১৯০৮ সালে আমেরিকার দৈনিক ‘দি সানডে স্টার’ এক পুলিশ অফিসারের বরাতে ১৮৭২ সালের একটি ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা প্রকাশ করে। বর্ণনা মতে, প্রথম জীবনের সেনা অফিসার এবং পরবর্তীতে আমেরিকার ১৮তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১০ বছর (১৮৭০-১৮৮০) পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর ব্যক্তিরূপে পরিচিত ছিলেন ইউলিসিস এস গ্রান্ড। অনুমোদিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে ঘোড়ার গাড়ি চালানোর জন্য ১৮৭২ সালে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তাকে সতর্ক করেন মেট্রোপলিটন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট অব দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৩০ বছর বয়সি একজন পুলিশ অফিসার। পরদিন ঘোড়ার গাড়ি চালাতে গিয়ে আবারও অনুমোদিত গতির মাত্রা অতিক্রম করায় টহলরত একই অফিসার আটক করেন ঘোড়ার গাড়ি ও তার চালককে। আটকের পর স্বয়ং দেশের প্রেসিডেন্টকে চালকের আসনে দেখে মোটেও বিচলিত হননি এই পুলিশ অফিসার। অন্য সবার মতো তাকে থানায় নিয়ে আসেন এবং তার কাছ থেকে সেই আমলের ২০ ডলার আদায় করে থানায় জমা রাখেন। প্রচলিত নিয়মে তাকে পরদিন আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কথা ছিল পরদিন তিনি আদালতে গিয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হলে এই ২০ ডলার ফেরত পাবেন, আদালতে না গেলে এই অর্থ বাজেয়াপ্ত হবে আর দোষী সাব্যস্ত হলে আদালত জরিমানার অঙ্ক ঠিক করবেন। তবে পরদিন সেই চালক তথা প্রেসিডেন্ট আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় তার জমাকৃত ২০ ডলার বাজেয়াপ্ত তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়।
প্রিয় পাঠক, এবার শুনুন সেই পুলিশ অফিসারের ছোট্ট পরিচয়। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ল এনফোর্সমেন্ট অফিসার্স ফান্ড মেমোরিয়াল’ ওয়েবসাইটে উল্লিখিত এই অফিসারের নাম উইলিয়াম ওয়েস্ট। আমেরিকার মেরিল্যান্ডে জন্ম নেওয়া উইলিয়াম ওয়েস্ট প্রথম জীবনে ছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। বর্ণবাদবিরোধী গৃহযুদ্ধে উইলিয়াম ওয়েস্ট অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে তিনি আমেরিকার পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। এর পরের গল্পটা কেবল উইলিয়াম ওয়েস্টের এগিয়ে যাওয়ার গল্প নয়, যুদ্ধবিধ্বস্ত আমেরিকার সর্বস্তরে পুলিশি সহায়তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার এক অসাধারণ উপাখ্যান।
পৃথিবীর ইতিহাসে পুলিশের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের শুরুটা বেশ পুরনো। এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে খ্রিস্টপূর্ব যুগের বিভিন্ন সভ্যতার যে নিদর্শন ও ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়, তাতে অনায়াসে বলা যায় যে দুই বা তিন হাজার বছর আগেই পুলিশ নামক একদল সেবক শ্রেণির প্রচলন ছিল। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ পুলিশের ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। রয়েছে ব্রিটিশ পুলিশের সুনামও। তবে এই ব্রিটিশ পুলিশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) পর্যন্ত খুব একটা অস্ত্র বহন করত না। লাঠি বা চোখে ছিটানোর এক ধরনের স্প্রে ছিল তাদের নিজেদের রক্ষাকবচ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কিছু নাশকতার কারণে এবং ভূমি দখলের ঘন ঘন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্প পরিসরে নিতান্ত আত্মরক্ষামূলক কাজে অস্ত্রের ব্যবহার, প্রশিক্ষণ এবং সর্বশেষ উপায় হিসেবে অস্ত্র ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। তবে সে অস্ত্রও সেনাবাহিনীর তুলনায় ছিল নিতান্ত সাদামাটা এবং অনেক পুরনো মডেলের। ব্রিটিশদের বদ্ধমূল ধারণা হলো পুলিশি কার্যক্রমের ভিত্তি হওয়া উচিত ‘সম্মান ও সম্মতি’। পরবর্তীতে পৃথিবীর বহু দেশে এই ব্রিটিশ মডেল অর্থাৎ ‘পুলিশিং বাই রেসপেক্ট অ্যান্ড কন্সেন্ট’ তথা ‘সম্মান ও সম্মতির ভিত্তিতে পুলিশিং’ কার্যক্রমকে সামনে রেখে সভ্য দেশ গড়ে তুলেছে।
পুলিশ সম্মান অর্জন করে অথবা সম্মান হারায় কেবল নিজস্ব ইমেজের কারণে। সভ্য মানুষ যে কোনো বিপদে আপনজনদেরও আগে পুলিশকে সামনে পেতে চায়। একই সময়ে পুলিশ দেখলেই ভয় পেয়ে যায় অপরাধীরা। একবার পুলিশের খাতায় নাম উঠলে তাৎক্ষণিকভাবে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা পাওয়ার পথে অন্তরায়, অর্থ উত্তোলন স্থগিত এমন নানাবিধ জটিলতায় পড়তে হয় বিধায় পুলিশের খাতায় নাম উঠুক, কেউ এটা চায় না। বরং পুলিশকে সম্মান করে চলে।
পুলিশের হাতে বহু ক্ষমতা থাকে। বলা হয় ‘গগনের যত তারা-পুলিশের তত ধারা’ অর্থাৎ পুলিশ কাউকে আটকাতে চাইলে ধারা বা উপলক্ষের অভাব হয় না। তবে এটাও সত্য যে, মাঝে মাঝে পুলিশের এমন ক্ষমতার অপব্যবহার হয়। এতে পুঞ্জীভূত হতে থাকে ক্ষোভ, আর এক দিন তার বিস্ফোরণ ঘটে। ‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’ এমন একটি বাংলা প্রবাদই প্রমাণ করে পুলিশ কী পারে আর না পারে।
এমন একটি বাহিনী যদি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে, তবে দেশে কেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। সরকারি কাজে অস্ট্রেলিয়া হয়ে পূর্ব তিমুর যাচ্ছিলাম। মাঝে ট্রানজিট ছিল অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন শহরে। বিমান কর্তৃপক্ষই হোটেল ঠিক করে রেখেছিল। হোটেলে উঠে ধাতস্থ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। স্থানীয় সময় তখন মধ্যরাত হলেও বাংলাদেশে তখনো ঘুমানোর সময় হয়নি। তাই অভ্যাসের কারণে ঘুমাতে পারছিলাম না। ভাবলাম বাইরে একটু মুক্ত বাতাসে হাঁটব। নিচে এসে অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা মেয়েটিকে বললাম, আমি একটু বাইরে হাঁটতে চাই। এ সময় বাইরে হাঁটা কি নিরাপদ হবে? মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল, বাইরে তুমি তোমার রুমের চেয়েও নিরাপদ। কারণ তোমার রুমে পুলিশ বা সিসি ক্যামেরা নেই। কিন্তু বাইরে এই দুটোই আছে। উল্লেখ্য, ১০০টি দেশের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের তালিকায় অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান ৮৯ নম্বরে, আর বাংলাদেশ ২১ নম্বরে (সূত্র : ইনডেক্সমান্ডি ডটকম)।
দেশের গণমাধ্যম নানা কারণে পুলিশের অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো তথ্য বা সংবাদ প্রচার করতে না পারলেও বিশ্ব মিডিয়ায় পুলিশের কীর্তিকলাপ ঠিকই প্রকাশ পেয়েছে, যা দেশের সম্মান নষ্ট করেছে। বিশেষত পুলিশ কর্তৃক মানুষ গুম করার ঘটনা প্রচার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আর সর্বাধিক সমালোচিত নাম মো. হারুন অর রশীদ। পুলিশের গুলিতে রংপুরের বীরসন্তান আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনাও দেশের পুলিশকে হেয় করেছে।
মূলত লোভ, লালসা, দুর্নীতি ও রাজনীতিকরণ আজ পুলিশের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে পুলিশ জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও জনগণের হাতে তাদের এমনভাবে মার খাওয়া এবং জনগণের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া, থানায় অগ্নিকান্ড ও লুটপাটের ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। পৃথিবীর বহু দেশে এমনকি খোদ আমেরিকাতেও পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। তবে তা ছিল মূলত স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে বা বর্ণবাদকেন্দ্রিক। কিন্তু সমগ্র দেশের পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অবস্থা বিশ্বের বুকে নতুন লজ্জাজনক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অথচ পুলিশ না থাকলে দেশের কী হয়, সে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমাদের।
মূলত ইমেজই পুলিশের বড় অস্ত্র এবং বড় শক্তি। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের ইমেজ সংকটটাই আজ বড় সমস্যা। কেন পুলিশের ইমেজ সংকট-তা আমরা সবাই জানি ও বুঝি। তবে তা থেকে উত্তরণের উপায় হয়তো অনেকের অজানা কিংবা জানা থাকলেও তা কঠিন একটি প্রস্তাবনা। অথচ সেই কঠিন বা অসাধ্য কাজটিকেই আজ যে কোনো মূল্যে করে দেখাতে হবে। আমাদের তরুণরা এর চেয়ে কঠিন কাজ করতে পারলে আমরাও পারব আদর্শ পুলিশ গড়তে। মানুষ নিজের শক্তিতে না পারলে ক্রেনের সাহায্যে গভীর খাত থেকে কোনো কিছু টেনে তোলে। আজ পুলিশের ইমেজ উদ্ধার নিজেদের প্রচেষ্টায় সম্ভব না হলে বিদেশি সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
শুরু করেছিলাম মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘোড়ার গাড়ি আটকের ঘটনা বলে। শেষ করব পাশের দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি ও ক্রেনজনিত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে।
১৯৮২ সালের ৫ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসার (মতান্তরে অফিসের) ১৮১৭ নম্বর প্লেটবিশিষ্ট একটি গাড়ি অননুমোদিত স্থানে থামানো (পার্কিং) ছিল। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) নির্মল সিং সেই গাড়ি রেকার লাগিয়ে থানায় তুলে নিয়ে যান। তখন দিল্লির ট্রাফিক পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ছিলেন কিরণ বেদী নামের এক সাহসী নারী। তারা উভয়েই জানতেন গাড়িটি প্রধানমন্ত্রীর বাসা অথবা অফিসের এবং ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং এই গাড়িতে করেই মাঝে মাঝে যাতায়াত করেন। তারপরও সেই গাড়ি রেকার লাগিয়ে সরানো হয়। এতে সাব-ইন্সপেক্টর নির্মল সিংয়ের ওপর বিরক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে বদলির কথা বললেও কিরণ বেদী এমন বদলি আদেশে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। কিরণ বেদীর সাক্ষাৎকার মতে, তখন ঊর্ধ্বতন কেউ (মতান্তরে বিদেশি সফর শেষে দেশে ফেরা ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং) কিরণ বেদীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন তুমি কি এসআই নির্মল সিংকে শাস্তি দেবে? নির্ভীক কণ্ঠে কিরণ বেদী উত্তর দেন, না আমি তাকে এমন সাহসী কাজের জন্য পুরস্কার দেব। এরপর থেকেই কিরণ বেদীর নাম হয়ে যায় ‘ক্রেন বেদী’। ইন্দিরা গান্ধী এ ঘটনার পর সাহসী নারী কিরণ বেদীকে তার বাসভবনে নিমন্ত্রণ করেন এবং মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করেন। এ সংক্রান্ত একটি ছবিও নেটদুনিয়ায় পাওয়া যায়।
আমাদের পুলিশ জগতে শিগগিরই সততার কিরণ (আলো) ছড়াবে সেই প্রত্যাশায় থাকলাম।
♦ লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]