বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু সর্বজনীন নয় কেন এখনো

অধ্যাপক জীবেন রায়

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু সর্বজনীন নয় কেন এখনো

১৯৬৯ সালে নটর ডেম কলেজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। অধ্যাপক মোকারম হোসেন ছিলেন রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান। উনি আবার আমার কাকা হরিপ্রসন্ন রায়ের ছাত্র ছিলেন, কাজেই প্রিয় পাত্র হয়ে গেলাম। তখনকার ঢাকা হলে থাকতে গিয়ে তাঁর একটা সিগনেচার নিতে গেলাম।

কী ব্যাপার, তুমি জগন্নাথ হলে থাকছ না কেন? স্যার জিজ্ঞেস করলেন।

আমি বললাম, ঢাকা হল তো কসমোপলিটান হল, তাছাড়া বেশ কজন খ্রিস্টান ছাত্র আছে। হিন্দুও একজন আছে। আমি ন্যাথনিয়েল দাশের (আমার মৃদুলদা) কাছে ভর্তির আগে থেকেই ঢাকা হলে থাকতে ছিলাম। এই হলেই থাকাকালে এনএসএফ, ছাত্রলীগ, জাসদ, ছাত্র ইউনিয়ন-সব পার্টির ছাত্রনেতাদের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে। কিন্তু কোনো দলেই যোগ দিইনি। তবে ছাত্র ইলেকশনে ভোট দিয়েছি। এক কথায় বলা চলে প্রতিটি দলই আমার ভোট পেয়েছে। আমার বক্তব্যটা হলো আমার অবস্থান পুরোপুরি নিরপেক্ষ। ছাত্রলীগ করিনি, আওয়ামী লীগও করিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিল একম এবং অদ্বিতীয়, আমার কাছে।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের জাতির জনক আর কেউ নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ট্র্যাজিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুই ছিল বাংলাদেশের প্রাণ এবং বঙ্গবন্ধুর নামেই সবকিছু চলত। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশ নানা ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে আজ প্রায় ৪৯ বছর পেরিয়ে গেছে। জন্ম থেকে প্রায় ৫০টা বছর তো বাংলাদেশেই কাটিয়েছি। কত রক্তপাত, কত উত্থান-পতন চোখের সমান্তরাল চলে গেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা জাতি, বীর বাঙালি জাতি, আবার অকৃতজ্ঞ জাতি, প্রতিশোধপরায়ণ জাতি।

তারপরও বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এবং অবশ্য আমার জন্য পীড়াদায়ক, বাংলাদেশে জাতির জনক হিসেবে সব রাজনৈতিক দল বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেয় না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না বঙ্গবন্ধু না থাকলে বাংলাদেশই হতো না। ব্যতিক্রম শুধু বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। উনি অনেক কাল ধরে আওয়ামী লীগ করেন না। নিজেই দল করেছেন। আওয়ামী লীগের বিরোধিতাও করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্য শুধু জাতির পিতা নয়; বঙ্গবন্ধুই সমস্ত ধ্যান ধারণা। তাহলে অন্য দলগুলোর অসুবিধাটা কোথায় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতে, তাঁর আদর্শ মানতে হবে, আমি তা বলছি না; জাতির পিতার সম্মানটা অন্তত দিন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এবং দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জাতির জনক হওয়ার জন্য সেটা অন্তরায় হওয়ার কথা নয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই ধরুন। মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতির জনক। তিনি এক সময় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন এবং এক সময় কংগ্রেস দলের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। এই যে কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দল, বিজেপি অনেক কাল ক্ষমতায় আছে, তারা কি গান্ধীজিকে অস্বীকার করছে?

ভারতে কোনো দলই কি এখন মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণ করছে? অবশ্য সময় বদলেছে, গান্ধীর আদর্শ হয়তো অচল। কিন্তু জাতির জনকের সম্মানটা তাঁর প্রাপ্য। বিজেপি হয়তো তাই করছে। তাতে করে বিজেপির ভোট কমে যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ রক্তক্ষয়ী দেশ। সেই রক্তক্ষয় অনেক কাল চলেছে। তারপরও যখন রক্তের হিমোগ্লোবিন সঠিক মাত্রায় থাকে, তখনো তো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ আসে, বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিন আসে, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন আসে, আসে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিন। যে সব দল বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে চান না, তারা একদিন বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। সে সব দল কেন বলছে না যে বঙ্গবন্ধু কারও সম্পত্তি নয়। আমরাও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ছিলাম একদিন। রাজনীতি করতে গেলে হয়তো কিছু কিছু বিষয় দলের আদর্শের বাইরে গিয়ে করতে হয়। ভারতের বিজেপি হয়তো গান্ধীজির নীতি তো মানেই না বরং উল্টো।

সত্যি কথা বলতে কী, আওয়ামী লীগও হয়তো কখনো কোনো ইনিশিয়েটিভ নিয়ে চেষ্টা করেনি বঙ্গবন্ধুকে সবার কাছে উপস্থাপন করতে। কিছু বিষয়ে ছাড় দিয়ে সম্মিলিতভাবে নিরপেক্ষ অনুষ্ঠান করা যায় যেখানে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কের বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু এখন আর বেচাকেনার বিষয় নয়। দল ক্ষমতায় যাবে আবার চলে যাবে কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে চিরস্থায়ী আসনে বসানো উচিত। আমার মনে হয় একজন মানুষই সেই কাজটি করতে পারেন, তিনি হচ্ছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।

লেখক : বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র

ইমেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর