পৃথিবীতে কোনো কিছু নির্মাণ করতে হলে নির্মাতাকে একটি মডেল বা আদল সামনে রাখতে হয়। মডেল যত নিপুণ চমৎকার হয় নির্মিতব্য বস্তুটি তত চমৎকার দৃষ্টিনন্দন হয়। পক্ষান্তরে মডেল যদি অসুন্দর দৃষ্টিকটু হয় তাহলে নির্মিতব্য বস্তুটিও অসুন্দর ফালতু হয়ে নির্মাণকাজটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পরিশ্রম প- হয়ে যায়। পৃথিবীর সাধারণ নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি বাস্তব সত্য, তেমনি একটি জীবন বিনির্মাণে সেটি আরও বেশি গুরুত্ববহ। সুন্দর সভ্য উন্নত মার্জিত জীবন গঠন করতে হলে অনুরূপ একজন আদর্শ মানুষকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। এটি চিরশাশ্বত রীতি। পৃথিবীতে যারাই বরেণ্য হয়েছেন তারাই কোনো না কোনো আদর্শকে ধারণ করে লক্ষ্যপানে ছুটে গেছেন। অবশেষে লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। আম্বিয়ায়ে কেরাম স্ব স্ব যুগের মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ ও মডেল। তাদের যারা নিজেদের জীবনের মডেল হিসেবে গ্রহণ করেছে দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ সফলতা তাদেরই পদচুম্বন করেছে। আম্বিয়ায়ে কেরামের পবিত্র সেই মিছিলের সর্বশেষ ও সর্বোত্তম ব্যক্তিত্ব মানবতার অহংকার দুজাহানের সরদার রসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ আদর্শবান ও অনুকরণীয় সত্তা। কালের পরিক্রমায় তার শরীরী সত্তার প্রস্থান ঘটলেও তার আদর্শিক সত্তা চিরভাস্বর, স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। পৃথিবীতে যতদিন সূর্য তার কিরণ বিলাবে, চন্দ্র তার জোসনা ছড়াবে ততদিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সিরাত তথা জীবনাদর্শ পুরো মানবজাতিকে আলোর পথ দেখাবে। একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সিরাত অনন্য পাথেয় জোগাবে।
প্রিয় পাঠক! একজীবনে আপনি হয়তো অনেক পড়াশোনা করেছেন এবং করবেন। কারণ, জ্ঞানার্জনের জন্য আপনাকে পড়াশোনা করতেই হবে। পড়াশোনার বিকল্প নেই। আপনার সে পাঠ তালিকায় রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র সিরাতকে রাখতে হবে অপরিহার্যরূপে। সিরাত পাঠে আপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সেটা আপনার নিজের জীবন বিনির্মাণের স্বার্থেই। আদর্শ জীবন বিনির্মাণে সিরাত পাঠ কেন অপরিহার্য সে বিষয়ক কয়েকটি দিক আমরা উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব।
একজন সভ্য ভদ্র ও সুন্দর মানুষ হতে হলে বাহ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সজ্জিতকরণ অপরিহার্য। অন্যান্য গুণাবলি যতই উচ্চমানের হোক, যদি বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিপাটি না হয়, তবে সে মানুষ কখনোই সভ্যজনদের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য চাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচর্যা তথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, চুল-দাড়ির কাট ও বিন্যাস, নখ ও বাড়তি পশমের সাফাই, আতর ও সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি। সেই সঙ্গে মার্জিত পোশাক-আশাকও এর এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু রুচিবোধের পার্থক্য, স্থান-কাল ও পরিবেশ-পরিস্থিতির তারতম্য, আত্মমর্যাদাবোধের অভাব, হীনমন্যতা ও অনুকরণ-প্রবণতা ইত্যাদি কারণে এক্ষেত্রে নানা রকমের ঢং ঢাং পরিলক্ষিত হয়, যার অধিকাংশই ভদ্রজনোচিত নয়। আপনি যদি এক্ষেত্রে একজন সুন্দরতম মানুষ হিসেবে নিজেকে অলংকৃত করতে চান, তবে সব ভদ্রের সেরা ভদ্র সবচেয়ে মার্জিত জীবন সৌন্দর্যের অনন্য উপমা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীগ্রন্থ পাঠ করুন। সেখানেই আপনি পাবেন সুন্দরতম অঙ্গসজ্জা ও শ্রেষ্ঠতম বেশবিন্যাস, যার অনুসরণ আপনাকে করে তুলবে সুদর্শন ও মার্জিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত ও রাশভারী। বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চেয়ে হৃদয় জগৎই মানুষের বেশি দামি, বরং এটাই তার প্রকৃত সারবত্তা। এটা বহু গুণের লালন ক্ষেত্র, বিপুল সম্ভাবনার বিচিত্র ভুবন। এ ভুবনের চাষাবাদ, যথার্থ পরিচর্যা দ্বারা একজন মানুষ লোক থেকে লোকোত্তর পুরুষে পরিণত হতে পারে। আবার অবহেলা-অনাদরের ফলে এখানে এতটা আগাছা ও পাশববৃত্তির জন্ম নেয়, যা মানুষকে পরিণত করতে পারে হিংস্রতম হায়েনায়। কিন্তু আফসোস! আজকে এদিকটা নিদারুণভাবে উপেক্ষিত। মানুষের সর্বাত্মক চেষ্টা ব্যয় হচ্ছে বস্তুগত উন্নতির পেছনে। সে আজ তার শারীরিক চাহিদা ও পাশববৃত্তি চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতায় উন্মাতাল আর যে প্রতিযোগিতার যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছে তার সুকুমারবৃত্তিগুলো। এভাবে ঘটছে মানুষের মানবিক আত্মহনন। প্রিয় পাঠক! আমাদের এ সর্বনাশা প্রবণতা পরিহার করে মানবিকতার চর্চায় মন দিতে হবে। প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে অন্তর্লোকে নিহিত গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। তা কোথায় পাব সে পথের দিশা? হ্যাঁ, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনচরিত। সেখানে পাওয়া যাবে উত্তম চরিত্রের বিকশিত রূপ পরিপূর্ণ মাত্রায়।
♦ লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর