ফেনীর মানুষ এমন বন্যা কখনো দেখেনি। অনেকেই এখন পর্যন্ত ফিরতে পারেনি নিজের ঘরে। যারা ফিরেছেন তাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে নতুন সব দুঃসহ অভিজ্ঞতার। বেড়েছে নতুন ব্যস্ততা। আঙিনাজুড়ে ভেজা তোশক, কাঁথা, বালিশ, আসবাব শুকানোর চেষ্টা চলছে। আকস্মিক অথৈ পানি নেমে গেলেও তার ভেজা চিহ্ন রেখে গেছে এখানে-সেখানে। রেখে গেছে ভয়াল দিনের স্মৃতি। ফেনীর কালাপোল এলাকার এক গৃহিণী ২১ আগস্টের ভয়াল স্মৃতির কথা মনে করে হাউমাউ করে কাঁদলেন। বললেন, ঘরের সব কিছু নষ্ট হয়ে গেছে পানিতে। সেদিন পানি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে গলাপানি পর্যন্ত এসে গেল। আমার বৃদ্ধ স্বামীকে কেউ একজন এসে নিয়ে গেল। বলে গেল পরে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। গলা পানিতে আমি একা দাঁড়িয়ে ছিলাম। কেউ আসছিল না। এমন পানি আমি জীবনেও দেখিনি। পানির কী স্রোত! সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম। কেউ একজন এসে আমাকে নৌকায় তুলে নিল। পরে দেখি আমি আশ্রয় কেন্দ্রে। এমন অভিজ্ঞতা ওই অঞ্চলের প্রায় সবারই। কারও কারও চোখের জলও যেন ফুরিয়ে গেছে। বুকে কান্না জমে গিয়ে পাথর হয়ে আছে। ঘরে, বাজারে, দোকানে সবখানে মানুষের হাহাকার। যা ছিল, থেকেও সব হারিয়ে গেছে। অকেজো হয়ে গেছে বন্যার পানিতে। অনেক জায়গার পানি নেমেছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে গভীর ক্ষত দেখা যাচ্ছে কৃষি মাঠের। কৃষকের যা ছিল সবই খেয়ে গেছে বন্যার পানি, সব কিছু পচে গেছে। চারদিকে দুর্গন্ধ। ধর্মপুর গ্রামের বেলাল হোসেন ও সোলেমান মিয়াজী নষ্ট হয়ে যাওয়া ধানখেত দেখিয়ে বললেন, সপ্তাহ দুই আগেও এখানে সবুজ হয়ে উঠেছিল ফসলের মাঠ। মাঠজুড়ে এখন ধানপচা গন্ধ।
ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর গ্রামের জান্নাত অ্যাগ্রো নামের সম্ভাবনাময় একটি খামারের পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। দিন বিশেক আগেও সেখানে ফল-ফসলের সমৃদ্ধি ছিল। বন্যার অকস্মাৎ তোড়ে তলিয়ে গিয়ে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন বিধ্বস্ত চারপাশ। কথা হয় তিন উদ্যোক্তার দুজনের সঙ্গে। একজনের নাম ফরিদ উদ্দিন মাসুদ। তিনি বললেন, কৃষিতে সাফল্য খুঁজতে তিন বন্ধু কোটি টাকা বিনিয়োগে ১০ একর জমিতে ২০২১ সালে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সমন্বিত ফল-ফসল উৎপাদনের। ড্রাগন, আম, মাল্টা, কমলা, পেয়ারা, আঙুরসহ নানান ফলের গাছগুলো ফলে ফলে ভরে উঠেছিল। বন্যায় সব হারিয়ে এখন সর্বস্বান্ত।
যে কোনো দুর্যোগে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা এবং ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করতেই বাণিজ্যিক উদ্যোগগুলোতে থাকে বিমার সুবিধা। কৃষিতেও দীর্ঘদিন ধরে বিমার দাবি করে আসছেন কৃষি উদ্যোক্তারা। ফরিদ উদ্দিন মাসুদও বললেন সে কথা। ‘আজ যদি বিমা করতে পারতাম, আবার হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম। এখন কোটিপতি থেকে নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
খামারের সারি সারি ড্রাগন গাছগুলো হলুদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পচে যাওয়া ফলগুলো গাছে তখনো ঝুলছিল। আর দুই দিন পরেই লাখ টাকায় বিক্রি হতো। সেদিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছলেন মাসুদ।
আরেক উদ্যোক্তা তোফায়েল আহমেদ রনি দেখালেন মাল্টা বাগানের অবস্থা। গাছগুলো মরে হলুদ হয়ে গেছে। গাছগুলোতে পলির প্রলেপ পড়ে এমন অবস্থা হয়েছে মনে হচ্ছে মাটির তৈরি। বললেন, ‘আমরা আপনার দেখানো বিভিন্ন দেশের অ্যাগ্রোট্যুরিজমের কথা মাথায় রেখে এ বাগানটি সাজিয়েছিলাম। বড় আশা ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেছে।’ সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা নেই। এ উদ্যোগটির সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত ছিলেন ব্যবস্থাপক ইউসুফ। নিজ হাতে সাজানো সব কিছুই তছনছ হয়ে যাওয়ায় তার কাছে সবকিছুই যেন শূন্য হয়ে গেছে। বড় উদ্যোক্তা থেকে সাধারণ কৃষক, সবাই সব হারিয়ে এখন এক কাতারে।
কৃষি ও কৃষকের বর্তমান অবস্থা জানালেন ফেনী সদরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোবারক আহমেদ জুয়েল। বললেন, এখানকার ছোট-বড় সব কৃষকই এখন নিঃস্ব। একই পরিস্থিতি দেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর। লোকজন বড় অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটাচ্ছে। নীরব হাহাকারে খুঁজে ফিরছে অতীতের স্বাভাবিকতা।
ফেনীর কালাপোল এলাকার সমন্বিত খামারি আবু বকর সিদ্দিকী শূন্য খামারেই খুঁজছিলেন আগামীর দিশা। ভাবছিলেন কীভাবে পাড়ি দেবেন এ দীর্ঘ সংকটকাল? তার লাখ পাঁচেক টাকার মতো ঋণ রয়েছে। পোলট্রির দুটি শেড শূন্য হয়ে গেছে। অথচ দিন পনেরো আগেও এখানে মুরগির ডাকে মুখরিত ছিল খামার। তিনটি পুকুরের সব মাছ ভেসে গেছে। কীভাবে কিস্তি পরিশোধ করবেন আর পরিবার চালাবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। তার দাবি, স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা না করলে এ এলাকার কৃষিব্যবস্থা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্যমতে শুধু সাত জেলা- ফেনী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, মৌলভীবাজারে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হিসাব পাওয়া গেছে। অনেক এলাকায় ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। বন্যার পানি কমে গেলেও দুর্ভোগ কমেনি বানভাসি মানুষের। কৃষির ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন কৃষক আর খামারিরা। মাছ চাষের পুকুর আর পুকুর নেই, ভেসে একাকার হয়ে গেছে। ভেসে গেছে সব মাছ। কথা হয়েছে শর্ষেদি এলাকার খামারি নূর আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, মাছ চাষিদের কারও কিছু অবশিষ্ট নেই। এখন কীভাবে যে ঘুরে দাঁড়াব ভেবে পাচ্ছি না। টেলিভিশনে কৃষি সাফল্য দেখে তরুণ উদ্যোক্তা শিমুল বন্ধুদের নিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন কৃষি খামারে। সূচনাতেই তার সব স্বপ্ন ভেসে গেছে। খুঁজছেন ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি।
স্মরণকালের এ বন্যায় আক্রান্ত মানুষ অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে অনেকে বাড়ি ফিরেছেন খালি হাতে। ফিরে দেখতে পাচ্ছেন, সব ভেসে গেছে বানের জলে। দুর্গম এলাকাগুলোয় ত্রাণের সংকট এখনো রয়ে গেছে। বন্যার পানির স্রোতে অনেক এলাকার সড়ক ধসে গেছে। এতে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও এ মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়াতে চায়। বাংলাদেশের কৃষক সব সময়ই ঘুরে দাঁড়াতে জানে। আমাদের উচিত ঠিক এ সময়টায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর। কৃষক পরিকল্পিত সহযোগিতা পেলে মাটি থেকে ঠিকই ফলিয়ে আনবে সোনার ফসল। সমৃদ্ধি আসবে কৃষির সব খাতের। এদেশের কৃষক এক অনন্য জাত। সব দুর্যোগ শেষে ঠিকই মাথা তুলে দাঁড়ায়।
♦ লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব