জুলাই তাণ্ডবের ক্ষত পেছনে ফেলে আস্তে আস্তে কর্ম চাঞ্চল্যে মুখরিত হচ্ছে দেশ। এক সপ্তাহের নাশকতা এবং ধ্বংসস্তূপের ক্ষত নিয়েই চিরচেনা রূপে ফিরেছে রাজধানী। কারফিউর সময় কমিয়ে আনা হচ্ছে ধীরে ধীরে। বন্ধ ইন্টারনেট সেবা চালু হয়েছে। জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে জনগণ। এসব দেখেশুনে অনেকেই মনে করতে পারেন, সবকিছু এখন ঠিকঠাক। আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কেউ কেউ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভাবছেন ‘খেলা শেষ’। আবার বিরোধী দল পরাস্ত হলো। আবার আত্ম তুষ্টিতে সব ভুলে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন কেউ কেউ। কারও কারোর মধ্যে অহংকারের সেই পুরনো চেহারা ফিরে এসেছে। ক্ষমতায় থাকা অনেকেই বলতে শুরু করেছেন ‘আমরা অপরাজেয়’। সরকার এবং আওয়ামী লীগ যদি এ ভ্রান্তিতে আচ্ছন্ন হয় তাহলে বলতেই হয়, ভুল করছেন। আন্দোলন বা ষড়যন্ত্র যেটি বলুন না কেন তা শেষ হয়নি। শুরু হয়েছে মাত্র। সামনে আরও কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে সরকারের জন্য। ক্ষমতাসীন দলের জন্য।
‘খেলা হবে’ কথাটি এখন বহুল চর্চিত। আওয়ামী লীগের এক জাদরেল নেতা উক্তিটিকে অতি কথনের মাধ্যমে রীতিমতো শব্দদূষণে পরিণত করেছেন। যে কোনো খেলার যেমন শুরু আছে, তার শেষও আছে। ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা অন্য খেলার একটা সুনির্দিষ্ট সময়সীমা আছে। যেমন ফুটবল খেলা হয় ৯০ মিনিট। ক্রিকেটের টি-২০ বিশ ওভারের খেলা, ওয়ানডে ৫০ ওভারের। কিন্তু রাজনীতির খেলা সার্বক্ষণিক, নিরন্তর। এই খেলার নানা রকমফের। এ খেলার কোনো বেঁধে দেওয়া সময়সীমা নেই। রাজনীতির খেলা কখনো সামনে দৃশ্যমান থাকে, কখনো অদৃশ্য। ফুটবলে শেষ মুহূর্তের গোলে যেমন ফলাফল নির্ধারিত হতে পারে, তেমনি ক্রিকেটে শেষ বলে এক ছয় বা একটি উইকেটে পাল্টে দিতে পারে ফলাফল। রাজনৈতিক খেলারও রং পাল্টে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। রাজনীতিতে একটি ছোট ঘটনা ওলটপালট করে দিতে পারে সব হিসাব-নিকাশ। আবার একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি বদলে দেয়। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনীতি হলো জোয়ার-ভাটার মতো। এখানে জনপ্রিয়তা আর ঘৃণা পায়ে পায়ে হাঁটে। প্রচণ্ড জনপ্রিয় নেতা এক লহমায় গণশত্রুতে পরিণত হন। আবার একটি ঘটনা জন্ম দেয় নতুন নেতার। এ অঞ্চলের মানুষ প্রচণ্ড আবেগপ্রবণ। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তির চেয়ে আবেগ প্রাধান্য পায়। এ উপমহাদেশে তাই যুক্তিবাদী, দার্শনিক মিতভাষী রাজনীতিবিদদের চেয়ে অনলবর্ষী বক্তাদের নেতৃত্বের সামনে দেখা যায়। রাজনীতিতে এখানে অনেক কিছুই ঘটে আচমকা। আমরা যা ভাবী তা সবসময় হয় না। এজন্যই এ উপমহাদেশে বা বাংলাদেশে রাজনীতিকে ‘ম্যাজিক’ বলেন অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। যেমন, গত বছর অনেকেই ভাবতে পারেননি বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে দেশে শেষ পর্যন্ত একটি নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এরকম মানুষ কমই ছিলেন, যারা মনে করতেন, নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ বসে থাকবে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এবং ১১ জানুয়ারির সরকার গঠনের পর অভিনন্দনের বৃষ্টিতে সিক্ত হয় টানা চতুর্থবারের মতো দায়িত্ব গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ সরকার। বিদেশে রাষ্ট্রদূতরা ধরনা দিতে থাকেন সদ্য দায়িত্ব পাওয়া মন্ত্রীদের দপ্তরে। বিএনপি তখন হতাশার সাগরে নিমজ্জিত। দলটির অস্তিত্ব সংকট নিয়ে চর্চা হতে শুরু হয় সর্বত্র। এ সময় আওয়ামী লীগের স্বস্তির মধ্যে কি কেউ শঙ্কার এতটুকু মেঘ দেখেছিল? দলের কোন্দল হানাহানি, কিছু ব্যক্তির সীমাহীন দুর্নীতি, দলের সাংগঠনিক ভঙ্গুর অবস্থা নিয়ে কজন উদ্বিগ্ন ছিলেন? সারা দেশে যখন আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে হানাহানি, কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত তখন সেগুলোকে উপেক্ষা করে শীর্ষ নেতারা বিএনপিকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরায় সময় কাটিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল মধ্যাহ্নে দলের সাধারণ সম্পাদকের অপ্রয়োজনীয় সংবাদ সম্মেলন। তখন কি আওয়ামী লীগ ভেবেছিল, মধ্য জুলাইয়ে এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে? জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই ভাবতেন তারা অমর। সরকারকে টোকা দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। এজন্যই ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপির মতো ইস্যুগুলো আমলে নেয়নি অনেকে। বরং ‘সব ঠিক আছে’-এমন এক ঘোর সরকারকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত করানো হলো পরিকল্পিতভাবে, তখনো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংকটের ন্যূনতম গভীরতা উপলব্ধি করতে পারেননি। তার এক ঘোষণাতেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড়াল ছাত্রলীগ। এটি ছিল জুলাই তাণ্ডবের টার্নিং পয়েন্ট। একটি ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যে সংকটকে কোন বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে, ১৫ জুলাই তার সাক্ষী। ১৬ জুলাই থেকে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের বীর পুরুষরা কেউ মার খেয়েছেন, কেউ পালিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যদি দ্রুত সেনা মোতায়েন এবং কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত না নিতেন তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতো। ভাগ্যিস আমাদের একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন যিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো জনবিচ্ছিন্ন নন। বাস্তবতাকে উপলব্ধি করেন। সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে উন্নতি হতে শুরু করে। কিন্তু সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার নীলনকশা এখনো বহাল আছে। ষড়যন্ত্র থামেনি। বিরোধী পক্ষ এখন ভিন্ন কৌশলে। তারা সরকার ও আওয়ামী লীগের দুর্বলতাগুলোকে ধরে ফেলেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন আর কোটার মধ্যে নেই। এ ইস্যুর বহু ডালপালা চারদিকে পল্লবিত হয়েছে। যারা বর্তমান সরকারের পতন চায়, তারা বুঝে গেছে শিক্ষাঙ্গনকে উত্তপ্ত করতে পারলেই দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি সহজ। শিক্ষাঙ্গনের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, মাঠে সেনাবাহিনী। সমস্যা তুষের আগুনের মতো। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে গেছে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেশাদার সন্ত্রাসীরা। একটা কথা বলে রাখা দরকার, জুলাইয়ে সাইবারযুদ্ধে সরকার, আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। ইন্টারনেট চালুর পর ইউটিউব যেন এখন মিথ্যার ঝুড়ি। ইউটিউব যেভাবে জুলাই তাণ্ডবের চিত্রকে একপেশে বিকৃতভাবে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ। শিক্ষার্থী-তরুণরা টেলিভিশন দেখে না, সংবাদপত্র পড়ে না। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকে। সরকার থেকে বলা হচ্ছে ফেসবুক, টিকটক বন্ধ। কিন্তু তরুণরা ভিপিএন বা অন্য কৌশলে ঠিকই ফেসবুকে গুজব, অপপ্রচারগুলো গিলছে। আপিল বিভাগের রায় এবং সরকারের পরিপত্রের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সন্তোষ প্রত্যাশা করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি হয়নি। আবেগপ্রবণ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করার সব মাল-মসলা উগলে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনন্তকাল বন্ধ রাখা যাবে না। সেনাবাহিনীও এক সময় ব্যারাকে ফিরে যাবে। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ বিতাড়িত। সমঝোতা করে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলেও তাদের সত্য কথাগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করবে না। ছাত্রলীগের চেয়েও করুণ অবস্থা আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের। এ শিক্ষকদের বেশির ভাগই দলকানা। পদ-পদবির জন্য নানা দেনদরবার তাদের বেশির ভাগের সময় কাটে। তারা শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হয়ে উঠতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবকতুল্য দল নিরপেক্ষ শিক্ষকরা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এ শিক্ষকরা ‘বিবেকের তাড়নায়’ থানায় গিয়ে তাদের ছাত্রকে মুক্ত করেছেন। ডিবি অফিসে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা সমন্বয়কদের খোঁজ নিতে গেছেন। জামায়াতপন্থি শিক্ষকরাই এ নেটওয়ার্কের উদ্যোক্তা। কিন্তু সামনে এরকম বেশ কজন শিক্ষক আছেন যাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। তারা ক্যাম্পাসে ‘প্রিয় শিক্ষক’। আমি এরকম বেশ কজনকে চিনি যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ, মুক্তচিন্তার মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর তারাও সরকারবিরোধী অবস্থান নেবেন। সবচেয়ে বড় কথা, সব শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দেওয়ার পক্ষে। ক্যাম্পাস খুলতে যত বিলম্ব হবে, তত নতুন বিপদের আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। সুযোগে সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস খোলার দাবিতে শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত করার চেষ্টা করবে। তাই সরকারকে দ্রুত সংলাপের দরজা খুলতে হবে; কিন্তু তরুণ এ শিক্ষামন্ত্রী কি এই সংলাপ সামাল দিতে পারবেন? এখন নিরীক্ষার সময় নয়। সমস্যাটা রাজনৈতিক। রাজনৈতিকভাবেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় ছাত্রবান্ধব নেতাদের দায়িত্ব দিতে হবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশতে হবে। তাদের প্রকৃত অবস্থা বোঝাতে হবে। ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা জুকার বার্গ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘ফেসবুকের চেয়েও শক্তিশালী যোগাযোগমাধ্যম হলো ব্যক্তিগত যোগাযোগ। ব্যক্তিগত যোগাযোগ কমেছে বলেই ফেসবুক জনপ্রিয়।’ প্রত্যেক আওয়ামী লীগ নেতাই কেউ না কেউ কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। প্রত্যেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ শুরু করতে হবে এখনই। জুলাই তাণ্ডবের আড়ালে ষড়যন্ত্রের স্বরূপ তাদের বোঝাতে হবে। নিরপেক্ষ শিক্ষকদের গালাগালি বা রাজাকার বলে দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না। তাদের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে হবে। সরকার বা আওয়ামী লীগের জন্য কাজটা কঠিন না। কিন্তু একগুঁয়েমি করলে, অহংকারে বন্দি হয়ে থাকলে শিক্ষাঙ্গন নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে উঠবে।
এ আন্দোলনের শেষদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্য হয়েছে; কিন্তু এখন খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে জামায়াত এবং শিবির পাঁচ মাস ধরে আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছে। ধাপে ধাপে কর্মীরা ঢুকেছে ঢাকায়। কোটা আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আওয়ামী লীগ অনুধাবনই করতে পারেনি। এখন বিএনপি-জামায়াত সরাসরি এক দফার দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের শক্তি নেই, তারা নিঃশেষ বলে আওয়ামী লীগের নেতাদের পরিহাস ছিল ভুল। এত ঝড় ঝাপটার পরও জামায়াত-শিবির কীভাবে এখনো এত শক্তিশালী তা ভাবতে হবে আওয়ামী লীগকে। বিএনপি শেষ হয়নি, এ সত্য আওয়ামী লীগ যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবে ততই তাদের মঙ্গল। প্রতিপক্ষকে কখনো দুর্বল ভাবতে নেই- জুলাই তাণ্ডবে এ শিক্ষা কি পেয়েছে আওয়ামী লীগ? ক্ষমতাসীন দলের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্ম সমালোচনা, আত্ম উপলব্ধির। সন্ত্রাসী প্রতিপক্ষ এবং ষড়যন্ত্রকারীদের রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য দলের মাঠের নেতা-কর্মীদের সামনে আনতে হবে। সুবিধাবাদী, সুযোগ সন্ধানীদের বাদ দেওয়ার এখনই সময়। যে কোনো সংকট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। জুলাই সংকট আওয়ামী লীগের জন্য একটি শুদ্ধি অভিযানের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর আওয়ামী লীগ যথাযথ প্রতিবাদ করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের ১০০ কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ব্যর্থ, অযোগ্যদের রেখে আওয়ামী লীগ শত্রুর মোকাবিলা করতে পারবে না। ছাত্রলীগ যুবলীগ এখন ধ্বংসস্তূপ। এ দুটি সংগঠনকে নতুন করে গড়তে হবে। পদবাণিজ্য, কমিটিবাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বড় নেতাদের সারা দেশে সফর করতে হবে। কর্মীদের মনোবল চাঙা করতে হবে দ্রুত।
জুলাই নাশকতায় একটি বিষয় পরিষ্কার, তাহলো জনগণের মধ্যে পুলিশভীতি আর নেই। সন্ত্রাসী এবং ছাত্রশিবির-ছাত্রদল পুলিশকে রীতিমতো কোণঠাসা করেছে। পুলিশ আর ছাত্রলীগকে ইদানীং একই চোখে দেখে অনেকে। এটা এ আন্দোলনে বিরোধী পক্ষের একটি বড় প্রাপ্তি। এতে তারা অদূর ভবিষ্যতে আরও সহিংস হয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। সরকার বারবার সংকট মোকাবিলায় সেনা মোতায়েন করতে পারবে না। গণতান্ত্রিক একটি সরকারের জন্য এটা শোভনও নয়। আওয়ামী লীগ যেমন গত ১৫ বছরে হয়েছে পুলিশনির্ভর, তেমনি পুলিশের ভিতরও নানারকম সমস্যা দৃশ্যমান হয়েছে এ সংকটে। অতিরিক্ত রাজনীতিকরণ পুলিশের পেশাদারিত্ব নষ্ট করেছে। আশার কথা পুলিশে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে সবার আগে। ইমেজ পুনরুদ্ধারই এখন পুলিশ বাহিনীর প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এ সংকট প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগ বন্ধুহীন। অন্যদিকে একসময় যারা বিএনপিকে পছন্দই করত না তাদের অনেকেই সরকারের সমালোচক হয়ে গেছে। সামনের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগ সিন্ডিকেট। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মুক্ত চিন্তার সিংহভাগ শুভাকাক্সক্ষীরা দূরে চলে গেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে কাউকে কাউকে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। কোটা আন্দোলনের আড়ালে একটি সরকারবিরোধী নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে আন্দোলনের জন্য এ নেটওয়ার্ক বিপজ্জনক। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যারা গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছিলেন, তারা এ সংকটে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। অনেকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থানের নামে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং শোবিজে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান হয়েছে এ জুলাইয়ে। বিএনপি সারা জীবন যা পারেনি, ছাত্র আন্দোলনের ঝড় সেটা করেছে মাত্র কয়েক দিনে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন চাটুকারের সীমাহীন আবদার মেটাতে সরকার ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। কয়েকজন আমলা, কিছু বুদ্ধিজীবীর একটি ক্ষুদ্র সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, অল্প কজন পেশাজীবীর সিন্ডিকেট ভেঙে সরকারকে সবার বন্ধু হতে হবে। সমালোচনা, ভিন্নমত মানেই ষড়যন্ত্রকারী নয়, এটা আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনা শুনতে হবে। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। জনবান্ধব হয়েই জনপ্রিয়তা বাড়াতে হবে টানা ১৫ বছর ক্ষমতার থাকা আওয়ামী লীগ সরকারকে।
এ সংকটে আবার বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তোলপাড়। এটার কারণও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বাংলাদেশ নিয়ে একপেশে ভিত্তিহীন সংবাদগুলোকে লুফে নিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। নেতিবাচক খবরে সয়লাব বিশ্ব মিডিয়া। সন্ত্রাসীর মৃত্যুকে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু বলা হচ্ছে। বেঁচে থাকা শিক্ষার্থীকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে বলতে হচ্ছে- ‘আমি মরি নাই।’ এর ফলে বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এটি সৃষ্টি করতে পারে নতুন বিদেশি চাপ। এ চাপ দেশে আন্দোলনকে নতুন করে উসকে দিতে পারে। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিএনপির আন্দোলনে নতুন প্রাণ দিয়েছিল। এবার যেন তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, সেজন্য এখনই নজর দিতে হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। প্রকৃত তথ্য সততার সঙ্গে বিশ্ব মিডিয়াকে তুলে ধরতে হবে। মৃত্যু, আহত, গ্রেপ্তারের সঠিক পরিসংখ্যান নিয়মিতভাবে সরবরাহ করার ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতাই গণতান্ত্রিক সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে দক্ষতার সঙ্গে।
ড. ইউনূসসহ সুশীল সমাজের যে অংশ এক-এগারোতে অনির্বাচিত সরকারের প্রধান কুশীলব ছিলেন, তারা আবার সরব। ড. ইউনূস এখন মরিয়া। কোনো রাখঢাক ছাড়া ঝেড়ে কেশে তিনি ক্ষমতার বদল চাইছেন, চাইছেন নতুন নির্বাচন। যুক্ত হয়েছেন অন্য সুশীলরাও। এদিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। রাজপথ উত্তপ্ত করে আরেকটি এক-এগারোর চেষ্টা সামনে আরও বেগবান হবে।
তবে সরকারকে সবচেয়ে মনোযোগ দিতে হবে অর্থনীতি পুনঃরুদ্ধারে। সন্ত্রাসী তাণ্ডবের আগে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো ছিল না। রাষ্ট্রবিরোধী নাশকতায় যে ক্ষতি হয়েছে তা অর্থনীতির সংকটকে আরও গভীর করবে। এতে জনক্ষোভ সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয়। এজন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রীতিমতো যুদ্ধ করতে হবে সরকারকে। অর্থনীতির চেহারা ভালো হলে অন্য সংকট কাটানো সহজ হবে।
জুলাই তাণ্ডব সরকারকে বহুমুখী সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়েছে। দেশের শিক্ষাঙ্গনে অবিশ্বাস, সেশনজট চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি করতে পারে। এটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। নতুন করে অগ্ন্যুৎপাত ঘটার আগেই ক্ষোভ প্রশমন করতে হবে। জনমনের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দ্রব্যমূল্যে, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে ভোগান্তিতে থাকা মানুষের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে। বিরোধীদের ভয় কেটে গেছে, আওয়ামী লীগের দুর্বলতা তারা জেনে ফেলেছে। শ্রেণি-পেশার মানুষের বৃহত্তর অংশ সরকারের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন। তারা ভাবছে এ সরকার মুষ্টিমেয় কিছু চাটুকারের। এখন তারা প্রতিবাদের সাহস পেয়েছে। এভাবে নানা অস্থিরতা সরকারের চারপাশে এখন দৃশ্যমান। সরকার সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে বটে; কিন্তু এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি সংকটে দৃঢ় হন। প্রজ্ঞা ও মেধার সংকট কাটানোর ম্যাজিক তিনি জানেন। আওয়ামী লীগেও অনেক মেধাবী, সৎ জনবান্ধব নেতা আছেন। যারা দায়িত্ব পেয়ে সামনে থেকে কাজ করলে সংকট সামাল দিতে পারবেন অনায়াশে। এখন তাদের সময়। ফুটবলে সুপার সাবরা অতিরিক্ত সময়ে গোল করে সব হিসাব পাল্টে দেয়। আওয়ামী লীগে এখন সুপার সাবদের সুযোগ দেওয়ার সময়। মনে রাখতে হবে খেলা শেষ হয়নি, শুরু হয়েছে মাত্র। প্রতিপক্ষ দুর্বল নয় অনেক শক্তিশালী।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল : [email protected]