সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ইস্যু : দ্বিপক্ষীয় বেড়াজাল আর কতকাল?

ফজলে হোসেন বাদশা

রোহিঙ্গা ইস্যু : দ্বিপক্ষীয় বেড়াজাল আর কতকাল?

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন প্রণিধানযোগ্য একটি কথা বলেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ঢাকায় এক বিতর্ক অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম মিয়ানমার তাদের কথা রাখবে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যে চুক্তি হয়েছে তার কোনোটাই মিয়ানমার বাস্তবায়ন করেনি। প্রত্যাবাসনে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন অজুহাতে তারা বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে।’ খবর অনুযায়ী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এখনকার অনুধাবন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো প্রয়োজন।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উপলব্ধি খুব স্পষ্টভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। আর সেটি হলো, আমরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যে চুক্তি করেছিলাম, তাহলে কী সেটি ব্যর্থ হয়ে গেল? এ প্রশ্নটি এখন নতুন ফর্মে উত্থাপিত হলেও আদতে তা মোটেই নতুন প্রশ্ন নয়। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন ‘দ্বিপক্ষীয়’ চুক্তিটি করেছিল, এ প্রশ্ন শঙ্কার চেহারা নিয়ে তখনো হাজির হয়েছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো একটি স্পর্শকাতর ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাজনিত বিষয়কে কী কারণে ‘দ্বিপক্ষীয়’ বাতাবরণে সমাধান করতে গিয়েছিলাম, তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এখনো দাবি রাখে বৈকি।

পুরনো কথা, আমরা সবাই জানি। তারপরও আলোচনার স্বার্থেই স্মর্তব্য, রোহিঙ্গা সংকট একদিনের সৃষ্টি নয়। ১৯৭৮ সাল থেকে আজ ২০১৯- এই ৪১ বছর ধরে এই সংকট আমাদের ঘিরে আছে। পুরোপুরিভাবে মিয়ানমারের পুরনো অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে এই সংকটের সূত্রপাত। অথচ এখন তার দায় এসে পুরোপুরি চেপে বসেছে আমাদের কাঁধে। এর পেছনে যে ভূরাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আছে, তা নিয়ে আলোচনার আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কারা কীভাবে এই সংকট সৃষ্টিতে প্রথম সমর্থন দিয়েছিল, তা নিয়ে কথা বলা জরুরি। আটাত্তরে প্রথম যখন জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছিল, তখন বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। সেই সময় রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচয় সামনে এনে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছিল বিএনপি। মনে রাখা জরুরি, সেই সময় এই অঞ্চলজুড়ে মৌলবাদী রাজনীতি বিস্তারে কাজ করছিল জামায়াত এবং স্বাভাবিকভাবেই বাস্তুচ্যুত শরণার্থী এসব রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের দূরবর্তী অশুভ পরিকল্পনাই তৎকালীন সরকারের নীতিতে প্রতিফলিত হয়। ১৯৯০-৯১ সালে আবারও দলে দলে রোহিঙ্গারা আসে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সব সময় রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের দেশের মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের ধর্মীয় পরিচয় সামনে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। দলে দলে তারা এসেছে, আমাদের কক্সবাজার এলাকায় থাকছে। এদের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে বহু আগেই।

মহাজোট সরকার নিরাপত্তাজনিত কারণ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী ভাবনা থেকেই রোহিঙ্গা সংকটকে চিরতরে নির্মূলের জন্য উদ্যোগী হয়। এর ফলে মিয়ানমারের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে তারা শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ২০১১ সালের ১৬ অক্টোবর মিয়ানমারের নতুন সরকার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে স্বীকৃতি জানায়। কিন্তু আমরা দেখলাম, ২০১২ সালে আবার রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গা শুরু হলো। আন্তর্জাতিকভাবেই এটি এখন জাতিগত নিধন হিসেবে স্বীকৃত। তার মানে স্পষ্টত মিয়ানমার সরকার এই কাজটি উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করে। অ্যামনেস্টির তথ্য বলছে, ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে এই দাঙ্গার পরও ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ শিবিরে বসবাস করত। আর বাংলাদেশে কয়েক লাখ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের আগস্টে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ২৭ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মাত্র এক মাসের মধ্যেই সেই সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ শুধু মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয় এবং তা বিশ্বে প্রশংসিতও হয়।

কিন্তু এর জন্য যে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, সে ব্যাপারে খোদ প্রধানমন্ত্রীও সচেতন ছিলেন। এর প্রমাণ, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর এক মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে সংকট সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরেন। তাঁর প্রথম সুপারিশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বৈষম্যমূলক আইন, নীতি ও চর্চার বিলোপ চান। তাঁর দ্বিতীয় সুপারিশ, মিয়ানমারকে অবশ্যই বিশ্বাস তৈরি, সুরক্ষা ও অধিকারের নিশ্চয়তা এবং সব রোহিঙ্গার জন্য নাগরিকত্বের পথ সৃষ্টির মাধ্যমে সহায়ক পরিবেশ গঠন করতে হবে। সব বেসামরিক লোকজনকে রক্ষায় যদি প্রয়োজন হয় তাহলে মিয়ানমারের ভিতর ‘সেফ জোন’ তৈরি করতে হবে। তৃতীয় সুপারিশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশগুলোর আলোকে জবাবদিহি ও বিচারের ব্যবস্থা করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধ রোধ করতে হবে। তাঁর এই সুপারিশ স্পষ্টতই মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশের ভাবনাকে পুরোপুরি তুলে ধরে। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশলটি কাজ করতে শুরু করেছিল বলেই মনে হচ্ছিল।

কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই একটা বড় ছন্দপতন ঘটে। অনেকটা তড়িঘড়ি করে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরুর তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে বসে। গোলমালটা বাধে সেখানেই। দ্বিপক্ষীয় সেই চুক্তিতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে আসা ৭-৮ লাখ রোহিঙ্গার বিষয়টি একমাত্র বিবেচনাযোগ্য। তার আগে নানা সময়ে বাংলাদেশে আসা ৩-৪ লাখ রোহিঙ্গার রাখাইনে ফিরে যাওয়া আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আবার সেখানেও যুক্ত করা হয়, রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায়, তাহলেই প্রত্যাবাসন করা হবে। কার্যত এই চুক্তির সমস্ত সুবিধা মিয়ানমারের পক্ষে গিয়েছে। অথচ এটি এমন একটি সময় ছিল, যখন প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে এই ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর একটি কার্যকর চাপ তৈরির বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছিল। সমস্যার শুরু থেকেই মিয়ানমার সব সময় অভিযোগের আঙ্গুল বাংলাদেশের দিকে তুলেছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত এই কথা বলে আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ কাড়তে চেষ্টা করেছে। বরাবর মিয়ানমার রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালত, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির অভিযোগ, জাতিসংঘের অভিযোগ, মানবাধিকার কমিশন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে, অস্বীকার করেছে। দায় চাপিয়েছে ‘আরসা’ নামের এক সংগঠনের ওপর। কিন্তু যখন আমাদের কাছে ছবি, তথ্য-প্রমাণ এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর উচ্চকিত প্রতিবেদন মিয়ানমারকে চাপে ফেলল, তখন আমরা ভুল পথে পা বাড়ালাম। এমনকি সেই চুক্তি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার পথেও যায়নি।

গলদ থাকল রোহিঙ্গাদের নাম নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়ও। প্রথম দফায় জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআরকে সংযুক্ত না করে এই কাজ শুরু করা হয়। দ্বিতীয় দফায় তাদের সঙ্গে নিয়েও মিয়ানমারের আপত্তিতে নতুন করে আবার আঙ্গুলের ছাপসহ আরও কিছু তথ্য একত্রিত করে নিবন্ধন তালিকা করা হয়। তাহলে প্রথমেই কেন সংশ্লিষ্ট এই দুই পক্ষকে অঙ্গীভূত করে করা হয়নি? প্রায় আট হাজারের মতো ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা মিয়ানমারকে প্রথমে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাত্র পাঁচ হাজারের মতো লোকজনকে ফেরত নিতে স্বীকৃত হয় তারা। বাকি লোকদের কোন যুক্তিতে মিয়ানমার গ্রহণ করতে রাজি নয় সে প্রশ্নটি কেন আমরা জোরেশোরে করতে পারলাম না? দীর্ঘ সময়ের পুরনো এই সমস্যা সমাধানে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলো? এ তো অনভিজ্ঞতার সমস্যা নয়। তাহলে এর পেছনে কী কারণ ছিল? আমরা কাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলাম, সেই প্রশ্নের সমাধান আজ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

কাজেই আজ যখন, রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে আগ্রহী নয়, তখন আমাদের ভুল পদক্ষেপের খেসারত দিতে হয়। যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বিষয়টিতে আগের মতো মনোযোগী না হয়ে বরং দ্বিপক্ষীয় চুক্তিকেই বড় করে দেখছে, যখন মিয়ানমারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে কথা বলার মুখ পেয়েছে, তখন আমরা কূটনৈতিক কৌশলে পিছিয়ে পড়ে খাবি খাচ্ছি। ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করছি। তাদের জন্য এ বছরও আমাদের আরও ৭৭৩ কোটি টাকার দরকার বলে আন্তর্জাতিক মহলে ধরনা দিচ্ছি। কিন্তু সংকট সমাধানের কোনো আশার আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

বরং উল্টো চিত্র ফুটে উঠছে। যেমন, সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যে জাপানের উদ্যোগে বিনিয়োগ মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই মেলা স্পষ্টতই মিয়ানমারের ব্যাপারে আমাদের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পরিচিত এই দেশটির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দেয়। আবার এই মেলায় পশ্চিমারা, এমনকি রাশিয়া অংশ না নিলেও যেসব দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন, তাদের মধ্যে চীন, ভারত, কোরিয়া ও থাইল্যান্ড সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। অথচ এই দেশগুলোকে আমরা আমাদের বন্ধুপ্রতিম হিসেবেই জানি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, যারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী, তাদের এই ইস্যুতে আমাদের ভূরাজনৈতিক সহযোগী হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি, কূটনীতি ও উন্নয়নের এই যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান, তার মূল কারণ কী? এর জন্য কি আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি দায়ী নাকি বিদেশ নীতি দায়ীÑসেই প্রশ্নই এখন আমাদের সামনে এসে গেছে।

এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। তারও আগে সেই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ব্যর্থতা খতিয়ে দেখতে হবে। নিজেদের সমস্যার সমাধানকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন করে কূটনৈতিক উদ্যোগ এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের প্রতিবেশীসহ বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোকে কার্যকরভাবে বোঝাতে হবে, আজকের এই রোহিঙ্গা সংকট যদি আমরা স্থায়ীভাবে সমাধান করতে না পারি, তাহলে এর যে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি তা ভূরাজনৈতিকভাবে পুরো অঞ্চলকেই প্রভাবিত করবে ভবিষ্যতে। অন্যথায় শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্ধৃত বক্তব্যটি নেহাতই আত্মসমালোচনা হয়ে থেকে যাবে। 

লেখক : বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ

সম্পাদক ও সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর