সম্প্রতি গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। তবে এ সরকার কতদিন থাকবে, তারা কী কাজ করবে এটা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলাপ হচ্ছে। স্বৈরাচারী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি আশা করব, ভারত নিশ্চিত করবে যে ৯০ দিনের সাংবিধানিক সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।” জয়ের এ বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রথমত তিনি একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার জন্য অন্য একটি রাষ্ট্রকে এভাবে আহ্বান করতে পারেন কি না? এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল কি না তা অবশ্যই সরকার বিবেচনা করবে। দ্বিতীয়ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এ সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না? এ সরকারের মেয়াদ কি ৯০ দিন?
৫ আগস্ট দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সৃষ্ট গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে শূন্যতা তৈরি হয়। শেখ হাসিনার পদত্যগ, পলায়ন ও সংসদ ভেঙে দেওয়ার কারণে দেশে কোনো সরকার ছিল না। এ পরিস্থিতিতে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটির’ ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। তাছাড়া সর্বোচ্চ আদালত এ সরকারের বৈধতা দিয়েছেন। সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত এ সরকারের বৈধতা নিয়ে যতটা মতানৈক্য তার চেয়ে বেশি কথা হচ্ছে এ সরকারের মেয়াদ নিয়ে।
অনেকের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে এ সরকারকে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। তাদের এ ধারণার ভিত্তি হলো আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা। ১৯৯০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতো। ফলে এটাকেও সেরকম সরকার বিবেচনা করে কেউ কেউ মনে করছে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে সেটা বাতিল করা হয়েছে। তদুপরি ভুলে গেলে চলবে না এ সরকারের সংবিধান অনুযায়ী তৈরি হয়নি। ‘বিপ্লবের’ মাধ্যমে তৈরি হওয়া সরকারের মেয়াদ সংবিধানে খুঁজতে যাওয়াটা ভুল।
তার মানে এই নয় যে, এ সরকার যতদিন ইচ্ছা ততদিন থাকবে। এ সরকারের অন্যতম কাজ হলো দেশের সংস্কার করে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তন করানো। এ জন্য সরকারকে অতি শিগগিরই একটি রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। এ অন্তর্বর্তী সময়ে তারা কী কাজ করতে চায়, কীভাবে করতে চায় তার জন্য একটি টাইমলাইন থাকা দরকার। এ কাজগুলো তারা কতদিনের মধ্যে করতে পারবে তার ওপরই তাদের মেয়াদ নির্ভর করছে। তবে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন চাওয়াটা সমস্যাজনক।
প্রথমত, এ সরকার কোনো স্বাভাবিক অবস্থার ভিতর দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। একটি জরুরি প্রয়োজনে তারা রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের একনায়কতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসনের ফলে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে অগণতান্ত্রিক চর্চা বিদ্যমান। সেগুলো সত্যিকার অর্থেই ৯০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্ভব কি না বলা মুশকিল। দ্বিতীয়ত, দেশে এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। গণআন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যেসব অবৈধ অস্ত্র দিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে সেগুলো এখনো পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। তাছাড়া স্বৈরাচারী সরকারের পতনের দিনে অনেক থানার অস্ত্র লুট হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী সেগুলো এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য এগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন। সন্ত্রাসীদের কাছে এখনো অস্ত্র রয়েছে এবং সংবাদমাধ্যমে গোপন হত্যাকান্ডের ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি। এসব পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি দরকার।
তৃতীয়ত, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে তারাও এখনো সংগঠিত নয়। নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো এখনো প্রস্তুত নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনোভাবেই একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সমাবেশের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জনগণের সংযোগ স্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন।
চতুর্থত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী শাসনের সময় যে গণবিরোধী পুলিশ বাহিনী তৈরি করা হয়েছে তাকে পুনর্গঠন করা জরুরি। পাশাপাশি পুলিশকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে জনমুখী ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা দরকার।
পঞ্চমত, সিভিল প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম এবং অনেককে দীর্ঘদিন পদবঞ্চিত করে রাখার কারণে প্রশাসনে এক ধরনের স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের আগে এগুলোর সংস্কার অত্যাবশ্যক।
ষষ্ঠত, গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারী সরকারব্যবস্থায় খুন, গুমসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। সেগুলোর বিচার ছাড়া দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা আকাশ-কুসুম কল্পনার শামিল। ন্যায়বিচারের নজির স্থাপন না করতে পারলে ভবিষ্যতেও যে কেউ ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় এ সরকারের প্রধান লক্ষ্য হবে দুটো। সরকার সব কর্মকান্ড এ দুটো লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাজাতে পারে।
১. জুলাই হত্যাকান্ডসহ দীর্ঘ ১৫ বছর যারা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার সঙ্গে থেকে খুন, গুম করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে, মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, বিচার বিভাগকে স্বৈরাচারের হুকুমের গোলামে পরিণত করেছে, মানুষের বাক-স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, সংবাদপত্রগুলোকে দলের প্রচার বিভাগে পরিণত করেছে, প্রতিটা জায়গা একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তাদের অতি দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে এসে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা।
২. সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ব্যবস্থা করা। তার আগে সরকারের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ বাহিনীসহ নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে এমন সবকিছু অপসারণ করতে হবে।
এ দুটো লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকারকে একটা উল্লেখযোগ্য সময় দিতে হবে। তবে একটা ‘অনির্বাচিত’ সরকারকে দীর্ঘয়িত করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে হলে অবশ্যই সব দলের অংশগ্রহণেই একটা নির্বাচন হতে হবে। তবে কোনো রাজনৈতিক দল আবার যেন শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিবাদ না নিয়ে আসতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য বর্তমান সংবিধান বাতিল বা পুনর্লিখন করে নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ যে কোনো সরকারকে এক ব্যক্তির শাসনে রূপান্তর করতে সহায়তা করে। যেমনটা গত ১৫ বছরে দেখা গেছে। সংবিধানের আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমেই দেশে গণতন্ত্রকে পুনর্গঠন করা সম্ভব।
তাছাড়া নির্বাচন কমিশনের সংস্কার অতীব প্রয়োজন। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকবে সেগুলোরও সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোরও সংস্কারের দরকার আছে। এগুলোর সমাধানের আগে কোনো নির্বাচনে আয়োজন করতে গেলে সেখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া নিয়ে শঙ্কা থাকবে। আবার সেই নির্বাচনের যারা ক্ষমতায় আসবে তারা যে অগণতান্ত্রিক আচরণ করবে না তার নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে না। ফলে সংবিধানের ১২৩ এর ৪ দফা অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়। কারণ গণ অভ্যুত্থান ও গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার সংবিধান অনুসরণ করে হয় না। সংবিধান অনুসরণ করে কোনো গণ অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় না। এর সঙ্গে জনগণের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কিত। ফলে যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গণ অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে সেই উদ্দেশ্যগুলো পূরণ কিংবা সেগুলো পূরণের একটা সূচনা তৈরি করে দেওয়া এ সরকারের দায়িত্ব। সেগুলো করতে যতদিন সময় প্রয়োজন এ সরকারের ততদিনই ক্ষমতায় থাকা উচিত। তবে অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদ যেন দীর্ঘায়িত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে স্থিতিশীল অবস্থা বিবেচনা করে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও মেয়াদ নিয়ে একটি গণভোটেরও আয়োজন করা যেতে পারে।
লেখক : গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ক গবেষক
পিএইচডি ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা