বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

বেদনার আগুনে পুড়ছি চকবাজার চুড়িহাট্টায় এসে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বেদনার আগুনে পুড়ছি চকবাজার চুড়িহাট্টায় এসে

শোকের দৃশ্য দেখে লিখতে বসেছি। জানি না, কী লিখব, কী বলব, কোন তুলির আঁচড়ে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ পাঠকদের এঁকে দেখাব। চকবাজার ট্র্যাজেডি নিঃসন্দেহে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। নিমতলীর পর চকবাজারের চুড়িহাট্টাও জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে কে জানত। অবশ্য কয়েক বছর আগের সাভার গার্মেন্ট ধসে হাজার হাজার শ্রমিকের মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণের ঘটনাটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। এসব বিপর্যয় আমাদের মানবিকতাকে নাড়া দেয়। বিবেক জাগিয়ে তোলে। ভাবনাকে স্তব্ধ করে দেয়। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় স্থবিরতা এনে দেয়। মলিন করে দেয় আমাদের হাসি-আনন্দ। চকবাজারের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। মায়ের আকুতি, শিশুর করুণ তাকিয়ে থাকা আমাদের ভাবনাকে আচ্ছন্ন রেখেছে বেশ কদিন। এর মধ্যেই কারওয়ান বাজার বস্তিতে পুড়ে যায় ছিন্নমূল মানুষের হাজারো স্বপ্ন। যাত্রাবাড়ী-সিলেটসহ দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় আগুনের ঘটনা উদ্বেগের সঙ্গে দেখেছি।

এসব বিপর্যয় এবং দুর্ঘটনায় আমরা শোকাহত হই ঠিক, কিন্তু একটি বিষয় আমরা ভুলে যাই বারবার। পবিত্র কোরআন আমাদের বারবার বলেছে, ‘জাহারাল ফাসাদু ফিল বাররি ওয়াল বাহরি বিমা কাসাবাত আইদিনন্নাস লিইউজিকাহুম বাদাল্লাজি আমিলু লাআল্লাহুম ইয়ারজিউন। অর্থ : হে মানুষ! তোমাদের কর্মের প্রতিক্রিয়াতেই জলে-স্থলে বিপর্যয় ও বালা মুসিবত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন তোমাদের কৃতকর্মের ফল কিছুটা আস্বাদনের সুযোগ দেন। যাতে করে তোমরা শিক্ষা পেয়ে সত্যপথে ফিরে আসতে পার’ (সূরা আনকাবুত-৪১)। এ আয়াতের দিকে গভীরভাবে নজর বোলালেই বোঝা যাবে, আমাদের শোক কাদের জন্য হবে, আগুনে পোড়া মানুষগুলোর জন্য নাকি বিপর্যয় দেখে যারা শিক্ষা নেয় না তাদের জন্য। যারা আগুনে পুড়েছে, তারা তো পুড়েছেই; দোয়া করি আল্লাহপাক ভুলচুক মাফ করে তাদের সবাইকে জান্নাতে জায়গা করে দিন। কিন্তু বারবার এরকম ভয়াবহ বিপর্যয় দেখেও আমরা যারা সতর্ক হই না তাদের বেলায় কী বলা যায়? কোন শব্দে তাদের প্রকৃত ছবিটি আঁকা যায়। বোধহয় কোরআনই এদের ব্যাপারে সঠিক শব্দটি বলেছে। ‘উলাইকা কাল আনআম। বালহুম আদল্ল। তারা হলো চারপেয়ে জন্তু-জানোয়ার। না না, এর চেয়েও নিকৃষ্ট।’ চতুষ্পদ জন্তুর বৈশিষ্ট্য হলো, তার সামনে খাবার দেওয়া হলো। একসঙ্গে খাবার খাচ্ছে কয়েকটি গরু কিংবা ছাগল। এর মধ্যে থেকে মালিক একটিকে ধরে নিয়ে গেল। পাশেই জবাই করে দিল। খেতে খেতে অন্যরা দেখল তার এক ভাইকে জবাই করে দেওয়ার দৃশ্য। দেখতে পাচ্ছে কাটাগলা নিয়ে লাফানোর মর্মান্তিক দৃশ্য। তারপরও এই জন্তুগুলোর কোনো খবর হয় না। সে বুঝতে পারে না, একটুপর তাকেও এভাবেই জবাই করা হবে। সে ভাইয়ের কাটাগলা নিয়ে লাফানোর দৃশ্য দেখে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। মুখ ডুবিয়ে দেয় কচি ঘাসে। এই হলো চতুষ্পদ জন্তুর জীবন। এই যে হৃদয়বিদারক আগুন দুর্ঘটনা ঘটল, কয়দিন আমরা হৈচৈ করলাম। তারপর আবার সবাই ভুলে গেলাম। কয়েক বছর পর আবার ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ছাই হবে কতগুলো জীবন। ভাঙা বিল্ডিং ধসে চাপা পড়বে হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু আমরা এর থেকে কোনো শিক্ষাই নিই না। আমাদের লোভ কমে না। একটু বেশি উপার্জনের লোভে নিয়মনীতি না মেনে যেখানে সেখানে মরণফাঁদ তৈরি করে নিচ্ছি। কথায় আছে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। পাপ যখন ভারী হয়, তখন আল্লাহতায়ালা বান্দাকে সতর্ক করেন। একটু আজাব দিয়ে বুঝিয়ে দেন, লোভের শেষ ফল কত মর্মান্তিক হয়। অথচ, আমরা এতটাই মোহাচ্ছন্ন, আল্লাহর সতর্কবাণী বুঝতে পারি না। ফলে বারবার আমরা আজাবের শিকার হই।

হে পাঠক বন্ধু! আসুন! কোরআনে ফিরে আসি। আমাদের লোভকে সংযমের চাদরে ঢেকে রাখি। তাহলে আর কখনো দেখতে হবে না নিমতলী-চকবাজার-সাভার ট্র্যাজেডি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের হৃদয়ে কোরআনের আলো জ্বেলে দিন। বেদনার আগুন নিভিয়ে দিয়ে হৃদয়ে প্রশান্তি দিন। লোভের কালো ধুয়ে দিন। আমাদের দেশ ও পরিবেশকে সুন্দর করার-নিরাপদ রাখার তৌফিক আপনি আমাদের দান করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর