শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র কি স্বচ্ছ সুশাসন দিতে পারে?

তুষার কণা খোন্দকার

গণতন্ত্র কি স্বচ্ছ সুশাসন দিতে পারে?

রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একসময় গণতন্ত্রকে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি বলে দুনিয়াজুড়ে সবাই মেনে নিয়েছিল। রাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরতন্ত্র মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারছিল না বলে মানুষ গণতন্ত্রের ধারণাকে নিজেদের মুক্তির সনদ বলে গ্রহণ করে নিয়েছিল। ভেবেছিল, রাষ্ট্র পরিচালনায় দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গণতন্ত্র মানুষের শেষ আশ্রয়। দুই-আড়াই শ বছর আগে মানুষ যখন দেশে একজন রাজার শাসনের বদলে বলতে চাইল আমরা সবাই এ দেশটার রাজা, তখন সেই চাওয়া ও পাওয়া ছেলের হাতে মোয়া পাওয়ার মতো সোজা কাজ ছিল না। একদিকে রাজারা ভেবেছে, কি! এত বড় সাহস! আমার সিংহাসন ধরে টানাটানি! রাজার ইশারা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল মানুষ যারা রাজা-রানীর সিংহাসনের পায়া ধরে ঝোলাঝুলি করে নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজে দারুণ সফল তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে গণতন্ত্রকামী দলকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার কাজে নেমে পড়েছিল। এটি কোনো এক শতাব্দীর কিংবা এক দেশের ঘটনা নয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষে বসে থাকা মুকুটধারী ও মুকুটের ছায়াতলে বসবাসকারী সুবিধাভোগীরা ছলেবলে ক্ষমতায় লটকে থাকতে চায় এটি সর্বজনস্বীকৃত চিরন্তন ঘটনা। রাজা কিংবা ভিন্ন নামে কোনো স্বৈরশাসকের শাসন জনগণ মানবে কি মানবে না, এই টানাপোড়েনের সুরাহা করতে গত তিন শতাব্দী ধরে দুনিয়ার অনেক দেশে অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এতকাল আমরা এ লড়াইকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বলে মহিমান্বিত করে এসেছি। এ কথা সত্য, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিল না। ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে যে জিতে গেল সে ৪৯ শতাংশের ওপর আধিপত্য চালাবে, এটি গণতন্ত্রে স্বীকৃত ব্যবস্থা। তবে গণতন্ত্রচর্চায় যে কোনো ব্যক্তি কিংবা দলকে নির্দিষ্ট সময়সীমার পরে ভোটের জন্য জনগণের দুয়ারে যেতে হতো, এটি একটি ভরসার কথা ছিল।

বর্তমান দুনিয়ায় আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতিকরা জনগণের কাছে যাচ্ছেন বলে মনে হলেও প্রচারমাধ্যম এবং অন্যান্য সামাজিক হাতিয়ার ব্যবসায়ী-অব্যবসায়ী প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়ায় তারা জনগণের ইচ্ছাকে সুবিধামাফিক খেলাচ্ছে, যা ভয়ঙ্কর অশনিসংকেত। আজকের দিনে রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র-গণতন্ত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে শাসনব্যবস্থার যা হালহকিকত তাতে আমাদের এত বছরের লালিত বিশ্বাসের গোড়া থেকে মাটি সরতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, দুনিয়াজোড়া সাধারণ মানুষ এতকাল ধরে গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করে গলা শুকিয়ে বাস্তবে কী পেয়েছে তা খতিয়ে দেখার সময় হয়েছে। এতকাল আমরা ভেবে এসেছি, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম মানে এটি জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। জনগণের সমষ্টিগত স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা লড়াই করছি। মনের মধ্যে এমন আত্মতুষ্টি থাকে বলে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে জান দিতেও আমরা পিছপা হই না। বর্তমান সময়ে সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্র মানে এমন এক দলের বিজয় ও শাসন যার পেছনে দেশি এবং আন্তর্জাতিক শক্তিবলয় সক্রিয়। সব দেখেশুনে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করেছে, আমরা যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করি তখন আমরা আমাদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করি নাকি প্রতিষ্ঠিত পুরনো শক্তির জায়গায় নতুন কোনো শক্তি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য আমাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে? যে কোনো দেশে যে কোনো সময় যখন বিদ্রোহের বাষ্প ফেনিয়ে ওঠে তখন বিদ্রোহের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি খতিয়ে দেখার কোনো সুযোগ থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ বেপরোয়া জনতা হয়ে ওঠে। তাদের আবেগি আচরণের ফসল কার ঘরে যাবে সে সম্পর্কে তারা মাথা ঘামায় না। কোনো দেশে প্রতিষ্ঠিত রাজা কিংবা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কোনো একটি রাজনৈতিক শক্তি বিদ্রোহ করার জন্য নিয়ত বাঁধলে সাধারণ মানুষকে তারা তাদের পক্ষে টেনে নেয়। সে দেশের সাধারণ মানুষ যারা শক্তি প্রয়োগ এবং সুবিধা ভোগের বৃত্ত ছুঁতে পারে না তারা সরল বিশ্বাসে ধরে নেয় প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে যারা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তারা বিদ্রোহী। বিদ্রোহীরা জনগণের সুরে সুর মিলিয়ে বেশ দ্রুত জনগণের বন্ধুর ভূমিকায় ভালো অভিনয় করতে শুরু করে। স্বাভাবিক নিয়মে মানুষ ভাবে, দেশে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহের ডাক দিচ্ছে তারা নিঃস্বার্থ চিন্তায় মজে গিয়ে জনস্বার্থে সেটি করছে। বিদ্রোহীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ব্যাপারে মানুষের মনে কোনো দ্বিধা থাকে না বলে সাধারণ মানুষ অনেকে মার খেয়ে অনেকে মরে গিয়ে রাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটায়। মানুষ একে গণতন্ত্রের বিজয় বলে উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে। দিনের শেষে তারা ঘরে ফিরে হাতের মুঠা খুলে দেখে ওটি শূন্য রয়ে গেছে। আমার মনে হয়, যে কোনো দেশে সেই সমাজে দুই দল মানুষ দুটো বৃত্তের মধ্যে বাস করে। পৃথিবীর সব দেশে বড় এক বৃত্তের মধ্যে বড় একদল মানুষ বাস করছে যারা খেটে খায়। খেটে খাওয়ার দলে স্থায়ীভাবে খেটে খাওয়ার তকমা সাঁটা আছে। এরা আক্ষরিক অর্থে একদল। এ দলে কখনো ভাঙন ধরে না কারণ এখানে মৌরসি পাট্টা বলে কিছু নেই। আরেক দল মানুষ ছলে-বলে-কৌশলে লুটে খেতে ওস্তাদ। লুটে খাওয়া বাহিনী যতক্ষণ একসঙ্গে মিলেমিশে ক্ষমতার মধু খায় তখন সে দেশে চারদিকে শান্তি! শান্তি! লুটে খাওয়া বাহিনীর মধ্যে ভাগাভাগির ফ্যাঁকড়া থাকার কারণে এদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রবল।

এই লুটে খাওয়া বাহিনী মরুভূমির গিরগিটির মতো বহুরূপী। প্রতিষ্ঠিত রাজা কিংবা স্বৈরাচারীর চারপাশে ঘুরপাক খেতে গিয়ে এদের নিজেদের মধ্যে ঠোকাঠুকি বেধে গেলে এদের রং বদলাতে সময় লাগে না। এরা তখন সুবিধাভোগী বিপক্ষ দলকে হারিয়ে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। লুটে খাওয়া বাহিনীর অন্তঃকলহ চরম রূপ নিলে ক্ষমতার পালাবদলের প্রয়োজন দেখা দেয়। ক্ষমতার পালাবদলের জন্য গণআন্দোলনের দরকার আর আন্দোলনকে সফল করার জন্য খেটে খাওয়া বাহিনীকে পাশে টানতে হয়। ক্ষমতার গণেশ উল্টে দিয়ে নিজের হাতে সব বুঝে নেওয়ার জন্য লুটে খাওয়া বাহিনীর এক অংশ গণতন্ত্রের অবতার সেজে বসে। গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে নতুন নেতারা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরে ঘরে ফিরে যাওয়া খেটে খাওয়ার দল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হায়রে কপাল! যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ! আমি কোনো একটি দেশ কিংবা সেখানকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করছি না। বর্তমান সময়ে সারা দুনিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সবাইকে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখতে বলছি। আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোয় এখন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার বদল হতে দেখা যায় না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেখানে জনগণের ইচ্ছায় সরকার গদিনশিন হয় অথবা জনগণের ইচ্ছায় সরকার গদি থেকে পড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে ভেনেজুয়েলার ঘটনাপ্রবাহ একটু পরখ করে দেখুন। ওখানে সরকার বদলের হুমকি-ধমকি, ঘটনা-দুর্ঘটনা দেখে মনে হয় সামরিক শক্তির অস্ত্রের ঝনঝনানির চেয়ে আরও বড় কোনো শক্তি রাজনীতির মঞ্চের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পর্দার আড়ালে বসে অদৃশ্য শক্তি মঞ্চের ওপর পুতুল নাচাচ্ছে। এক দল মানুষ রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। তারা ভাবছে, যেমনি নাচায় তেমনই যদি না নাচি তাহলে কী করে খাব। রাজনীতিকে যারা পেশা হিসেবে নিয়েছে সেই মানুষগুলো জানে তারা কর্মহীন উদ্যমহীন প্যারাসাইট। রাষ্ট্রক্ষমতার গায়ে সেঁটে থাকতে পারলে কোনো দিন তাদের খেটে খাওয়াদের দলে ভিড়তে হবে না। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তাদের হাতে বাঁধা থাকবে।

রাজনীতিকরা জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে রাজনীতিচর্চা করছে পৃথিবীর কোনো দেশের মানুষ এ কথা আর বিশ্বাস করে না। এ অবিশ্বাস দুনিয়ার সব দেশের খেটে খাওয়া মানুষকে ক্রমাগত রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমা দুনিয়ায় দুই শতাব্দী আগে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে বলে দুনিয়া এত দিন বিশ্বাস করত। কিন্তু সেসব দেশে গণতন্ত্রচর্চা আগের মতো সরল রেখায় চলছে তা এখন বিশ্বাস করা কঠিন। ইউরোপ-আমেরিকায় সরকার বদলের গণতান্ত্রিক পথ দিন দিন জটিল-কুটিল রূপ নিচ্ছে সেটা সবাই অনুমান করতে পারে। ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে-পরে যেসব বিষয়ে বিতর্কের জন্ম হয়েছে তাতে মনে হয় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে অচল হয়ে পড়ছে। দুনিয়াব্যাপী অর্থনীতির চাকা যারা ঘোরাচ্ছে তারাই রাজনীতির চাকা সফলভাবে ঘোরাতে সক্ষম এই সত্য মানুষ জেনে গেছে। সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী গণতন্ত্র নামের পর্দার আবডালে কী কুটিল খেলা খেলছে দুনিয়ার মানুষের কাছে এখনো তা ঝাপসা হলেও মানুষ বোঝে ক্ষমতার পালাবদলের সক্ষমতা গণমানুষের হাতে নেই। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা নয়, বরং গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা দুনিয়াব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে চলেছে। গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থার বিপরীতে আস্থা রাখার মতো কোনো শাসন-পদ্ধতি নিয়ে নতুন যুগের মানুষকে নতুন করে ভাবতে হবে। আমি আশা করি, নতুন প্রজন্ম ঘুণে ধরা গণতন্ত্র নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নতুন কোনো শাসন-পদ্ধতি উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগী হবে। নতুন প্রজন্ম নতুন প্রযুক্তির যোগাযোগের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগের শক্তি অনেক। তারা সেই শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য নিশ্চয়ই সক্রিয় হবে। হিটলার বলেছিল, ৩০০ গাধা একত্র করলে একটা ঘোড়া হয় না। হিটলার নেতিবাচক মানুষ। সে গাধার সন্ধানে ফিরে সব নস্যাৎ করেছে। আমি তার কথাকে ইতিবাচকভাবে উল্টে দিয়ে ভাবতে চাই ৩০০ ঘোড়া একত্র হলে ভালো কিছুর জন্ম হতে সময় লাগবে না। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীর নতুন প্রজন্মের মধ্যে মহৎ কিছু করার প্রতিশ্রুতি আছে। তারা চাইলে স্বচ্ছ সুশাসন-পদ্ধতির জন্ম দিতে পারবে; যা নষ্ট হয়ে যাওয়া গণতন্ত্রের বিকল্প পদ্ধতি বলে কার্যকর প্রমাণিত হবে।           

     লেখক : কথাসাহিত্যিক।

 

সর্বশেষ খবর