এইতো কয়েক দিন আগে রাজধানীর শেওড়া পাড়ায় আমার এক ছোট বেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেলে ভাবি বললেন, চৌধুরী ভাই বসেন; আপনার বন্ধু বাজারে গিয়েছেন। অল্পক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ঠিকই সাপ্তাহিক বাজারের বিশাল বহর নিয়ে হাজির। বস্তুত বন্ধুটি বেশ অবস্থাপন্ন। মনে হলো সবমিলে প্রায় ৬-৭ হাজার টাকার বাজার করেছে। মজার ব্যাপার হলো যে আসার পরপরই ভাবির প্রথম কথা, লটকন কোথায়? গত সপ্তাহেও তো আনোনি। ভাবি যে মুখরা তা আগেই জানতাম। তাই ভাবলাম, আজ যে কী ধরনের ঝড় ওঠে, তা আল্লাহই জানেন। সত্যিকারার্থে আমার সামনেই লটকনের জন্য বন্ধুটিকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ল। আমি পরিবেশটি নাজুক দেখে বিশেষ একটি অজুহাত দেখিয়ে দ্রুত কেটে পড়লাম।
ফিরে আসার পথে ভাবতে লাগলাম এক কালে আমাদের দেশে এটি অপ্রচলিত ফলের তালিকায় ছিল। কিন্তু এখন আর তা নয়। বলতে গেলে সবার কাছেই প্রিয়। বর্তমানে মৌসুমি ফল সংস্কৃতির তালিকায় এটি বিশেষ অবস্থান নিয়ে আছে। আসলে ফলটি মুখরোচক এবং দেখতেও দৃষ্টিনন্দন। মূলত এটি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাকাউরিয়া মতলিয়ানা প্রজাতির ফল। তুলনামূলকভাবে ছায়াযুক্ত স্থানে এটি ভালো জন্মে। এই বৃক্ষ দক্ষিণ এশিয়ায় বুনো গাছ হিসেবে জন্মালেও বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয়। এক সময় এটি ছিল একটি উপেক্ষিত ফল, তবে অধুনা বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক আকারে উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে উন্নত জাতের সুমিষ্ট লটকনের চাষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর জনপ্রিয়তাও বেশ বেড়েছে এবং বলতে গেলে ধনী-গরিব সব পরিবারেই সমভাবে প্রিয়। তথ্যমতে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের নরসিংদীতেই লটকনের ফলন বেশি। এ ছাড়াও সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাজীপুরসহ অনেক জনপদেই ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে লটকন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো যে, সনাতনি ধর্মের রথযাত্রার সঙ্গে বিশেষ ফল হিসেবে লটকন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এদিকে অঞ্চল ও দেশ ভেদে মৌসুমি ফল লটকন বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন হাড়ফাটা বুগি, ডুবি, বুবি, কানাইজু, লটকা, লটকাউ, কিছুয়ান, আশফুল, ইত্যাদি।
কিছুটা ডুমুরের ন্যায় গাছের গুঁড়ি ও ডালে থোকায় থোকায় জন্মে লটকন। শক্ত খোসার আবরণে ঢাকা থাকে সম্পূর্ণ ফলটি। কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হলুদ হয়। এর ভিতরে রয়েছে তিন থেকে চারটি দানা। এই দানা বা রসালো শাঁসগুলো মূলত দুটি রঙের হয়ে থাকে; হাল্কা লাল এবং গোলাপি মিশ্রণ। সাধারণত এই ফলের আকার ২ থেকে ৫ সেমি হয়ে থাকে এবং স্বাদ টকমিষ্টি হলেও বেশ সুস্বাদু মুখে নিলে এতটাই তুলতুলে মনে হয় যে এখনই গিলে ফেলি। মূলত এই ফলটি জুন এবং জুলাই মাস ধরেই পাওয়া যায়। আর এর বংশবিস্তার দুই ভাবে হয়ে থাকে। বীজ ও কলম পদ্ধতিতে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে লটকনের পুরুষ ও স্ত্রী-গাছ পৃথক হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হলো যে বীজ দ্বারা বংশবিস্তার করলে স্ত্রী গাছের চেয়ে পুরুষ গাছের সংখ্যা বেশি হয় এবং ফল পেতে প্রায় পাঁচ থেকে সাত বছর সময় লেগে যায়। কিন্তু কলম পদ্ধতি ব্যবহারে তিন বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া এই গাছ খাটো হয় বলে ফল তোলা সহজ হয়ে থাকে। সাধারণত একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ থেকে গড়ে ১০০-১৫০ কেজি ফল পাওয়া যায়। বস্তুত এই বৃক্ষ ৯-১২ মিটার লম্বা হয়। এর কাণ্ড বেটে এবং উপরাংশ ঝোপালো এবং পূর্বেই বলেছি যে পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদা। শুধু তাই নয়, আলাদা ধরনের হলুদ ফুল হয় এবং উভয় রকম ফুলই সুগন্ধিপূর্ণ। সত্যি কথা বলতে কী, এই দৃষ্টিনন্দন হলুদ বর্ণের ফল দেখলেই সহজেই জিহ্বায় পানি আসে। কিছুটা মরিচ ও লবণ মিশ্রিত করে খেলে এই স্বাদ বলতে গেলে সারা শরীরে জানান দেয়। অনেকে আবার লবণ, লেবুর রস আর সঙ্গে মরিচ ও চিনি মাখিয়ে লটকনের ভর্তা তৈরি করে খেয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে জ্যামও তৈরি করা হয়। যেহেতু এই মৌসুমে আর্দ্রতাসহ বেশ গরম থাকে। সেহেতু এর স্বাদ আবহাওয়া গত কারণে আরও বৈচিত্র্য করে তুলে। এদিকে কাঁচা আর পাকা লটকন চেনার ব্যাপারে পূর্বেই কিছুটা আলোকপাত করেছি। এ সূত্র ধরে উল্লেখ্য যে, যখন ফলগুলো দেখতে তুলনামূলক সবুজ। তখন খাবারের যোগ্য হয়নি বলে মনে করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক