শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

দেশে ঘুষ ও অঘুষখোরদের দুই অর্থনীতি

সত্যবাক

দেশে ঘুষ ও অঘুষখোরদের দুই অর্থনীতি

দেশে একশ্রেণির কর্মকর্তা বা কর্মচারী আছেন যাদের মাসিক বেতন ৩০ হাজার বা তার কম- শোনা যায় তাদের একাধিক নয়, ১৫-২০টি ফ্ল্যাট, বাড়ি, শত শত বিঘা জমি আছে। ২-৩টি প্রাইভেট গাড়ি আছে। অথচ ৬০-৭০ হাজার টাকা বেতনের কর্মকর্তা আছেন যারা ২-৩টি বাচ্চা নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেশ আজ দুর্নীতির করালগ্রাসে নিমজ্জিত। তা প্রতিরোধের অঙ্গীকার আরও বেশি প্রচারিত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘নো মার্সি’ অবস্থানে প্রধানমন্ত্রী। এর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা তিনি তাঁর গত কয়েকটি নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ বিষয়ে আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইশতেহার বাস্তবায়নের চেষ্টাও করছেন তিনি। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় বসে বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁর এ অবস্থান ও চেষ্টার কথা বলেই যাচ্ছেন। কিন্তু ফল এখন পর্যন্ত শুভ নয়। ঘুষ-দুর্নীতি ছাড়া সরকারি দফতরে কোনো কাজ হতে পারে, এ কথা এখন বিশ্বাস করার মতো নয়। মনে রাখতে হবে, বট ফলের বিচির দ্বারা ছাদের কোনায় বট গাছের চারা ওঠে। সময়মতো না কাটলে ছাদে ফাটল ধরায়। দুর্নীতি আজ দেশে বট গাছরূপে আবির্ভূত হচ্ছে। সুশাসনকে পর্যুদস্ত করছে। কারও কারও মতে, দুর্নীতি একটি সামাজিক সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাধি দমনের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান একান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতির ভয়াবহতায় ক্ষোভের কথা তিনি জানিয়েছেন নানা উপমা, মন্তব্য, হুমকি, হুঁশিয়ারিতে। দুর্নীতির মহাসাগরে হাবুডুবু খাওয়ার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন সাবলীলভাবে। দুর্নীতিবাজদের জিব কেটে নেওয়ার হুঙ্কারও বাদ দেননি। তার পরও দুর্নীতি কেন বাড়ছে? কেন দুর্নীতিবাজরা ঘৃণিত না হয়ে সম্মানিত হয়ে সিনা টান করে ঘুরছে। গলদটা কোথায়? প্রচলিত কথাÑ এক কান কাটা মানুষ হাঁটে রাস্তার পাশ দিয়ে আর দুই কান কাটা হাঁটে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। সামাজিক বৈশিষ্ট্য বা রোগে পরিণত হওয়ায় দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি করতে আর ভয় পাচ্ছে না। এই শ্রেণি অনেকটা অবাধে দুর্নীতি করেই যাচ্ছে। তারা যেন ধরেই নিয়েছে কোনো জবাবদিহি তাদের করতে হবে না। রাজনৈতিক প্রশ্রয়, পরিচিতি ছাড়াও তাদের রয়েছে অনেক রক্ষাকবচ। আর দুর্নীতিতে বিরক্তরা তা সইছেন, হজম করছেন নিয়তির মতো। শুনতে একটু খটকা লাগলেও রূঢ় সত্য হচ্ছে, দুর্নীতি দমনের ফাংশনাল কাজ প্রধানমন্ত্রীর নয়। ক্র্যাকডাউনের কাজটা তিনি নিজে করতে পারবেন না। তা সম্ভবও নয়। প্রধানমন্ত্রী এ কথাও বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। তাই এখন আর তাদের দুর্নীতির দরকার নেই। দুর্নীতির ব্যাধিটি সারানোর চিকিৎসাপত্র দেবে দুর্নীতি দমনের সাংবিধানিক অথরিটি দুদক। এর চেয়ারম্যানের পক্ষে হেঁটে হেঁটে, দৌড়ে বা হানা দিয়ে দুর্নীতিবাজদের জিব কেটে চিকিৎসা দেওয়া বাস্তবে অসম্ভব। তা তিনি বলেছেন কথার ছলে। যার মাধ্যমে ঘটেছে তার সদিচ্ছার প্রকাশ। অপারেশন থিয়েটারের নীতি-কৌশল প্রণয়ন ও মনিটরের স্টিয়ারিংয়ে রয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান। তা জিব বা অন্য যে কোনো দিক দিয়েই হতে পারে। দুর্নীতির মহাসাগরে একসঙ্গে সব দরজা খুলে ঘুষখোরদের আটকানো সম্ভব নয়। একটি-দুটি করে খুলতে হবে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাত্রা, ব্যাপকতা, অঙ্ক কোন স্তরে বেশি-কম তা নিশ্চিত নয় কেউ। বাংলাদেশে দুর্নীতির ক্ষেত্র, ক্ষতি নিয়ে বড় কোনো গবেষণাও নেই। এ ক্ষেত্রে বড় ভরসা টিআইবি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও পত্রপত্রিকা দুর্নীতির বিষয়ে জরিপ তথ্য জানান দেয়।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে করা টিআইবির জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রধান প্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো- সাবরেজিস্ট্রি ও এসিল্যান্ড অফিস, ইনকাম ট্যাক্স, কাস্টম, আইনশৃঙ্খলা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা। সাবেক এক দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন দুদকই অতিমাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত। বর্তমান চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শর্ষের ভিতর ভূত যেন না থাকে।

সেই এখতিয়ার অবশ্যই দুদক চেয়ারম্যানের। ভেবেচিন্তে লিমিটেড কিছু ক্ষেত্র বা ফ্রন্টে তিনি যাত্রাটা শুরু করতে পারেন। দুদকের টিম ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সহজেই নামে-বেনামে কেনা প্লট-ফ্ল্যাটের হিসাব নিতে পারে। শুধু তাই নয়, কী দামে ফ্ল্যাট বা জমি বিক্রি হয়েছে, ক্রেতার নাম ও তার কন্টাক্ট পারসনের নাম, কন্টাক্ট নম্বরসহ ঠিকানা নিতে হবে। শুধু তাই নয়, ওই সম্পত্তির সাইজ কত ও কী দামে রেজিস্ট্রি ও মিউটেশন হয়েছে তারও হিসাব নিতে হবে। কম দামে দেখানো হলে সরকার বিশাল রাজস্ব হারিয়েছে। বাজার মূল্যের সঙ্গে বিরাট অঙ্কের ফারাক থাকলে সরকারি খাত বা ব্যাংক থেকে ওই মূল্য পরিশোধ করে ওই সম্পত্তির দখল নিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তা নিলামে বিক্রি করলে সরকারি রাজস্ব ফুলে ফেঁপে উঠবে। ১৩ মার্চের ‘আমাদের সময়’ পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠার খবর ‘অবৈধ সম্পদ অর্জন : পুলিশ সার্জেন্টের সাত বছরের কারাদণ্ড’ সেই সঙ্গে ৭৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত। ওই খবরের নিচে ওই মামলায় অন্যান্য চার্জশিটভুক্ত আসামি জরিপ সার্কেল-৫-এর সহকারী কর কমিশনার জগদীশ চন্দ্র সরকার, সার্কেল-১-এর সাবেক অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মাহবুবুর রহমান ও সার্কেল-৫-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার শাহ আলম ও এম এম নূরুজ্জামান। এ কাজগুলো বের করা তেমন কঠিন নয়। দুদক চাইলে ঘুষের এ গতিকে থমকে দেওয়ার দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। সদিচ্ছা ও কৌশল থাকলে কঠিনকে জয় করার জানা-অজানা দৃষ্টান্ত দেশে রয়েছে। বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তা উতরানোর কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ছে ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কথা। ঘরোয়া এক অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি শেয়ার করেছিলেন রাজনৈতিক বাধা ডিঙানোর কিছু ঘটনা। বিশেষ করে তেজগাঁওয়ের ট্রাকস্ট্যান্ড সরাতে পারার কৌশলটি।

ওই সময় ক্ষমতাসীন দলেরই বাঘা এক মন্ত্রী হুমকির সুরে ওই কাজ বন্ধ করতে বলেছিলেন। না চটিয়ে আনিসুল হক বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীকে একটু স্মরণ করতে। কারণ তারই ইশারায় জনস্বার্থে ওই উচ্ছেদ অভিযান। ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছিল আনিসুল হকের ওই কৌশল। এ ধরনের অভিযানে দুদক প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা অবশ্যই পাবে। প্রধানমন্ত্রী তাকে সেই সহযোগিতা দিয়েই রেখেছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণার মাধ্যমে। রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার, প্রতিষ্ঠান সবকিছুর পরতে পরতে দুর্নীতির ভয়াবহতা মাথায় রেখেই এগোতে হবে তাকে। দুর্নীতির বিষবৃক্ষ বিবেকবানদের প্রাত্যহিক জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। মেধা, সততা, সত্য পথকে করছে ক্ষতবিক্ষত। হয়তো দেশের এক শতাংশ মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত নয় অথচ ৯৯% শতাংশ এজন্য ভুগছে। প্রথমেই কথা উঠছে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কথা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও শিল্পোন্নয়নের ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যাতায়াত। শোনা যায়, বহু সাবরেজিস্ট্রারের শত শত কোটি টাকার জমি ফ্ল্যাট, বাড়ি দেশে-বিদেশে আছে। এক একজনের ২-৩টি প্রাইভেট গাড়ি আছে। বহু সাবরেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। প্রথম পর্যায়ে সব সাবরেজিস্ট্রার ও কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৫০০ জনকে টার্গেট করা যেতে পারে। সরকার চাইলে ওই সাবরেজিস্ট্রার, তাদের স্ত্রী-সন্তান, বাপ-মা, ভাই-বোনদের সম্পদের হিসাব নিতে পারে। বর্তমান কম্পিউটার যুগে ওইসব স্টেটমেন্ট রাখা খুবই সহজ কাজ। দুদকের কাছে ক্ষমতা আছে দেশের যে কোনো ব্যক্তির কাছে তার সম্পদের উৎস ও হিসাব চাইতে পারে। একসঙ্গে সর্বত্র হাত না দিয়ে কয়েকটা সংস্থায় হাত দিলে লাখ লাখ কালো বিড়াল বের হয়ে আসবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও তার অঙ্গসংস্থা যেমন যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা তেল কোম্পানিতে প্রায় ২৫০ জন কর্মকর্তার নাম ওই সংস্থা থেকে নিতে পারে। তাদের স্ত্রী-সন্তান ও বাবা-মার দেশে-বিদেশে সম্পদের হিসাবের স্টেটমেন্ট চাইতে হবে। বহু চতুর ঘুষখোর বিদেশে টাকা বিভিন্ন কায়দায় পাঠিয়ে ওই টাকা আবার দেশে ফিরিয়ে এনে সম্পত্তি গ্রাস করছে। আগামীতে তা ধরার পদ্ধতি প্রকাশ করব। দেশে কাস্টম ও ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে সহকারী কমিশনার থেকে কমিশনার পর্যন্ত প্রায় ৮৫০ জন কর্মকর্তা আছেন। দুদক, এনবিআরের কাছে থেকে ওইসব কর্মকর্তার তালিকা এনে তাদের কাছে সরাসরি সম্পদের হিসাব নেওয়া যেতে পারে। বিপিসিতে প্রতি বছর হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ কোটি টাকার পেট্রোল-ডিজেল বিক্রি হচ্ছে। পুরো দেশবাসী জানে ওইসব পেট্রোল কোম্পানিতে লিটারে কেউ ১০ পয়েন্ট পায় কিনা। ওইসব অয়েল কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিত্তবৈভবের শেষ নেই। বিপিসি থেকে ওইসব কর্মকর্তার তালিকা এনে সরাসরি সম্পদের হিসাব চাইতে পারে দুদক। উল্লেখ্য, ওই কর্মকর্তাদের সবাই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন তার এখতিয়ার অনুযায়ী সবার সম্পদের হিসাব নিতে পারে। ভূমি মন্ত্রণালয় প্রায় ২ হাজার ৫০০ কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সম্পদের হিসাব চেয়েছে। দুদক ওপরে বর্ণিত কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব নিতে পারে। সম্পদের হিসাব নিলেই দুর্নীতির গতিতে এক বিরাট বাধা আসবে। তারপর মামলা হবে কিনা তা নির্ভর করবে দুদকের ওপর। তবে দুর্নীতির গতিতে বাধা পড়বে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ঘুষখোরদের তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। এটা পর্যালোচেনার পর সরকার পেনাল অ্যাকশন নিতে পারবে। আরও বহু সংস্থায় হয়তো হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ দুর্নীতিবাজ আছে। আশা করি তাদের দুর্নীতির গতিতেও বাধা আসবে। আমরা ইকবাল মাহমুদ সম্পর্কে যতটুকু জানি তিনি এক শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষকের সৎ ছেলে, তিনি চাইলে সম্পদের হিসাব চেয়ে দুর্নীতিবাজদের একটি বিশাল ধাক্কা দিতে পারবেন।

            লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর