আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন আমার বয়স বড়জোর ছয় কিংবা সাত বছর। আমাদের এলাকার অন্য সব শিশু-কিশোরের মতো আমার মাথায় তখনো লাউ এবং কদুর পার্থক্য কী এমন প্রশ্ন প্রবেশ করেনি। আমরা লাউ কী তাও জনতাম না- কারণ ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার শামপুর গ্রামে সবাই লাউকে কদু বলেই জানত। কদু আমাদের সেই জমানায় আহামরি কোনো তরকারি ছিল না। ডালের মধ্যে কদু দিয়ে মা-চাচিরা ডাল-কদু রান্না করতেন- আর আমরা মাছ-মাংসের তরকারি ছাড়া সেই ডাল-কদুর তরকারি যে কতটা অপছন্দ করতাম তা এই যুগের বাচ্চারা কল্পনাও করতে পারবে না।
কদু নিয়ে আমার উল্লিখিত অভিজ্ঞতার বাইরে প্রথম যে আশ্চর্য ঘটনা ঘটল তা আমাকে ভারী চিন্তার মধ্যে ফেলে দিল। এক দিন বিকালে আমার দাদিকে দেখলাম একটি সুগন্ধি তেলের বোতল খুলে মাথায় তেল মাখছেন। আমাকে কাছে পেয়ে তিনি আমার মাথায় খানিকটা তেল মালিশ করতে করতে বললেন, কদুর তেল! তোমার মাথা ঠান্ডা রাখবে। আমি তেলের বোতলের দিকে তাকিয়ে সদ্য তোলা অক্ষরজ্ঞান দিয়ে পড়লাম, তিব্বত কদুর তেল।
একটি শিশুর মস্তিষ্কে নানা বিষয় নিয়ে নানা রকম অদ্ভুত প্রশ্নের উদয় হয়। আমার মাথার মধ্যে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি উদয় হয়েছিল তা হলো, কদু থেকে কীভাবে তেল বের হয়ে বোতলের মধ্যে ঢুকল। এ ঘটনার অনেক দিন পর আমি কদুর অন্য নাম লাউ সম্পর্কে কৌতূহলী হলাম। সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী-গানটি আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু কদুর অপর নাম যে লাউ তা বুঝে ওঠার আগেই আমাদের বাড়িতে একতারা হাতে এক বৈরাগীর আগমন ঘটল। সামান্য সেলামির বিনিময়ে তিনি একতারা বাজিয়ে বেশ কয়েকটি গান গাইলেন। আশপাশের কয়েক বাড়ির ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ মিলে প্রায় শ’খানেক লোক বৈরাগীর গান শুনলাম এবং জীবনে প্রথম একতারা স্পর্শ করার সুযোগ পেয়ে খুশিতে ফেটে পড়লাম। দাদির কাছে যখন শুনতে পেলাম যে কদু বুড়া হয়ে গেলে তার খোসা শুকিয়ে একতারার নিচের অংশটি তৈরি করা হয় তখন কদু সম্পর্কে আমার আগ্রহ কীভাবে বাড়ল এবং পরবর্তী জীবনে লাউ-কদু একতারা নিয়ে কী ঘটল তা না হয় আরেক দিন বলব। বরং আজ লাউ-কদু নিয়ে চলমান বাংলাদেশে যে তোলপাড় চলছে তা নিয়ে কিছু বলি।
যাহা লাউ তাহাই কদু- বাংলা ভাষার এই সরল বাক্যটি জটিল আকার ধারণ করে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহটিকে আমাদের জীবনকে কতটা দুর্বিষহ করে তুলেছে তা আমরা কমবেশি সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমাদের আবেগ-অনুভূতি, হাসি-কান্না, ভয়-আতঙ্ক, আনন্দ-বেদনা ইত্যাদি কদুর তেলের মতো লাউয়ের খোসার মধ্যে জমা হচ্ছে। তারপর আমাদের পুরো জীবনকে একতারা বানিয়ে বৈরাগীর কণ্ঠে সুরের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি না- কদুর কোন জায়গা দিয়ে তেল বের হয়- কিংবা লাউয়ের খোসায় তৈরি একতারা দিয়ে এত সুর কীভাবে উপচে পড়ে!
আমাদের জীবনের গত দুই দশকের ১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্ট হঠাৎ কীভাবে হিন্দি গান লুঙ্গি ডান্সের উন্মাদনার মধ্যে হারিয়ে যায় অথবা একটি রাষ্ট্র কীভাবে টানা চার দিন সরকারবিহীন অবস্থায় চলতে পারে তার আগা-মাথা আন্দাজ করা আমার জন্য শৈশবের সেই কদুর তেলের মতো জটিল হয়ে পড়েছে। আমি বুঝতে পারছি না- দেশ কীভাবে চলছে এবং আগামীতে কীভাবে চলবে। বড় বড় শিল্প-কলকারখানা-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান- আমলা-কামলার তেল বের করে যেভাবে লাউয়ের খোসায় জমা করা হচ্ছে তা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা কীভাবে চলবে তা বোধগম্য হচ্ছে না। ইতিহাসের সবচেয়ে আশ্চর্য এক সরকার কীভাবে ১৮ কোটি মানুষের আবেগ-অনুভূতি, বিপদ-আপদ, প্রয়োজন, অভাব-অভিযোগ সামাল দেবে তাও অনুমান করতে পারছি না।
দিনের বেলার শহর-বন্দর-গ্রাম আর রাতের বেলার জমিনের মধ্যে যে হাহাকার তা কীভাবে নিষ্পত্তি হবে অথবা দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্প কী গণ অভ্যুত্থানের আলো দ্বারা শেষ হবে তা দেখার ধৈর্য আমাদের মধ্যে কয়জনের আছে। রাষ্ট্র পরিচালনার অর্থ আমরা কোথায় পাব- দেশি-বিদেশি ঋণের যে পরিমাণ পত্র-পত্রিকায় আসছে তা সচেতন নাগরিকের মনে যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে তা দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না। দেশের কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা কোম্পানিগুলোতে বিপ্লবের ছোঁয়া লাগেনি। বরং গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ যাদের ধীরে-সুস্থে তাড়িয়েছিল এবং শূন্যপদে নিজেদের লোককে লালন করে বসিয়েছিল তা গত ১৫ দিনে তছনছ হয়ে গেছে। নতুন কেউ আসেনি- কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু সেটাই হয়েছে যার আশঙ্কা সবাই করছিল। দলীয় পরিচয় রয়েছে- বিএনপি-জামায়াতের গন্ধ রয়েছে অথবা আওয়ামী দালাল হওয়ার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা যাদের ছিল না তারা সবাই একত্র হয়ে সরকারি পদ-পদবিগুলোতে বসে থাকা আওয়ামী পান্ডাদের সরিয়ে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে জড়ো হওয়া, কালবৈশাখী অথবা মরুঝড় সাইমুমের মতো শূন্যস্থান পূর্ণ করে ফেলেছে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পদ-পদবির যে পালাবদল চলছে সেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুলিশ বাহিনী। গত ৫ আগস্টের পর ঝড়ের গতিতে যেভাবে পুলিশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ যথা আইজি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার এবং র্যাবের মহাপরিচালক পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে তা শুভফল বয়ে আনেনি, বরং নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা-অনিয়ম এবং বাহিনীর সদস্যদের মনের ওপর যে বাড়তি চাপ পড়ছে যা শেষ পর্যন্ত শহর-বন্দর, গ্রামগঞ্জের সাধারণ আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
আপনি যদি ঢাকা শহরে সন্ধ্যার পর বের হন- তবে রাস্তায় কোনো পুলিশ দেখতে পাবেন না। গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দশ-বারোজন পুলিশের দলকে বিষণ্ণ অবস্থায় ঝিমুতে দেখবেন এবং কাছাকাছি হয়তো সেনাবাহিনীর গাড়িগুলোকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন। রাত যত গভীর হবে ততই রাজধানী আপনার জন্য ভয়ংকর হয়ে পড়বে। টঙ্গী-উত্তরা-আজমপুর, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ প্রভৃতি অপরাধপ্রবণ এলাকায় প্রতি রাতে যত গণছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তা গুণে শেষ করতে পারবেন না। আপনি যদি কোনো থানায় নালিশ জানাতে যান তবে রাতের আঁধারে থানার সদর দরজা খোলা পাবেন কি না এ নিশ্চয়তা এখনো কেউ দিতে পারছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিদিনই পদোন্নতি র্যাংক ব্যাজ পরানোর উৎসব চলছে। অন্যদিকে চাকরি থেকে বিদায়, অপমানজনক বদলি, ইত্যাদি কর্মের বেদনাবিধুর যজ্ঞ চলছে। নতুন পুলিশ প্রধানের সামনে এমন সব ঘটনা ঘটেছে যা ইতিপূর্বে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। পুলিশের পোশাক পরা ঊর্ধ্বতন কর্তারা অধস্তনদের হাতে নাজেহাল হয়েছেন তা পুরো বাহিনীকে হতাশার সাগরে ফেলে দিয়েছে। পুলিশে যদি আপনার জানাশোনা কেউ থাকে তবে তাদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন যে প্রায় আড়াই লাখ সদস্যের বাহিনীতে হাজার তিনেক ক্যাডার সদস্য, ৮ হাজার ওসি পদমর্যাদার কর্তা এবং বিয়াল্লিশ হাজার সাব ইন্সপেক্টর পদের লোকজনের মধ্যে কয়জন-কট্টরপন্থি হারুন-বেনজীর-বিপ্লব-মেহেদি আছেন। সবাই বলবেন- বড়জোর ১০০ সুযোগসন্ধানী এবং ভোল পাল্টানো কর্মকর্তার সংখ্যাও হাজার খানেকের বেশি নয়। বাকিরা পরিস্থিতির শিকার। অন্যদিকে কনস্টেবল পদে চাকরি করা লোকজনের মধ্যে দলীয় পান্ডা হাতেগোনা কয়েক ডজনের বেশি হবে না।
উল্লিখিত অবস্থায় পুরো বাহিনীটিকে গত ১৫ বছর ধরে যেভাবে উপর্যুপরি অকার্যকর করা হয়েছে তা বর্তমানের তাপ-চাপে একেবারে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রায় সবার মধ্যে হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতা কীভাবে কাজ করছে তার দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। প্রথমটি ঢাকার বাইরের একটি থানার কাহিনি। জনৈক ভুক্তভোগীর অনুরোধে ওসি সাহেবকে ফোন দিলাম। তিনি এলোমেলো কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তার বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্তার সঙ্গে কথা বললাম, তারা জানালেন যে ওসি পলাতক আছেন। থানায় যেতে পারছেন না- তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের জন্য থানায় বিক্ষুব্ধ জনতা প্রতিদিন ভিড় করছে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি রাজধানী ঢাকার এক গুরুত্বপূর্ণ থানার। সেখানে ওসির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের জন্য লোকজন থানা ঘেরাও করেছে। সেই থানায় কর্মরত এক সাব-ইন্সপেক্টর পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে আমাকে অনুরোধ জানালেন যে ওসি সাহেবকে রক্ষা করার জন্য কিছু করতে পারি কি না!
উল্লিখিত ঘটনার আলোকে আপনি যদি পুলিশের মধ্যে যে ভয়-আতঙ্ক কাজ করছে তার কারণ খুঁজতে যান তবে প্রথমেই দেখবেন- সব কনস্টেবল পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। কারণ তাদের মধ্যে এবং ঊর্ধ্বতন ক্যাডার সার্ভিসের সদস্যদের মধ্যে যারা সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেন সেই ৪২ হাজার সাব-ইন্সপেক্টরের মধ্যে হত্যা মামলার আসামি হওয়ার আতঙ্ক ভাইরাস আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, যেসব পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে এখনো কোনো মামলা না হওয়ায় পুলিশের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে যে পুলিশ সদস্যকে মেরে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল এবং সেই পুলিশের লাশ আনতে গিয়ে যে লঙ্কাকান্ড ঘটেছে তা যেমন পুলিশকে ভয়ানক ট্রমার মধ্যে ফেলে দিয়েছে অন্যদিকে এত সব ট্রমার বিপরীতে নতুন পদ-পদবি পাওয়া লোকজনের মতিগতি উৎসব-আমেজ, খানাপিনা ও র্যাঙ্ক ব্যাজ পরানোর হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবি দর্শনে ট্রমায় থাকা পুলিশ সদস্যদের আতঙ্ক বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে।
পুলিশ বাহিনীর বর্তমান হালহকিকতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও নিত্যনতুন লঙ্কাকান্ড ঘটে চলছে। ফলে আমার মতো অনুর্বর মস্তিষ্কের প্রাপ্তবয়স্ক নাবালক তার শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে এবং কদুর ভিতর থেকে কীভাবে তেল বের হয় এবং লাউয়ের খোসা দিয়ে তৈরি একতারায় বৈরাগীরা কীভাবে সুর তোলে তা ভেবে আঙুল চুষে দিন-রাত পার করে দিচ্ছে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক