শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে গণতন্ত্র ও সুশাসন গুরুত্বপূর্ণ

ইকরামউজ্জামান

ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে গণতন্ত্র ও সুশাসন গুরুত্বপূর্ণ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নজিরবিহীন জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠিত হয়েছে। সরকারের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ থাকায় ক্রীড়াঙ্গনে কোনো ধরনের অস্থিরতার জন্ম হওয়ার কথা নয়। বরং উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সংগঠকদের উচিত ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে কাজ করা। ক্রীড়াঙ্গনকে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। ক্রীড়াঙ্গনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিকল্প নেই। ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্র ও সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ক্রীড়াঙ্গন শুধু গতিশীল হবে না, এগিয়েও যাবে। যেসব খেলার ফেডারেশন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংঘবদ্ধ, কর্মকর্তারা সবাই মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন সেগুলো অধিকতর ক্রিয়াশীল। এরা ক্রীড়ানুরাগীদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন।

ক্রীড়াঙ্গনে আবেগ গুরুত্বপূর্ণ। এ আবেগেই তো অর্জন সম্ভব হয়েছে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। ’৭১ সালে জন্মের সময় বাংলাদেশ ছিল জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অষ্টম বৃহৎ দেশ। বাংলাদেশের পর (১৩৩তম দেশ) এ পর্যন্ত জাতিসংঘে আরও অনেক দেশ যোগ দিয়েছে। কারও কারও জনসংখ্যা ছিল ১০ লাখেরও কম! কারও আবার কিছু বেশি। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশ হচ্ছে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণাকারী সর্বশেষ বৃহৎ জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র। স্বাধীনতার পর এই বিশাল জনসম্পদকে ক্রীড়াঙ্গনে কতটুকু কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক! তবে এটা ঠিক, এখন সবচেয়ে উত্তম সময় ক্রীড়াঙ্গনে তরুণ ও যুবকদের প্রাণশক্তি ও সামর্থ্য কাজে লাগানোর। কয়েক বছর পর এ সুযোগ আর দেশ পাবে না।

এ অঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনে সেই প্রথম থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ছিল। এ দুর্বলতা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন দেশের ক্রীড়ানীতিসমূহে এটা স্পষ্ট হচ্ছে। নতুন জাতির ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক উৎসগুলো অনুসন্ধান করা হয়নি। ক্রীড়াঙ্গনের সবকিছুতে অগ্রগতি হওয়ার পরও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার কথা ভাবা হয়নি। খেলার জগতে তৃণমূল প্রতিষ্ঠানে দুর্বলতা ছিল প্রথম থেকেই। যুগ যুগ ধরে ব্যক্তি মানুষের প্রাধান্য ছিল ক্রীড়াঙ্গনে। লোকরঞ্জনবাদ ক্রীড়াঙ্গনকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। অথচ এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের চিন্তা ক্রীড়াঙ্গনে এখনো গুরুত্ব পাচ্ছে না। ক্রীড়াঙ্গন যোগ্য ও দূরদর্শীসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাবে সবসময় ধুঁকছে। জনস্বার্থ পরিপন্থী পরিবেশ ভর করে আছে।

দায়িত্বভার গ্রহণের পর নতুন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহিদ আহসান রাসেল বিভিন্ন খেলার ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। সবার বক্তব্য শোনার পর যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আচানক কিছু কথা বলেছেন। তার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো গত ১০ বছর ধরে ক্রীড়াঙ্গনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, দেখেছেন বিভিন্ন ফেডারেশনে ক্রীড়া সংগঠকদের ভূমিকা, ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা। দেখেছেন আত্মসর্বস্ব, আত্মকেন্দ্রিক ক্রীড়া সংগঠকদের রূপ। দেখেছেন ক্রীড়াঙ্গনে যারা রাজা বানান তাদের দিকে সবাই কীভাবে তাকিয়ে থাকেন। নৈতিক মূল্যবোধে কি ভীষণ উদাসীনতা! দেখেছেন দায় অস্বীকারের সংস্কৃতি।

এর আগে আর কোনো যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ক্রীড়াঙ্গনকে দীর্ঘ ১০ বছর (যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন) ধরে পর্যবেক্ষণ এবং বুঝে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেননি। মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী বলেছেন, ২১টির মতো ফেডারেশনে ‘অ্যাডহক’ কমিটি রয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অ্যাডহক কমিটি শোভনীয় নয়। অবিলম্বে নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। সমস্যা হলো দেশের ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্রের চর্চা বিতর্কিত ও ত্রুটিপূর্ণ। এ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বড় কম। যদি গণতন্ত্র কিনতে হয়, যদি গণতন্ত্রের পথে একদলকে পুরস্কার হিসেবে বৃহত্তর ক্রীড়াঙ্গনে জায়গা করে দেওয়া হয়, যোগ্য ও দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক কাউকে কাউকে সাজানো এবং নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের খেলায় বাতিলের তালিকায় নিক্ষেপ করা হয়, ওপর থেকে সেট করা জনদেরই যদি ভোটে জিতিয়ে আনা হয় তাহলে এ রকম গণতন্ত্রের কি প্রয়োজন আছে? ব্যক্তি ও সমষ্টির ইচ্ছামাফিক তো ক্রীড়াঙ্গনে গণতন্ত্রচর্চা চলতে পারে না। আমাদের তো দরকার কার্যকর গণতন্ত্র। অগণতান্ত্রিক মানসিকতার কুশীলবরা তো গণতন্ত্রের ঐতিহ্য বহন করতে পারেন না। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে। ক্রীড়াঙ্গনে সুস্থ গণতন্ত্রচর্চার জন্য প্রয়োজন নতুন চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন। ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর গঠনতন্ত্র সংশোধন থেকে শুরু করে অনেক কাজই করতে হবে, যদি আমরা সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চা ক্রীড়াঙ্গনে দেখতে চাই।

গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়ন সবকটিই দরকার। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যগুলো থাকলে হবে না। এই তিনের মধ্যে সমন্বয় করে ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ এখন ক্রীড়া সংগঠকদের সামনে। এটা মনে রাখতে হবে যে, সংগঠকদের নেতৃত্বের কার্যকর বিকল্প নেই। আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা প্রতারিত হয়েছি, আমাদের আশা ও স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। সফল নেতৃত্বের তো কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবসময় বলি সংগঠকদের অবহেলা করে দূরে রাখলে ক্রীড়াঙ্গনে উন্নতি করাটা বাতুলতা। আবার এটাও সবসময় লক্ষণীয় হচ্ছে, সংগঠকদের মধ্যে অন্তঃকলহ, বিভিন্ন ধরনের বিবাদ, নীতি বিসর্জন, অবিশ্বাস্য ফাঁকিবাজি, বিশৃঙ্খলা ও স্থবিরতা ক্রীড়াঙ্গনের মৌলিক কার্যক্রম ব্যাহত করছে।

যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ক্রীড়াঙ্গনে সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। আস্থার জন্য বিশ্বাসে যেন চিড় না ধরে। দেশের মানুষ যে ক্রীড়াঙ্গন প্রত্যাশা করে, তা কিন্তু দেখতে পারছে না এটা বাস্তবতা। মানুষ চায় জাতীয় অর্জনগুলো সবাই মিলে একসঙ্গে গৌরবের সঙ্গে উদ্যাপন করতে। চায় ক্রীড়াঙ্গনে যোগ্য ও সৎ নেতৃত্ব।

ক্রীড়াঙ্গন নৈতিকতা সংকটে ভুগছে। নারীর প্রতি বৈষম্য ক্রীড়াঙ্গনে বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের সাফল্য ও অর্জন কোনো অংশে কম নয়। এর পরও নারীরা ক্রীড়াঙ্গনে সুযোগ ও অধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। সততা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেই। মুখে সবসময় অনেক কথা বলা হয়, বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ বাড়ছে, কিন্তু অংশীদারত্ব বাড়ছে না। বিভিন্ন খেলার ফেডারেশনে নির্বাহী কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। আধুনিক অলিম্পিক আন্দোলন নারীদের ন্যায়সংগত অধিকারের কথা বার বার বলছে।

অর্থ আত্মসাৎ তো শুধু দুর্নীতি নয়। দুর্নীতির সংজ্ঞার পরিধি তো অনেক বড়। দায়িত্বে থেকে কাজে ফাঁকি দেওয়াটাও দুর্নীতি। মতলব হাসিলের লক্ষ্যে উপঢৌকন দেওয়া হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি আর ওয়াদা করা হচ্ছে (বাস্তবায়ন করা হবে না জেনেও) এসবই দুর্নীতির মধ্যে পড়ে। আমরা লক্ষ্য করছি অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে ক্রীড়াঙ্গনে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অযোগ্যকে যোগ্য হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হরদম হচ্ছে। ক্রীড়াঙ্গন কেন ভুগবে আদর্শগত শূন্যতায়। বিবেক মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি। এটা দিয়েই তো মানুষ ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ও হিতাহিতের পার্থক্য উপলব্ধি করে। অশুভকে প্রতিহত করে। বিবেকের পরাজয় ঘটলে তো আর কিছু থাকে না।

গত ৪৭-৪৮ বছর কি বাঙালি ক্রীড়া সংগঠকদের জন্য খুব কম সময়। সংগঠকরা ক্রীড়াঙ্গনের চালিকাশক্তি। তাদের দূরদর্শিতা, বিশ্বাস ও আত্মশক্তি, প্রত্যয় এবং আন্তরিকতায় পরিচালিত হওয়া উচিত ক্রীড়াঙ্গন। ক্রীড়াঙ্গনে চাটুকার ও ব্যক্তিত্বহীন লোক অনেক আছেন। এরা আগেও ছিলেন। এরাই ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন। এখনো ক্ষতি করছেন। ক্রীড়াঙ্গনে পরিবর্তন আনতে পারেন একমাত্র উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক ক্রীড়া সংগঠকরা। যারা মানবিক গুণাবলি ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। এরা পারবেন ক্রীড়াঙ্গনে যে গতিশীল অনুঘটক আছে, তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে। ক্রীড়ানুরাগী মানুষ বিশ্বাস করেন কয়েকটি খেলায় বাংলাদেশের চিত্তাকর্ষক অগ্রগতি অবশ্যই সম্ভব।

 

                লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।

 

সর্বশেষ খবর