সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত ৫৭ জন বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কঠিন শাস্তি দিয়েছে। তাদের অপরাধ, তারা সেই দেশের আইন ভঙ্গ করে বাংলাদেশের সহিংস আন্দোলনকারীদের সমর্থনে বিক্ষোভ করেছে। বিষয়টি সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমবাজার এবং বাংলাদেশি শ্রমিকের ভিসার ব্যাপারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ খবর গণমাধ্যম থেকে পাওয়া। গণমাধ্যমে আরও জানলাম যে একই ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য মালদ্বীপে বসবাসরত বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে যাচ্ছে সেই দেশের সরকার। আরব আমিরাত এবং মালদ্বীপের ঘটনা দুঃখজনক তো বটেই, একই সঙ্গে দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। পরিণাম যে ভালো হবে না তা সাধারণ মানুষ যে কেউ বুঝতে পারবেন।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে আন্দোলন হয়েছে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশে। ঘনিষ্ঠজনদের টেলিফোনে এসব জেনেছি। ভীষণ উৎকণ্ঠা আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে তারা এসব খবর জানিয়েছেন। শিক্ষা গ্রহণ করতে যাওয়া বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন অন্য দেশের সহপাঠীরাও। এটাই স্বাভাবিক। কদিন আগে প্যালেস্টাইন ইস্যু নিয়ে আমেরিকা-ইউরোপে ছাত্রছাত্রীদের সোচ্চার হতে দেখেছি। সেখানে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি বাঙালি শিক্ষকরাও আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। রাতভর ক্যাম্পাসে তাঁবু গেড়ে থেকেছেন, পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করেছেন ইত্যাদি। আমরা দেখেছি, শুনেছি, সমর্থন করেছি। আমাদের ছেলেমেয়েরা প্যালেস্টানিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এবারের চিত্রটি ভিন্ন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এবারের আন্দোলনের নেপথ্যে সহিংসতা হয়েছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। শত শত যানবাহন পুড়েছে। চোরাগোপ্তা হামলায় পুলিশ সদস্য ছাড়াও সাধারণ মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বন্ধ করেছে। জেলখানা ভেঙে জঙ্গি কয়েদিদের মুক্ত করার পাশাপাশি প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বন্ধ ও শিপমেন্ট বন্ধ করে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি করেছে। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে নির্মিত আধুনিক মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকাসহ বিশ্বের বেশ কটি উন্নত দেশ আমাদের পক্ষে ছিল না। কিন্তু সেসব দেশের ছাত্র, শিক্ষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিকরা আন্দোলন-প্রতিবাদ করে বর্বর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এবারের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের টার্গেট ছিল সহিংস আন্দোলনকারীদের স্লোগানে। মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গিরা এবার জ্বালাও পোড়াও এবং চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে একাত্তরের অর্জনকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা করেছে।
তার মানে ধরে নেওয়া যায়, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের সহিংস আন্দোলনের পক্ষে যারা হইচই করেছে তারা প্রকৃত তথ্য না জেনেই রাস্তায় নেমেছে। অথবা কোনো দুষ্টচক্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল তথ্য দিয়ে তরুণ-যুবাদের গরম রক্ত আরও বেশি টগবগ করিয়েছে। আমার কাছে দ্বিতীয়টা গ্রহণযোগ্য মনে হয়। দেশাভ্যন্তরে প্রলয়ংকরী লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে জুলাই মাসের বেশ কয়েকটি দিন ধরে। তার পেছনে অপরাজনীতি এবং অর্থ জোগানোর তথ্য তো সরকারি-বেসরকারি মাধ্যম থেকে শোনাই যাচ্ছে। রাষ্ট্র এবং সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের কথাও এখন আর অজানা নেই। লবিস্ট নিয়োগে বিশাল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপারটি এখন চায়ের দোকানের নিয়মিত আলোচনার বিষয়। তা ছাড়া যারা ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত করেন তারা জানেন, সেসব দেশে বসবাসরত সুযোগ সন্ধানী বাংলাদেশিদের ঐক্যের দৃঢ়তা এবং নেটওয়ার্ক কত শক্ত। দেশের রাজনীতিতে বারবার ব্যর্থ হয়ে তারা ভর করেছে বিশাল সংখ্যক প্রবাসীর ঘাড়ে এবং ঘরে। অনেকেই জানেন বাংলাভাষীরা যেখানেই থাকেন সেখানেই একটা দুটো বাংলা ট্যাবলয়েড পত্রিকা থাকবেই। এই পত্রিকাগুলোর বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রক তারা, যাদের কাছে অঢেল অর্থ এবং যাদের পূর্বসূরি দেশে থাকতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতেন। এসব পত্রিকাজুড়ে কেবল মিথ্যা তথ্য ও অপতথ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী এবং পাকিস্তানিদের সাহায্যকারী যারা তাদের বংশধররাও কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে বলে শুনেছি। তারাও নাকি বেশ প্রভাবশালী বিত্ত এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কিংবা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কেউই কি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় নাই? আছে এবং তাদের সংখ্যা নিতান্ত কমও নয়। কিন্তু অনৈক্য, অন্তঃকলহ, নেতৃত্বের লোভ, নিজেকে সুপিরিয়র ভাবার প্রবণতা ইত্যাদি মিলিয়ে শতধা বিভক্তি। এদের প্রত্যেকেরই আবার দেশে বিশেষ ‘কুতুব’ আছে। দল একটা, ‘কুতুব’ একাধিক। রাজনৈতিক দর্শন অথবা সাংগঠনিক আদর্শের চেয়ে নিজ নিজ কুতুবের মুখাপেক্ষী হওয়াটা এবং তাদের নির্দেশ মেনে চলাটাই প্রধান। বর্তমান যুগ ইন্টারনেটের, প্রযুক্তি নির্ভরতার। প্রবাসে মিথ্যা বা অপপ্রচারে ইন্টানেটের ভয়াবহ ব্যবহার দেখেছি। মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে বর্তমান কালের গুজব রটনাকারীদের ক্ষমতা যে কতখানি তা দেশে এবং প্রবাসে বারবার প্রমাণ হচ্ছে। গুজব রটনাকারীরা মিথ্যাকে সত্য এবং দিনকে রাত বানানোর ওস্তাদ।
কিন্তু এ ব্যাপারে আমার একটা সাদামাঠা জিজ্ঞাসা আছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, প্রবাসে যে অজস্র মানুষ সারাক্ষণ ‘জয় বাংলা’ বলে গলা ফাটায় তারা কি আঙুল চোষে? তারা কি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সত্যকে সত্য হিসেবে দাঁড় করাতে পারেন না? তারা কেন সাম্প্রতিক কালে দেশের ভিতরকার সহিংসতার চিত্র প্রবাসে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারলেন না? তারা কেন ছাত্র আন্দোলনের আসল তথ্য প্রবাসে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারলেন না? দেশের ‘কুতুব’রা কি এ বিষয়ে তাদের কিছুই বলেননি? এটা ভাবতেই আতঙ্কিত হই। অথচ অন্যপক্ষ কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি, সুযোগের সদ্বব্যবহার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই করেছে। ক্যাচ মাটিতে পড়তে দেয়নি। এই যে বিভিন্ন দেশে ছাত্রছাত্রীরা বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে প্যালেস্টাইন আন্দোলনের মতো বাংলাদেশের সহিংস ঘটনার পক্ষে দাঁড়াল সেখানে কি সুযোগ সন্ধানীদের হাত ছিল না? রাষ্ট্রের সপক্ষে যারা তারা যদি সত্য ঘটনার প্রতিটি অধ্যায়কে পরিষ্কারভাবে প্রতিনিয়ত প্রচার করত তা হলে হয়তো এ রকমটি হতো না। তাহলে হয়তো অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইউরোপে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা একবার অন্তত সেকেন্ড থট দিতেন। তাহলে হয়তো সংযুক্ত আরব আমিরাত অথবা মালদ্বীপে কর্মরত বাংলাদেশের সাধারণ ঘরের কর্মজীবীদের এরকম কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হতো না। ব্যাপারটা অবশ্যাই দুর্ভাগ্যজনক। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও তারা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলল। হয়তো এটাই তাদের অর্জন। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ প্রবাদের মতো। শুধু সাধারণ প্রবাসীদের কর্মকাণ্ডের আলোচনা করলেই চলবে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের দূতাবাসগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। দাফতরিক এবং প্রচলিত কূটনৈতিক দায়িত্ব ছাড়াও তারা কি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কাজে একটুও দায়িত্ব পালন করেছেন? তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে কূটনীতিকদের এ ব্যাপারে আলাদাভাবে বোধ হয় দায়িত্ব দেওয়া থাকে না। তাই তারা কেবল চাকরিই করেন।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বিশ্বমাঝে মর্যাদার আসনে বসাতে শুধু চাকরি করলে তো চলবে না। একটু বাড়তি দায়িত্ব নিতেই হবে। ভিনদেশি বন্ধুদের পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে তুলে ধরতে হবে দেশের মুক্তি সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, মহান নেতার বীরগাথা এবং গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের চিত্র। তুলে ধরতে হবে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেও বহুমাত্রিক নান্দনিক রূপ। তবে এক্ষেত্রে শর্ষের ভূতকে সরাতে হবে সবার আগে।
প্রবাসে বাংলাদেশের জনসংখ্যা একত্রিত করলে দেখা যাবে বিশ্বের অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে দেখেছি প্রবাসীদের মাঝে বাংলাদেশের রাজনীতির দল উপদলের ঝগড়া নিত্যকার ব্যপার। ঝগড়ার পরিণতিতে রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়, পুলিশ এসে ধরেও নিয়ে যায়। দেশ জাতির ভাবমূর্তির জন্য যা আদৌ সুখকর নয়। দেখে কষ্ট লাগে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া বীরজাতির একজন সন্তান হিসেবে লজ্জায় মাথা হেট হয়। অর্ধশত বছরের অধিক সময় ধরে নিজেদের ব্যর্থতার বিষয়টাও এক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মহান মুক্তিযুদ্ধের দার্শনিক মেসেজটি প্রবাসীদের মনোজগতে তুলে ধরার কাজটি যথাযথভাবে করা হয়নি। বঙ্গবন্ধুর উদার জীবনবোধ এবং অতুলনীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আদর্শকে শুধু খণ্ডিত নয় বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। বাঙালির হাজার বছরের মানবিক জীবন দর্শনের অহংকারটুকুও প্রবাসীদের অন্তরের গহিনে গুঁজে দেওয়া যায়নি।
সময় শেষ হয়ে যায়নি। রোগ যখন নির্ণয় করা গেছে, রোগের চিকিৎসাও নিশ্চয়ই করা সম্ভব হবে। কেবল উদ্যোগের অপেক্ষা। উদ্যোগটি রাজনৈতিক। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রয়ী রাজনৈতিক সরকার পরিকল্পনা মাফিক সংস্কারের কাজ শুরু করলে সুভফল দ্রুতই পাওয়া যাবে। তবে শুভস্য শীঘ্রম। মনে রাখতে হবে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব