সোমবার, ১১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

চলো যাই মাটির কাছে

শাইখ সিরাজ

চলো যাই মাটির কাছে

ইতিহাস বলে কৃষিই জন্ম দিয়েছিল নতুন সভ্যতার। কোনো এক নারীর হাত দিয়ে বপিত হয়েছিল একটি বীজ। সেই থেকে জন্মে ফসল। আর সেই সভ্যতায় মানুষ পেয়েছিল সুস্থিরতা। ফসল ফলিয়ে জীবন ধারণ করে মানুষ সভ্য হয়ে ওঠে। এরপর জমি কর্ষণে ফল-ফসল ফলানোর বিদ্যায় দক্ষ হয়ে উঠতে থাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। মাটিই হয়ে ওঠে মানুষের সাধনাস্থল। মাটির বুক থেকেই মানুষ ফলিয়ে তোলে সোনার ফসল, বেঁচে থাকার স্বপ্ন, আগামী দিনের আধার। সমুদ্র উত্থিত এ ব-দ্বীপ বাংলাদেশের পলিজমা উর্বর মাটিতে পূর্বপুরুষরা বুনেছিল ফসলের বীজ, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্বপ্ন। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের মূল প্রোথিত রয়েছে হাজার বছর আগে, এই কৃষিতেই। নতুন প্রজন্মকে আগের প্রজন্মের সঙ্গে, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার রীতি রয়েছে প্রতিটি উন্নত ও সভ্য জাতির। কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কৃষি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাঠ দেওয়া হয় নতুন প্রজন্মকে। যেমন বলা যায় স্কটল্যান্ডের উইটমোর অর্গানিক ফার্মের কথা। সেখানে শিশুরা নিয়মিত কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য প্রস্তুত প্রণালির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ৫০ মাইল দূরের ম্যুর পার্ক এলাকায় আন্ডার উড ফ্যামিলি পার্কের কথাও বলা যেতে পারে। নিউইয়র্ক থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে স্টোন বার্ন ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল সেন্টারের কথাও মনে পড়ছে এ মুহূর্তে। আরও এমন অনেক কৃষিশিক্ষার বিদ্যাপীঠ সফর করার সুযোগ আমার হয়েছে। সেসব জাতিগোষ্ঠীর মূল পেশা কৃষি না হলেও শিশু বয়স থেকে স্কুল-কলেজে কৃষিশিক্ষা, খাদ্য উৎপাদন প্রণালি হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। বিপ্লবী নেতা মার্কাস গার্ভে বলেছিলেন, যে মানুষের নিজের মূল, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কোনো জ্ঞান নেই সে মূলত একটি শিকড়হীন গাছ। রবিঠাকুরও আমাদের মাটির টানে ফিরে যেতে বলেছেন শিকড়ে, যেখান থেকে উৎপত্তি হয়েছে নিজের অস্তিত্বের। ব্যথিত হই যখন নিজ দেশের দিকে তাকাই, যেখানে সিংহভাগ মানুষ গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে জড়িত, যেখানে মূল পেশা কৃষি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট, সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেই অর্থে কৃষির তেমন অস্তিত্ব মেলে না। চ্যানেল আইয়ে ‘ফিরে চলো মাটির টানে’ অনুষ্ঠানে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ ও স্কুলের একঝাঁক শিশু-কিশোর নিয়ে চলে যাই কৃষকের কাছে, কৃষির কাছে। যেন এ অনুষ্ঠান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ, আগামী প্রজন্ম একবার হলেও যেন ছুঁয়ে আসে নিজের শিকড়পোঁতা মাটি, নিয়ে আসে বাংলাদেশের কৃষকের শ্রমে-ঘামে সিক্ত মাটির ঘ্রাণ। সেখান থেকে যেন তারা দীক্ষা নিতে পারে ধ্যানমগ্ন ও শ্রমসাধনার সমৃদ্ধ জীবনের এবং আরও শক্ত ও মজবুত করতে পারে নিজের শিকড়কে। মৌসুম এখন ‘ফিরে চলো মাটির টানে জুনিয়র’-এর। গত বছরের ডিসেম্বরে রাজধানীর গ্লোবাল ভিশন স্কুলের ২০ খুদে শিক্ষার্থীকে নিয়ে গিয়েছিলাম মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে। সেখানে পদ্মার তীর ঘেঁষে উর্বর চরে কনকসার গ্রামের কৃষক মুনির হোসেনের জমিতে আলু বপন করে এসেছিল। এবার আলু তোলার পালা। ২ মার্চ, ২০১৯। গত কয়েক দিনের বৃষ্টি ফাল্গুনেও শীতের আমেজ এনে দিয়েছে। ঠা-া ঠা-া ভোরে রওনা হলাম ২০ খুদে শিক্ষার্থীকে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে। এর আগে এই শিক্ষার্থীদের আলু বপনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলেও এবার উত্তেজনাটা যেন আরও বেশি। গাড়িতে যেতে যেতে জানতে চাইলাম তাদের অনুভূতির কথা। তারা আবেগে উদ্বেলিত। আলু বপনের পর থেকেই প্রতীক্ষায় ছিল কবে আলু তুলতে যাবে। এক টুকরা আলু থেকে কীভাবে একটি আলু গাছের জন্ম হয়, সে গাছের শিকড়ে মাটির নিচে অসংখ্য আলু জন্মায়, তা দেখার জন্য তারা উন্মুখ হয়ে আছে। বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিতে দিতেই জেগে উঠল সকালের সূর্য। সোনালি আলো ঠিকরে পড়ছে নদীর পানিতে। নদীতে ঝলমল করে উঠল সোনালি রং। এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ তারা। জানাল, এমন উজ্জ্বল রঙের সকাল এর আগে তারা কখনো দেখেনি। কৃষক মুনিরের বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে সকালের নাস্তা। পৌঁছাতে পৌঁছাতে খিদেটা বেশ পেয়ে বসেছিল বোধহয়। হৈচৈ করে খাবার খেল তারা। খেতে খেতে একজন আরেকজনের সঙ্গে দুষ্টুমিতে মেতে উঠল। ওদের দেখে মনে পড়ল আমার শৈশবের কথা। ঢাকায় বড় হলেও বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই ছুট দিতাম গ্রামে। নদীর তীর, কাশবন, ফসলের মাঠ, মেঘনার পাড় দূর করে দিত সারা বছরের জমে থাকা গ্লানি। গ্রামে থাকার সময়টুকুতে নতুন নতুন চিন্তার উদ্বেগ ঘটাত শিশুমনে। গ্রাম থেকে যেন নতুন জীবন নিয়ে ফিরতাম শহরে।

খাওয়ার পর্ব শেষ। এবার মাঠে যাওয়ার পালা। প্রায় ১ কিলোমিটারের পথ হাঁটার পর পদ্মা নদীর তীর। তারপর কলের নৌকায় নদী পার হয়ে আলুর খেত। লাইন ধরে সারি বেঁধে নিয়ে চললাম ওদের। নিজেকে মনে হলো হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। যেতে যেতে চোখে পড়ল একটা দোকানে টানানো ‘এইখানে ডিজিটাল কফি পাওয়া যায়’। এই দেখে তাদের মহাবিস্ময় ‘ডিজিটাল কফি!’ ওরা আমাকে প্রশ্ন করল, ‘ডিজিটাল কফি জিনিসটা কী?’ নিয়ে গেলাম দোকানির কাছে। বললাম, দোকানিকেই জিজ্ঞাসা কর। তারা দোকানির কাছেই জানতে চাইল, ‘চাচা, ডিজিটাল কফি কী?’ দোকানি কফি তৈরির মেশিনটি দেখিয়ে বলল, ‘এই মেশিনে ঠাণ্ডা পানি দিলে গরম হয়ে বের হয়। এ কারণে এ যন্ত্রের থেকে বানানো কফির নাম দিয়েছি ডিজিটাল কফি।’ দোকানির কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পদ্মার তীরে তখন ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। তীরে ভেড়ানো নৌকার সার। কুয়াশা কেটে জেগে উঠছে দূরের নদী। জেলেরা গুছিয়ে নিচ্ছে জাল। কেউ গোসল সারছে। কেউ ধুয়ে নিচ্ছে ব্যবহার্য তৈজসপত্র। নদীতীরে বসেই কেউ বুনছে মাছ ধরার জাল। এসব দেখে তারা বিস্মিত। ইংরেজিমাধ্যমে পড়া ওরা কি কখনো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়বে? জানবে কেমন ছিল পদ্মার তীরের জীবন? জানি না। তবে তাদের দেখার সুযোগ হলো পদ্মার তাজা ইলিশ। জেলেরা মাছ নিয়ে যাচ্ছিল আড়তে। তারা খুব কাছ থেকে একসঙ্গে সারি সারি ইলিশ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তাদের শোনালাম ইলিশের গল্প। শোনালাম পদ্মার মাঝিদের জীবনকাহিনী। ওদের কাছে জানতে চাইলাম, তোমরা কি জান, কেন জাটকা আর ডিমওয়ালা মাছ ধরতে নেই? সবাই মাথা নাড়াল, না, জানে না। জিজ্ঞাসা করলাম, বল তো একটা ডিমওয়ালা মাছের পেটে কতগুলো ডিম থাকে? কেউ বলল ৩০০, কেউ একটু বাড়িয়ে ৫০০। ‘না, হলো না’ জানালাম ওদের। তারা একটু বাড়িয়ে বলল, ৭০০। যখন জানালাম একটা ইলিশ ১০ লাখ ডিম দেয়, ডিমওয়ালা একটা ইলিশ খেয়ে ফেলা মানে ১০ লাখ ইলিশ জন্মানোর সম্ভাবনা নষ্ট করে দেওয়া। এ কথা শুনে তারা বিস্মিত হলো। গতবার নৌকায় চড়তেই ঘটেছিল চরম বিপত্তি। ট্রলারের প্রপেলারে লম্বা কারেন্ট জাল আটকে যায়। তারপর অন্য নৌকা করে যেতে হয়েছিল। এবার সে ঘটনা স্মরণ করে খুব হাসল তারা। নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। নদীতে জেগে উঠেছে বালুচর। মাঝি বলল, নদীতে ডুবোচরও আছে। সাবধানে নদী পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটেই গেল। মাঝনদীতে ডুবোচরে আটকে গেল নৌকা। উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে গেল শিশুরা। জিজ্ঞাসা করলাম, সাঁতার জান কে কে? কারও হাত উঠল না। মাঝি আশ্বস্ত করল, সমস্যা নেই, বড় কোনো ঝামেলা না। নৌকা থেকে নেমে দু-একজন শুরু করল নৌকা ঠেলার কাজ। শিক্ষার্থীরা ভেবেছিল গভীর পানি, ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল পানি হাঁটুর নিচে তখন সাহস ফিরে পেল। ‘হেঁটেই তো নদী পার হয়ে যেতে পারতাম!’ কেউ কেউ বলছিল। অতঃপর পাড়ে এসে ভিড়ল ইঞ্জিনচালিত বোটটি। সেই চেনা চর। মরিচ, ধনিয়া, খিরা আর আলুর খেতের আল ধরে হেঁটে চলল ২০ শিশু। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে তাদের লাগানো আলু খেত। পৌঁছেই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেল যার যার সারিতে। প্রথমে খড় আর গাছ সরানোর কাজ। বেশ ভালোভাবেই সারল কাজটি। এবার লাঙ্গল টেনে মাটি সরিয়ে মাটির নিচ থেকে বের করে আনতে হবে ফলানো সাধের ফসল। কষ্টসাধ্য কাজটিও তারা করল মন দিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়েই। এরপর মূল প্রতিযোগিতা মাটির নিচ থেকে আলু তুলে আনা। সারা শরীরে মাটি লাগিয়ে আলু তোলা খুদে কৃষক। মন ভরানো এ দৃশ্য। তাদের ফলানো আলুর প্রতি কী যে মায়া তাদের! একটা আলুও তারা মাঠে পড়ে থাকতে দিতে চায় না। মাটির সঙ্গে মিশে গভীর মমতায় তুলে আনা আলু গুছিয়ে রাখল যার যার পাত্রে। নামমাত্র প্রতিযোগিতা, আসলে মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। মাটির সোঁদা গন্ধকে কেউ প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। এ ঘ্রাণ আমাদের রক্তের ভিতর। তারই প্রমাণ মেলে এই খুদে কৃষকের চোখে-মুখে ফসল ফলানোর আনন্দ দেখে।

আলু তোলার প্রতিযোগিতা শেষ হলো। নিয়ম অনুযায়ী কৃষককে আলুর দাম মিটিয়ে আসার কথা। খুচরা বাজারে আলুর যে দাম, সে দামে। খুদে কৃষক এখন জানে ফসল ফলানো কত কষ্টের। যখন জানল এত কষ্টে ফলানো আলুর দর কৃষক পায় কেজিপ্রতি মাত্র ৮-১০ টাকা। অবাক হলো! এত কম দাম! ন্যায্যমূল্য কৃষক পায় নাÑ এ কথা জেনে তারা ব্যথিত হলো। বাজারদর ১৫ টাকা করেই তারা আলুর দাম মেটাতে চায়। বাংলার কৃষক বরাবরই বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। এ খুদে কৃষকের কাছ থেকে সে কোনো মূল্যই নিতে চায় না। বলে, এ শিশুরা যদি বড় হয়ে কৃষকের কষ্টের কথা মনে রাখে, আমাদের নিয়ে ভাবে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

এবার ফেরার পালা। ওরা ক্লান্ত। তবে ভিতরে ভিতরে বেশ চাঞ্চল্য খেয়াল করলাম ওদের। গভীর আনন্দ বুকে নিয়ে ওরা গাড়িতে চলল। কী স্থির ওদের চাউনি! কিছু কি ভাবছে ওরা? কিছুটা পরিবর্তন কি দিয়েছে মাটি ওদের ভিতরে ভিতরে? দিয়েছে তো বটেই। ফসল। যে ফসলের জন্য আমাদের এত সংগ্রাম। স্বাধীনতার এ মাসে এই ২০টি শিশুর মনে যে বীজ প্রোথিত হলো তা বাংলার আর ২০ লাখ শিশুর মনকে জয় করুক। এ দেশ, এ ভূখণ্ডের মাটিতে মিশে আছে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণে উজ্জীবিত হোক দেশের সব সন্তান।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর