কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে কয়েক দিন ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। মৃত্যুও হয়েছে অনেক। আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। চিকিৎসক, নার্সরা বিরামহীনভাবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সীমিত জনবলের কারণে ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে বাসায় ফিরতে পারেননি, তবুও তাদের চোখেমুখে নেই ক্লান্তির ছাপ। নিজের আপনজনের মতো করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন নার্স-ডাক্তাররা। নিরীহ মানুষকে বাঁচানোর জন্য তাদের চেষ্টার ত্রুটি নেই। অসহায় বাবা-মারা তাদের সন্তানদের সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে পেতে চান। ইতোমধ্যে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা বিষয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে ৯৩ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ ভাগ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ ভাগ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ ভাগ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজন এবং সার্বিক বিবেচনায় এ আদালতের নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে। এ রায় ও আদেশের পর শিক্ষার্থীরা কোটা-সংক্রান্ত চলমান কর্মসূচি প্রত্যাহার করবে বলে আদালত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। কোটা সংস্কার নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ে শিক্ষার্থীদের দাবি শতভাগের বেশি পূরণ হয়েছে। দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও তিন বাহিনী প্রধানদের নিয়ে বৈঠকে তিনি নির্দেশনা দেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলা সেই আন্দোলন একপর্যায়ে রূপ নেয় সহিংসতায়। সহিংসতা রোধে সরকার দেশজুড়ে জারি করে কারফিউ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এগিয়ে আনা হয় কোটা বাতিলের মামলার শুনানি। ফলে কারফিউর মধ্যে রবিবার সকাল (২১ জুলাই ২০২৪) বসেছিলেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এদিকে আদালত কোটার পরিমাণ নির্ধারণ করে দিলেও তাতে স্থান হয়নি নারী ও জেলা কোটার। ২০১৮ সালে কোটাপদ্ধতি বাতিলের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাদের পোষ্যদের জন্য চাকরিতে নির্ধারণ করা ছিল ৩০ শতাংশ কোটা। এখন আপিল বিভাগ তা ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছেন। এদিকে কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় অনেক প্রাণহানি হয়েছে, যা মোটেও কাম্য ছিল না বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন আপিল বিভাগ। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, সংঘাত, গুলি, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১০০ জনেরও বেশি মৃত্যু হয়েছে, অসংখ্য আহত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেক গ্রেপ্তারও হয়েছে। এসব নাশকতায় মদতদাতা, বাস্তবায়নকারী এবং অভিযানে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে হচ্ছে তিনটি পৃথক তালিকা। তালিকায় উঠে আসা ব্যক্তিদের টার্গেট করেই শুরু হচ্ছে চিরুনি অভিযান। এখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নিজেদের তালিকা টার্গেট করে তাদের মতো করে অভিযান চালাবে বিভিন্ন স্থানে। ধ্বংসাত্মক এবং ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে সরকার। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে পুঁজি করে কৌশলে নাশকতাকারীরা অংশ নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে। ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দিকে ধাবিত করা হয়েছে আন্দোলনকারীদের। এসব কাজের নেপথ্যে মদতদাতা হিসেবে দেশে বিদেশি চক্রের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। নাশকতাকারীদের আইনের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমাদের এখনো সেই পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মা, আলবদর রাজাকারদের সরব উপস্থিতি দেখতে হবে? যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারে না, যারা লাল-সবুজের পতাকার বাংলাদেশকে সহ্য করতে পারে না, যারা মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের দেখতে পারে না, যারা বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব স্বীকার করতে চায় না, যারা বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সুনাম দেখতে চায় না, তাদের নিয়ে আমরা কতদিন যুদ্ধ করব? ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট আমাদের জাতির জনককে হত্যার পর তারা ক্ষমতায় ছিল, এরপর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসে আবার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য হাল ধরলেন, এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাঁকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা হলো। এভাবে বহুবার তাঁকে হত্যার জন্য চেষ্টা করেছিল সেই পাকিস্তানি দোসররা। কিন্তু জনগণের ভালোবাসা আর সমর্থনে তিনি বারবার আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন। এখনো তাঁর নেতৃত্বে বর্তমানে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপগুলোকে তারা বারবার আঘাত হেনে ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে গত কয়েক দিনে কোটা আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা দেখে। এমন নারকীয় তাণ্ডবলীলা কখনো ছাত্রসমাজ করতে পারে না। ছাত্রসমাজের কাঁধে ভর করে তারা দেশকে ধ্বংস করে ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। সুতরাং এখন আমাদের জেগে উঠতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা যেভাবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সবাই একত্রিত হয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তেমনি আমাদের আবারও দেশকে বাঁচাতে, অগ্রগতিকে ধরে রাখতে, সাধারণ মানুষের জনজীবন অক্ষুণ্ন্ন রাখতে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে জয় বাংলা স্লোগান তুলে আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে। জাতির জীবনে এমন দুর্যোগের দিন যেন আর না আসে সেজন্য আসুন সবাই মিলে দেশকে বাঁচাতে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করি।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)