এটা তো কোনোভাবেই মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের আওয়ামী লীগ ও বাকশাল শাসনামলে জাতির তখনকার প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ গড়ার কর্মকান্ডে জান-প্রাণ দিয়ে প্রচেষ্টা চালানোর পরও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী লুটেরা গোষ্ঠী ও অন্য অপরাধীদের অনাচারে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। সরকারি দলের নেতাদের ক্ষমতার দাপটে রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠনে, দুঃশাসনে নব্বই শতাংশ মানুষ সর্বস্বান্ত দশায় পৌঁছেছিল। চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তা ছাড়া নিষ্ঠুর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের প্ররোচনায় ও সরাসরি হামলায় নিরপরাধ, নিরীহ মানুষ, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক নিহত হয়েছিলেন ২০ হাজার থেকে ৩৩ হাজারের মধ্যে (বামপন্থি নেতাদের একটা অংশের অভিযোগ হত্যাকান্ডের শিকার ৩৩ হাজার, তবে অন্যসব সূত্রে দাবি করা হয়, কমবেশি ২০ হাজার এসব রাজনৈতিক খুন সংখ্যা)। ওই সব অনাচার ও ‘গণতন্ত্রহীন একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থার রাষ্ট্র শাসন’ ইত্যাদির পরিণামে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ড ও বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের ভাষণে ও বইপত্রে মন্তব্য করেছেন- ওই সাড়ে তিন বছরের দুঃশাসন ওইভাবে না চললে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা এমনভাবে তলানিতে নেমে যেত না এবং হত্যাকারী চক্র তাঁকে এভাবে সপরিবারে খুন করে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে সাহস পেত না।
তাঁর কন্যা একটানা সাড়ে পনেরো বছরের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনেরও কারণ প্রায় একই ধরনের। ২০০৯ সাল থেকে এই সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকাকালে কর্তৃত্ববাদী শাসনে, তাঁর সঙ্গী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও আমলা-গোষ্ঠীর অপকর্মে এই দেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ সব হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছিল। একের পর এক জাতীয় নির্বাচনগুলো ‘জাল-জালিয়াতির ও প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত’ করা হয়, যাতে সারা দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সংগঠকদের সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের দিয়ে হত্যাকান্ডসহ অসংখ্য হামলা চালানো, রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় গুন্ডা-মাস্তান বাহিনীতে রূপান্তর ঘটিয়ে বিরোধী দলের লোকজনকে হামলা-মামলা দিয়ে গুম-খুন, গুপ্তহত্যা, প্রকাশ্য-হামলায় খুন, জেল-জুলুম, মিথ্যা মামলায় ঝুলিয়ে দেওয়া চলে অবিরাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গরিব-নিম্নবিত্ত তো দূরের কথা, মধ্যবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যায় দুঃশাসনের সরকার। কোটি কোটি মানুষ পর্যাপ্ত খাবার (উপযুক্ত ও পুষ্টিকর) না-পেয়ে অপুষ্টির শিকারে পরিণত হচ্ছিলেন। দেশের অর্থনীতি লুটপাটের ফলে একেবারে চরম দুর্দশায় পৌঁছে যায়। শেয়ারবাজার থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা লুট করে নেন আওয়ামী লীগ সমর্থক ক্ষমতাধররা। নিরীহ শেয়ার-বিনিয়োগকারীদের ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া হয়। তাদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। একইভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া খেলাপি ঋণের অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে ২ লাখ কোটি টাকা। (এই অর্থের আশি ভাগই চিরতরে লোপাট হয়ে গেছে)। দুর্নীতি প্রতিটি সরকারি অফিস গিলে খাচ্ছে, সরকারি কাজের ঠিকাদারিতে রাস্তা বা ভবন নির্মাণ ও জিনিসপত্র কেনাকাটা হয়েছে পাঁচ গুণ, দশ গুণ এমনকি ২০ গুণ বেশি দামে। রাষ্ট্রীয় অর্থের এমন লুণ্ঠন বিশে^র আর কোনো রাষ্ট্রে আছে কি না সন্দেহ রয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো হয়েছে ‘মেগা-দুর্নীতি’ চালানোর লক্ষ্য নিয়ে। এমনকি সাধারণ একটা ঠিকাদারি নির্মাণ বা ক্রয়-কাজেও বেজায়রকম দুর্নীতি হয়েছে। ক্ষমতাধর রাজনীতিকরা তো লুণ্ঠনবাজিতে ছিলেনই, আমলাগোষ্ঠীর বড় অংশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটা অংশ অর্থবিত্তের পাহাড় গড়েছেন, বেনজীর আহমেদ, আছাদুজ্জামান মিয়া, মতিউর রহমানসহ বেশ কিছু আমলার দুর্নীতির কাহিনি সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের মুখে স্বীকার করেছেন, তার পিওন (চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী) দুর্নীতির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এর আগে স্বাস্থ্য বিভাগের গাড়িচালক থেকে অন্য অনেকের কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ কর্মকমিশনের প্রশ্নপত্রসহ বহু বিশেষ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা অর্জনের ও পরীক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের খবর বেরোয়। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কাউকে শাস্তিও দেওয়া হয়নি। ফলে দুর্নীতি বেড়েছে সীমাহীন গতিতে, নিরীহ সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া লোকজন সবকিছুর জন্য নিঃস্ব থেকে সর্বস্বান্ত হয়েছে। (এসব মানুষ আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকারপ্রধানকে সারাক্ষণ অভিশাপ দিয়েছে আর মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছে, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই জালেম সরকারকে বিদায় করো মহান আল্লাহপাক’)।
কর্তৃত্ববাদী শাসকের অনুগ্রহভাজন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিকরা হাজারো বার অভিযোগ করার পরও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি। উন্নয়ন তিনি করেছেন, কিন্তু তাঁর আসল উপকারভোগী হয়েছেন দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার, ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও আমলাগোষ্ঠী, এমনকি সরকারি অফিসের পিওন-কেরানি অবধি। দেশের নাগরিকরা সেসব উন্নয়ন কর্মকান্ডের উপকার সামান্যই পেয়েছেন। কেন সরকারের শীর্ষ-নেতার নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে- প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটা দপ্তরে ‘আয়নাঘর’ বানিয়ে বছরের পর বছর ধরে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, সরকারের-শত্রু বিবেচিত বুদ্ধিজীবী এসব ব্যক্তিকে গুম করে রাখা হয়েছিল? এখন অনেকেই সেই আয়নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। ভুক্তভোগী লোকজনের অভিযোগ- আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ৬০০ লোককে গুম করা হয়েছে, তাদের অনেককেই গুপ্তহত্যা করা হয়েছে। সারা দুনিয়ায় এসব নিয়ে তোলপাড় হয়েছে, গুমের শিকার পরিবারগুলোর স্বজনরা বিশেষভাবে শিশুরা, বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা চোখের পানিতে ভেসেছেন, বুকফাটা আর্তনাদ করছেন, কিন্তু স্বজনদের ফেরত পাচ্ছেন না।
কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগ-যুবলীগকে নামানো হয়- হেলমেট-পরা মাস্তান, পিস্তল, রাইফেল, রামদা হাতে তারা আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর পুলিশ বাহিনীর নামে সন্ত্রাসী গুন্ডা-মাস্তান কায়দায় হামলা চালাতে। ফলে চার/পাঁচ দিনে গণমাধ্যমের হিসাব মতেই নিহত (অবশ্যই ‘শহীদ’) আন্দোলনকারী ছাত্র ও অন্য পেশাজীবী এবং শিশু-কিশোর সব মিলিয়ে ৪ শতাধিক। কারও কারও মতে, নিহতের (শহীদ) সংখ্যা অনেক বেশি, আন্দোলনকারীদের হত্যা করে লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছে, গণকবরের সন্ধান মিলছে এমন অভিযোগও পাওয়া যায়।
শেষাবধি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশপ্রেমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছুড়তে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং হামলাকারী পুলিশ বাহিনীও ভয় পেয়ে যায়। আর বিশেষভাবে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর দুই প্রধানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বোঝান, তার পদত্যাগ ছাড়া উপায় নেই, তারা কারফিউ দিয়ে মানুষকে ঘরবন্দি রাখতে ব্যর্থ এবং এসব মানুষকে আর গুলি করে হত্যা করা যাবে না। অনেক কষ্টে শেখ হাসিনাকে রাজি করানো সম্ভব হয়। তিনি পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে চলে যান।
একটা বিষয় আমার নিজের চোখে দেখা, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের সময় জেনারেল জিয়াকে উদ্ধারের পর সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মানুষ হাত মিলিয়েছে, ট্যাংকের ওপর মাল্যদান করেছে, পুষ্পবৃষ্টি ঝরিয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখলাম এই ২০২৪ সালের ৪/৫/৬ আগস্টে সেনাবাহিনীর ট্যাংকে মালা দিয়েছে শিক্ষার্থী ও জনতা, সেনা ও ছাত্ররা হাত মিলিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছে। আমরা অভিনন্দন জানাই দেশপ্রেমিক ও আত্মত্যাগী ছাত্র-জনতাকে। অভিবাদন জানাই দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে।
সর্বান্তকরণে কামনা করি- অতীতের সব অনাচারের সুষ্ঠু বিচার করে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর সহযোগিতায় একটা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ কায়েমের দরজা খুলে দিতে পারে যেন।
♦ লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক