বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

মদিনার মসজিদে নববী ও ভ্রাতৃত্ববোধের বিশ্বায়ন

হোসেন আবদুল মান্নান

মদিনার মসজিদে নববী ও ভ্রাতৃত্ববোধের বিশ্বায়ন

মাহে রমজানকে সামনে রেখে ওমরাহ পালনের ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম অনেক আগেই। মক্কার কাবা ঘর তাওয়াফ  করা, নামাজ আদায় করা, মদিনা সফর করা, মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ার কৌতূহল মুসলমান মাত্রেরই আছে বলে মনে করি। চট্টগ্রামে চাকরিকালীন সময়েই আমার এমন সিদ্ধান্ত। তখন অবশ্য সস্ত্রীক হজের নিয়তে ছিলাম। যা আর কখনো সম্ভব হয়ে উঠবে না। অবশেষে গত সপ্তাহে ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইনসের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম হয়ে জেদ্দায় আসি। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও আমার বন্ধু মোস্তফা কামালের আন্তরিক সহযোগিতা তথা তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার কারণে মক্কা-মদিনায় যাতায়াতসহ ওমরাহর আনুষ্ঠানিকতা সহজেই সম্পন্ন করা সম্ভব হলো। মোস্তফা একাধিকবার হজ ও ওমরাহ পালনকারী এক অসাধারণ ধার্মিক, সৎ, দীনি, পরোপকারী ও সজ্জন মানুষ। যিনি বর্তমান সমাজের জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর আত্মীয়স্বজন শুভাকাক্সক্ষীসহ জেদ্দা থেকে জিপে করে মক্কায় গিয়ে যথারীতি কাবার ঘর তাওয়াফ করা হলো। জেদ্দা শহর থেকে পবিত্র মক্কা ও কাবার দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। উল্লেখ্য, জেদ্দায় কনসুলেট জেনারেল অফিসে কর্মরত প্রশাসন সার্ভিসের কয়েকজন অনুজপ্রতিম কর্মকর্তার আমন্ত্রণে সেখানে যাওয়ারও সুযোগ হলো। বিদেশে তাদের চাকরিজীবন এবং স্বদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা লাভ করা গেল। মক্কা থেকে ৫০০ কিমি রাস্তা সড়ক পথে পাড়ি দিয়ে পাঁচ ঘণ্টায় মদিনায় পৌঁছে যাই। মরুপথে সড়ক যোগাযোগের বিস্ময়কর উন্নয়ন সবারই নজর কাড়ে। চলন্ত গাড়ি থেকে দুই পাশে তাকালে রোদের মরীচিকাকে নদীর তরঙ্গ মনে হবে। বৃক্ষহীন ঊষর-বিরান পাহাড়কেও তারা ক্রমাগত আলো ঝলমলে করে তুলেছে। মদিনা আসলে চমৎকার এক শহরের নাম। চারদিকে পাহাড়ের বেষ্টনীর মধ্যে বিস্তৃত সমতল এলাকায় এ শহর গড়ে উঠেছে। গানে গীতিতে বলা হয়, সোনার মদিনা বা মদিনা মনোয়ারার স্তুতি। এখানকার ভবনগুলোর স্থাপত্যের শৈল্পিকতা যে কোনো চক্ষুষ্মানের দৃষ্টিতে পড়তেই হবে। মদিনা এখন নান্দনিক অট্টালিকায় ঘেরা হোটেলের শহর। মহানবী (সা.) স্বয়ং এর নাম দিয়েছিলেন মদিনা। মদিনা অর্থই নাকি শহর বা নগর। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহে মসজিদে নববীতে লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে বেশ কয়েক ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার সুযোগ পেয়েছি। এ বিশাল মসজিদ যেন সোনায় মোড়ানো কারুকার্যে ভাস্বর এক জ্যোতির্ময় বিশ্বপ্রার্থনালয়। ভিতরেই একপাশে মহানবী (সা.) এবং সাহাবিদের রওজা রয়েছে। রমজান মাস থাকায় মুসল্লির সংখ্যা অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। বিদেশি দু-চারজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি বেলায় অন্তত ১০ লাখ মানুষ একসঙ্গে এখানে নামাজ আদায় করছেন। ১৫ মার্চ রাতে তারাবি পড়তে গিয়ে দেখলাম, মসজিদের ছাদের ওপরেও লাখ মানুষ নামাজ পড়ছেন, যা নিচতলা থেকে ধারণা করা সম্ভব নয়।

আহা! মানুষের কী প্রাণময় গতিময়তা, বানের জলের মতন চারদিক থেকে গড়িয়ে আসছে মসজিদের অভিমুখে। আজানের আগেই শতাধিক গেট দিয়ে তসবি হাতে প্রবেশ করছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ।

মাহে রমজানে মহান আল্লাহর নৈকট্য ও করুণা ধারায় সিক্ত হতে চাচ্ছেন প্রতিটি মানুষ। ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে প্রতিবেলায়ই আমার দু’পাশের মানুষকে নামাজের ফাঁকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি, ‘তিনি কোন দেশ থেকে? সাক্ষাৎ পেয়েছি, মরক্কো, মিসর, স্পেন, তিউনিসিয়া, পাকিস্তান, ভারত, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, কাজাখস্তান ইত্যাদি দেশের মানুষের। শত শত বছর ধরে পৃথিবীর দেশে দেশে বসবাসকারী মুসলিমগণ একান্ত আগ্রহে কাবাঘর এবং রসুলের রওজা জিয়ারত করতে আসছেন। ওমরাহ এবং জিয়ারত এখন সারা বছরই চলমান আছে এবং আশা করা যাচ্ছে, অনন্তকাল ধরে মানুষের এই গমনাগমন চলমান থাকবে।

৩. ভাবছিলাম কী বিচিত্র আর বিমূর্ত ভালোবাসার এই দুনিয়া! নানা বর্ণের, নানা ভাষার, নানা জনপদের মানুষের ঐক্যবদ্ধ মিছিল। কেউ ধবধবে ফর্সা, কেউ শ্যামলা বা গাঢ় কালো, কেউ দীর্ঘকায়, কেউ খর্বকায়, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক যুবতী, শিশু সবার মুখে একই রব লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বা আল্লাহ আকবর বা রমজানুল মুবারক। প্রত্যেকেই একে অপরকে প্রাণভরে সহযোগিতা করে চলেছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমজম পানি সরবরাহ করছেন, নিজের ইফতার ভাগাভাগি করে খেয়ে আনন্দ লাভ করছেন। সবাই যেন অভিন্ন এবং আপন ভুবনের মুসলমান ভাই ভাই। সমবেত মানুষগুলোর সবার গন্তব্য ও ঠিকানা যেন এক। নামাজ আদায়, মনে মনে জিকির করা, রওজা মোবারক, জান্নাতুল বাকি দর্শন, ঐতিহাসিক স্থান পরিদর্শন, স্ব স্ব পবিত্রতা বজায় রেখে চলা ইত্যাদি। কোথাও কোনো ব্যত্যয় ঘটার অবকাশ নেই। একজনও স্বেচ্ছাসেবক বা পুলিশের সঙ্গে তর্কে-বির্তকে জড়াচ্ছেন না। এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, একসঙ্গে ১০-১২ লাখ মানুষ পিনপতন নীরবতায় ইফতার সম্পন্ন করে নামাজ আদায় করতে পারেন। কারও প্রতিবাদ নেই, পরিচয় নেই, সর্বত্র দৃশ্যমান সুশাসনের আবহ বিরাজমান। অভাবনীয় ট্রাফিকিং ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বোঝা যায়, কেবল ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে মাত্র সাড়ে তিন কোটির কাছাকাছি মানুষ প্রায় ২২ লাখ বর্গকিলোমিটারের বিশাল রাষ্ট্র ও লক্ষ কোটি নন আরবকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন। মসজিদে নববীতেও আইনের প্রয়োগে সবাই সমান সমান, কেউ কমবেশি নন। মানুষের এমন নিঃস্বার্থ নিমগ্ন ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ববোধের নমুনা স্বচোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।

বিশ্বাসী মুসলমানদের অন্তহীন এ যাত্রা পৃথিবীর সমান সময় অবধি চলুক।

৪. শেষ দিনে মদিনা শহরের আরও কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান দেখার সুযোগ চলে আসে। সকালের দিকে বিমানের ট্র্যাভেল এজেন্সির ইনচার্জ মামুন এমন ব্যবস্থা করে দেয়। মামুনরা মানিকগঞ্জের হলেও সে জন্মগতভাবে মদিনার বাসিন্দা এবং এখানকার ছাত্র। বয়সে তরুণ হলেও অসাধারণ ধার্মিক, পরিশ্রমী ও মানবিক। আমরা তার গাড়িতে মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যাই। একই সঙ্গে নবীজির উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের স্থান পরিদর্শন করি। মদিনা শহরের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করার মতোন চমৎকার একটি স্পটে গিয়ে হাজির হই। সে বলল, এখানকার কিছু পাহাড় জান্নাতি আর কিছু জাহান্নামে যাবে। এগুলোকে সে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখাল।

মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তোরণ দিয়ে প্রবেশ করে হালকা হলদে বর্ণের ক্যাম্পাস, একাডেমিক ভবন, ফ্যাকাল্টিসমূহ, ছাত্রছাত্রীদের হল ও পৃথক আবাসিক এলাকা দেখে বিমোহিত হওয়ার মতো। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এটা এখন পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বত্র সুনসান শতভাগ একাডেমিক পরিবেশ বিদ্যমান। শুনেছি, কর্তৃপক্ষ এশিয়া এবং আফ্রিকার গরিব মেধাবী ছাত্রদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব তথা বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে ভর্তির ব্যবস্থা করছেন। কিছু কৃষ্ণকায় আফ্রিকান ছাত্রের পদচারণও চোখে পড়ে। মনে হলো, তাঁরা ইসলামী মূল্যবোধ, কম্পিউটার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মেধার অন্বেষণ প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত অগ্রসরমান। মানুষের পৃথিবীর ধাবমানকাল এদেরও করতলে থাকুক।

                লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর