নিয়ে ঢেলে দিলে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না। নির্দিষ্ট দিনে দেখা গেল সবাই একই দুর্বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হওয়ায় দিঘিতে শুধু পানি, দুধ নেই। তারপর মুহূর্তের মধ্যে দিঘি থেকে পানি নেই হয়ে গেল এবং সে বছর প্রচণ্ড খরা অনাবৃষ্টি দুর্ভিক্ষ হয়ে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটল। রাজা বুঝলেন সহজ কথায় কাজ হবে না। প্রজা মঙ্গলে রাজাকে কঠোর ও কঠিন হতে হবে। তাই আবার দিঘির জন্য দুধ আনার হুকুম জারি করলেন এবং জানালেন দুধের পরিবর্তে কেউ পানি আনলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে শূলে চড়ানো হবে। সে যুগের সবাই জানতেন রাজার হুকুমের কোনো অন্যথা হয় না। হুকুম অনুসারে সবাই সতর্ক হলেন এবং প্রত্যেকে এবার দুধ ঢালতেই দিঘি ধৌত হয়ে পবিত্র হওয়ার পর পানিতে ভর্তি হলো। পানির কষ্ট দূর হওয়ায় খরা এবং অনাবৃষ্টিও আর থাকল না। রাজা প্রজার সম্পর্কে প্রজা কল্যাণ ও কঠোরতা দুটোই একই সঙ্গে থাকতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এখন এ আধুনিক গণতান্ত্রিক যুগে সে রকম রাজা এবং শাসন কোনোটাই নেই। আধুনিক যুগের শুরুতে বিশ্বখ্যাত রাজনৈতিক পণ্ডিত নিকোলা ম্যাকিয়েভেলি তার ‘দ্য প্রিন্স’ বইতে একটা মূল্যবান কথা বলেছেন, ‘সহজাতভাবে মানুষ স্বার্থ, প্রলোভন এবং অপরাধপ্রবণ। তাই রাষ্ট্র ও সমাজে স্বার্থের সংঘাত ও দ্বন্দ্ব অনিবার্য। আপনা থেকে কেউ নিজের স্বার্থ ছেড়ে সামষ্টিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে না। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে এটা আরম্ভ হয়েছে। এটা ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু আধুনিক যুগে রাষ্ট্র শক্তির কাছে অন্যসব শক্তিই তুচ্ছ। তাই সামষ্টিক স্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠোর ও কঠোর হতে হবে, এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। ঢাকার চকবাজারে সেদিন আগুনে দগ্ধ হয়ে ৭০ জন মানুষের জীবন গেল। এ পর্যন্ত যতটুকু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি তাতে এটাকে দুর্ঘটনাই বলতে হবে। অন্য কিছু আছে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। যদিও নিরাপত্তার বিবেচনায় কোনো কিছুকেই সহজ সরলভাবে নেওয়া যায় না। কারণ, বাঙালি জাতি হিসেবে যুগে যুগে যেমন দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করেছি, তেমনি বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরও যুগে যুগে ছিল, এখন নেই তা বলতে পারছি না। প্রশ্ন উঠেছে চকবাজারের দুর্ঘটনা কি এড়ানো যেত? যেত কি যেত না সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটা জোর দিয়ে বলা যায়, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য অনেক কিছু করার ছিল, যা সংশ্লিষ্ট সবাই জেনেও কেউ কিছু করেনি। সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে দুধের বদলে এক জগ পানি ঢেলে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, বিস্ফোরক অধিদফতর, সিটি করপোরেশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবাই ভেবেছে অন্যেরা আছে, যা করার তারাই করবে, এখানে আমি কিছু না করলেও চলবে। তাই এবার চকবাজারে ৭০ জন মানুষের এমন প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঠেকাতে না পারার জন্য রাষ্ট্রের উল্লিখিত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছে, যেটি সবার চোখে ধরা পড়েছে। ২০১০ সালে নিমতলীতে একইভাবে একই কারণে ১২৪ জন মানুষ মারা গেল। তখনো অনেক কথা হয়, তদন্ত হলো এবং সুনির্দিষ্ট সুপারিশও এলো। কিন্তু কিছুই হলো না। আরেকবার প্রমাণ হলো ভাগের মা গঙ্গা পায় না, অর্থাৎ সবার দায়িত্ব মানে কারও দায়িত্ব নয়। নিমতলী ঘটনার পর তদন্তের ভাগ্যে তেমনটাই ঘটেছে। হাই কোর্ট রুলে ঠিকই বলেছে, কেউ দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ওয়াহিদ ম্যানসন, যেখান থেকে আগুনের উৎপত্তি, তার মালিক এবং ওই ভবনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে যারা ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ বসবাস করেছেন তারাও সমানভাবে দায়ী। কারণ, নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রথমেই প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ নিজ জীবনকে নিরাপদে রাখার জন্য প্রথম দায়িত্বটা পালন করতে হবে। এ জায়গায় সামগ্রিকভাবে আমরা ভীষণভাবে অসচেতন।

তাই এখানেই রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্ব আসে। ২০১০ সালে নিমতলী দুর্ঘটনার পর রাষ্ট্রযন্ত্র যদি যথার্থ ভূমিকা পালন করত তাহলে যৌক্তিকতার বিবেচনায় বলা যায় এবার চকবাজারের ট্র্যাজেডি আমাদের দেখতে হতো না। ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সবাই বলার চেষ্টা করেছেন, মালিকদের অনিচ্ছার কারণে চকবাজারের কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এটা তো গ্রহণযোগ্য কথা হতে পারে না। বৃহত্তর জনস্বার্থে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠিন হতে হবে। বিশ্বজুড়ে এমনটাই দেখা যায়। সে কারণেই ম্যাকিয়েভেলির কথাটা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের স্মরণে রাখা জরুরি। মানুষ এবার অন্তত প্রত্যাশা করছে এর পরে আর কোনো বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ পুরান ঢাকায় থাকবে না। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ২৪ ফেব্রুয়ারি বিকালে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে যাত্রীবেশী একজন দুর্বৃত্ত ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝ আকাশে পিস্তল উঁচিয়ে চিৎকার করে বিমানটি ছিনতাইয়ের ঘোষণা দেয়। পাইলট ও ক্রু ছাড়াও ওই ফ্লাইটে ১৪২ জন যাত্রী ছিল। বিমানের ক্যাপ্টেন ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিমান নিয়ে চট্টগ্রামে অবতরণ করতে সক্ষম হয় এবং অতি দ্রুত জরুরি বহির্গমনের দরজা দিয়ে যাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত বিমানের দুজন ক্রু-কে জিম্মি করে ছিনতাইকারী বিমানের মধ্যে থেকে কিছু অসংলগ্ন দাবি ও কথাবার্তা বলতে থাকে। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রানওয়েতে বিমানটিকে ঘিরে ফেলে এবং অত্যন্ত স্বল্প সময়ে সেনা কমান্ডো অভিযানে কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ছিনতাই ঘটনার অবসান ঘটে। কমান্ডো অভিযানে ছিনতাইকারী নিহত হয়। আকাশপথে ঘটনার খবর পাওয়ার পর সেনা কমান্ডো বাহিনীসহ সবাই মিলে যত স্বল্প সময়ের মধ্যে ছিনতাই ঘটনার অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছে তা সত্যিই নজিরবিহীন। এ অসাধারণ সক্ষমতা অবশ্যই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে, ইতিবাচক বার্তা দেবে। তবে এর বিপরীতে ছিনতাইকারী অস্ত্র বা অস্ত্রসদৃশ বস্তু নিয়ে কীভাবে বিমানে ওঠে গেল সেটি আবার নেতিবাচক বার্তা দেবে।  ছিনতাইকারীর কাছ থেকে উদ্ধারকৃত পিস্তলটি আসল নাকি নকল তা নিয়ে ধূম্রজাল ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, যা কাম্য নয়। আসল বা নকল হোক, এমন একটি বস্তু নিয়ে কোনোভাবেই কোনো যাত্রীর বিমানে আরোহণের সুযোগ নেই। ঢাকা বিমান বন্দরের নিরাপত্তা চেকিংয়ের ব্যবস্থা খুবই আধুনিক এবং যথেষ্ট। চেকিং ব্যবস্থায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীর শিথিলতা বা যোগসাজশ ছাড়া এমন ঘটনা কিছুতেই ঘটতে পারে না। বিমানবন্দরের সর্বত্রই সিসি ক্যামেরা রয়েছে। তাই ওই ছিনতাইকারীর প্রবেশের সময় সিসি ক্যামেরায় ধৃত চিত্র পর্যালোচনা করলেই সবকিছু বের হয়ে আসবে। আমরা যেন এমন না শুনি যে, ওই সময়ে ওই স্থানের সিসি ক্যামেরা অকেজো ছিল। সেটা হলে তা হবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। নিরাপত্তা বিষয়ের মৌলিক কথা হলো কেউ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিমানবন্দরে একজন যাত্রী বা কোনো ব্যক্তি এমন বিপজ্জনক নিরাপত্তা পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে আর কেউ কিছু বলতে পারবে না, তা কী করে হয়। এমন শৈথিল্য, গাফিলতি বা অপরাধের দায় বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কেউ এড়াতে পারে না। এর আগে কয়েকবার প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে পথিমধ্যে যেসব ত্রুটি ধরা পড়েছে তা দেখে মনে হয় বাংলাদেশ বিমানের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। আর নয়তো ধরে নিতে হবে সেখানে সব ষড়যন্ত্রকারীর আড্ডা। ঢাকা বিমানবন্দরে লোকবল ও মেশিনপত্রসহ কোনোকিছুরই অভাব নেই। অভাব শুধু নিয়োজিতদের দায়িত্ববোধের। ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে যারা যাতায়াত করেন তাদের প্রায় সবার মুখেই একই কথা, সেবা বলতে যা বোঝায় তার কিছুই ঢাকা বিমানবন্দরে দেখা যায় না। বিমান থেকে নামার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও যখন লাগেজ পাওয়া যায় না তখন যাত্রীদের সহযোগিতা বা সাহায্য করার জন্য কখনো কেউ একজনকে পাওয়া গেছে এমন নজির নেই। বিমানবন্দরের সেবা নিয়ে যাত্রীদের অসন্তুষ্টি দীর্ঘদিন ধরে থাকার পরেও তার কোনো সুরাহা যখন হয় না তখন তার বিরূপ প্রভাব নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর পড়বে সেটিই স্বাভাবিক। কারণ, শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা, মনিটরিং ও দেখভালের ব্যবস্থা যখন চরমভাবে অনুপস্থিত তখন এরকম ঘটনা ঘটবেই। এ অব্যবস্থাপনার পরিণতিতেই ২৪ ফেব্রুয়ারিতে পিস্তল বা পিস্তলসদৃশ বস্তু নিয়ে ছিনতাইকারী বিমানে উঠতে সক্ষম হয়েছে এবং জননিরাপত্তাকে আর কিছু না হলেও অন্তত কয়েক ঘণ্টা হুমকির মধ্যে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একবার চিন্তা করে দেখুন, সেদিন ছিনতাইকৃত বিমানটি যদি ক্ষতিগ্রস্ত এবং যাত্রীদের জীবনহানি হতো তাহলে সেটি বাংলাদেশের জন্য কতবড় ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারত। সুতরাং জননিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে চাইলে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কঠোর, কঠিন হতে হবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর