আমি যখন এই লেখা লিখতে বসেছি তখন খবর পাচ্ছি কুমিল্লা ও ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে ক্রমেই। চ্যানেল আই বার্তা বিভাগে আমাদের প্রতিনিধিরা প্রতি মুহূর্তে আপডেট করছে বন্যা পরিস্থিতির। ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বৃষ্টি এখনো অব্যাহত আছে। আবহাওয়া অফিস আরও ৪৮ ঘণ্টা বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, মুহুরী, ফেনী ও হালদা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এর মধ্যে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। লেখাটি যখন প্রকাশ হবে তখন হয়তো পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হতে পারে। আমি সর্বক্ষণ আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চ্যানেল আইয়ের রাঙামাটি প্রতিনিধি মনসুর আলী জানালেন, খাগড়াছড়ির পর এবার রাঙামাটিতেও পানি ঢুকতে শুরু করেছে। বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে পড়ে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। কাউখালী উপজেলা সদরে অবস্থিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, জন্মের পর বিগত ২০-৩০ বছরে এমন বন্যার পানি দেখেননি। গভীর রাতে হঠাৎ করে পানি বেড়ে গেলে এসব ঘরে বসবাসকারীরা কোনোমতে জীবন নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পেরেছে। আকস্মিক বন্যায় অনেক মানুষ যোগাযোগ করতে পারেনি। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ নেই বলে ফোনে যোগাযোগ করাও সম্ভব হচ্ছে না। বন্যাদুর্গত অনেক মানুষ কারও কাছে সাহায্য চাওয়ারও সুযোগ পাচ্ছে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের মাঝে এক ধরনের স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সরকারের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে তাদের সহযোগিতায়। কয়েক সপ্তাহ আগেও দেশের উত্তরাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় ৩৭ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় ৬০ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে অনেক কৃষক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অধিক বৃষ্টিতে যমুনা নদীতে পানি বাড়ার কারণে চর ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। পাট, তিল, আউশ, আমন বীজতলা ও সবজিসহ ৬ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়। এর মধ্যে পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় ৩ হাজার ১৮৫ হেক্টর ফসলি জমির ফসল।
কৃষি বিভাগ বলছে, সিলেট জেলায় ১ হাজার ৪৭২ হেক্টর জমির আউশ ধান বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ধানের ৬৯৪ হেক্টর বীজতলা। যার ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমির শাকসবজি। যার ক্ষতির পরিমাণ ৭৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে কৃষক নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
চ্যানেল আইয়ের গাইবান্ধা প্রতিনিধি ফারুক হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সেখানে দুই দফা বন্যায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৭০ হাজারের মতো কৃষক। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় অন্তত ৭৬ কোটি টাকার ফসল ক্ষতি হয়েছে। ফারুক হোসেন সরেজমিনে দেখেছেন, জেলার নিম্নাঞ্চল এলাকার পাট, তিল, আউশ, ভুট্টা, চিনাবাদাম, আউশ, রোপা ধানের বীজতলা, কলা ও শাকসবজি বন্যার পানিতে দীর্ঘদিন তলিয়ে থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে। গাইবান্ধার চরের মানুষের দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বন্যায় মরিচ, আমান ধানের বীজতলাসহ শাকসবজি তলিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পানি থাকার কারণে কোনো ফসলই আর টেকেনি। কুড়িগ্রাম, বগুড়া, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলার বন্যা পরিস্থিতি একই রকম ছিল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই আগস্টের বন্যা নিয়ে পূর্বাভাস ছিল। এ বিষয়ে সতর্ক হতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে এ মাসের প্রথম সপ্তাহে পত্রিকায় লিখেছিলাম। যা হোক, এই মুহূর্তে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের এক হতে হবে। দাঁড়াতে হবে দুর্গত মানুষের পাশে। পাশাপাশি সুদৃষ্টি ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে কৃষকের ফসল ফলানোর বিষয়ে। মনে রাখতে হবে, কৃষক শুধু আমাদের খাদ্যই উৎপাদন করার জন্য ফসল ফলান না। আমাদের পাশাপাশি গবাদি প্রাণী, মাছ ও হাঁস-মুরগিরও খাদ্য জোগায় কৃষক। জুলাইয়ের বন্যা সংকট পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্য বাজারে বিক্রি করতে না পেরে বহু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
দেশের কৃষক এখন ব্যস্ত আমন ধান চাষে। এ বছর রোপা আমন ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ৪০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়ার কথা। কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, দেশের ৬১টি জেলার ৫ লাখ ৬৬ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পাবেন। এ প্রণোদনার আওতায় একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য রোপা আমন ধানের উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের প্রয়োজনীয় ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাবেন। সাম্প্রতিক সময়ে ১ লাখ টন সার আমদানির কথা শুনছিলাম। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়গুলো নিয়ে কী ভাবছে জানি না। আগামীর নয়, আজকের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই আমন চাষিদের সার, জ্বালানি নিশ্চিত করা। কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতেই আমরা যেন কৃষকের কথা ভুলে না যাই। তার প্রয়োজনটুকু অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেটাতে হবে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরীহ পেশা কৃষি। খাদ্য উৎপাদনের মতো চরম রাজনৈতিক বিষয়টি নিয়ে কাজ করলেও পক্ষহীন অরাজনৈতিক সাধারণ জীবনযাপন করেন বাংলাদেশের কৃষক। তার কোনো দল নেই, নেই কোনো দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ানোর নেতা, সংগঠন বা প্ল্যাটফরম। কৃষক শুধু বোঝেন মাটির ভাষা, তার জীবনের সব যুদ্ধ শুধু ফসলের মাঠে। সেই কৃষককে তার সময়ের প্রয়োজনটুকু মেটাতে হবে, না হলে আমাদের অনেকেরই না খেয়ে থাকতে হবে। তবে আশার বিষয় হচ্ছে সরকারের দায়িত্বে থাকা শীর্ষ পর্যায়ে ড. মুহম্মদ ইউনূসসহ অনেকেই আছেন যাদের দুর্যোগ মোকাবিলায় সামনে থেকে কাজ করার বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে। সব সংকটে আমাদের সেনা সদস্যদের কার্যকরী অংশগ্রহণ আগেও লক্ষ্য করেছি। আজকের তরুণ সমাজ দারুণ সজাগ। দেশ ও দেশের মানুষের বিষয়ে বিশেষ সচেতন। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন দুর্যোগে দলবেঁধে মানুষের কাছে ছুটে গেছি ত্রাণ নিয়ে। বেশি কিছু নয়, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও মানুষ আশাবাদী হয়, শক্তি পায়। আমাদের সময়ের চেয়ে এই সময়ের তরুণরা অনেক অনেক এগিয়ে। আমি বিশ্বাস করি, আজকের তরুণরা আরও বেশি মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। মানুষই শেষ পর্যন্ত মানুষের ভরসার জায়গা।
♦ লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব