বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
স্বাধীনতার মাস

৭ মার্চের ভাষণের কাব্যকথা

ফখরে আলম

৭ মার্চের ভাষণের কাব্যকথা

বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। ১ হাজার ৮৫ শব্দের এই ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। দেশপ্রেম, আবেগ, স্বপ্ন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ত্যাগ, ভদ্রতা নম্রতা, সহনশীলতা, দূরদর্শিতা, সাহস, দ্রোহ, শপথ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আস্থা ও বিশ্বাস, নির্দেশনা এই অনুষঙ্গগুলো ভাষণকে এক মহাকাব্যে রূপ দিয়েছে। এই মহাকাব্যই একাত্তরে যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছে। বাঙালি জাতিকে লাল-সবুজ পতাকা উপহার দিয়েছে। আর এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ভাষণে নির্লোভ বঙ্গবন্ধুর মুখোচ্ছবি দেখা যায়। তিনি খুবই বিনয়ের সঙ্গে ভাষণে বলেছেন, ‘আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’ বঙ্গবন্ধু কখনই ক্ষমতার লোভ করেননি। ত্যাগেই তিনি প্রশান্তি পেয়েছেন। আমরা ৭ মার্চের ভাষণে এ বিষয়টি লক্ষ্য করি। ভাষণে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘এই বাংলায়-হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ অবাঙালিরা বিহারি নামে পরিচিত।

১৯৭১ সালে এদের অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে। তারা বাঙালিদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এদের রক্ষার জন্য বিশৃঙ্খলারোধ করার জন্য ৭ মার্চ এমন বক্তব্য রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে এই ভাষণে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে আত্মমর্যাদাশীল হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করব এবং এদেশকে গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’ বঙ্গবন্ধু একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। তিনি তার ভাষণে বলছেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’ এই শত্রু হচ্ছে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। আর পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি ৭ মার্চের ভাষণে তিনি ইয়াহিয়া খানকে সাহেব সম্বোধন করেছেন। ভাষণে ভুট্টোর কথা বঙ্গবন্ধু তিনবার উচ্চারণ করেছেন। তিনবারই তিনি ভুট্টোকে সাহেব বলেছেন। তিনি ভাষণে বলেছেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজোরটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন, তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ বঙ্গবন্ধু প্রকৃতই গরিবের বন্ধু। তিনি বাংলার অসহায় মানুষের জন্য সব সময় আন্তরিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তিনি বলেছেন, ‘গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেই জন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে-শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভার্নমেন্ট দফতরগুলো ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।’ তিনি বলেছেন, ‘দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মাইনাপত্র নেবার পারে।’ গরিব শ্রমিকদের কথা বিবেচনা করে তিনি ভাষণে আরও বলেছেন, ‘আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন-প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছাইয়া দিবেন।’ ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ কবিতার মতোই মনে হয়। ভাষণের যে কাব্য সুধা তা বাঙালি জাতির তৃষ্ণা মেটাবে। এই ঐতিহাসিক ভাষণের কারণেই নিউজউইক ম্যাগাজিন তাকে কবি উপাধি দিয়েছিল। 

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর