দেশবরেণ্য প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, জাতির মেধাবী সন্তান ও প্রকৌশল ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহজাহান মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন। প্রকৌশলী শাহজাহান এমন একটি নাম, যার পরিচয়ের জন্য কোনো বিশেষণের প্রয়োজন পড়ে না। সবার চোখে তিনি একজন শিক্ষক ও একজন সফল প্রকৌশলী। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশই একজন পানি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁকে চেনে। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (১৯৯১-৯৬) এবং ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশের (আইইবি) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুবার নির্বাচিত হন।
তিনি দেশের প্রকৌশল ব্যবস্থায় যুগান্তকারী কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। ভিসি হওয়ার পর তিনি বুয়েটের ইতিহাসে নতুন ধারা সংযোজন করেন। এদেশের অহংকার মেধাবী ছাত্রদের পাদপীঠ বুয়েট যখন সেশনজটের অক্টোপাসে আবদ্ধ তখন তিনি সেশনজট কমাতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। তিনি দুই ব্যাচ এক করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বুয়েটের শিক্ষক সমাজ তাঁকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিল। বুয়েটে আজ যে লেভেল পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে তার উদ্যোক্তাও তিনি।
তিনি বাংলাদেশের একজন সফল বন্যা ও আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ছিলেন, যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭৯-৮০ সালে। তখন দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ওই সময় আলোচিত তিস্তা ব্যারাজ সিল্ট ট্রাপটি নদীর পানিকে স্বল্প ব্যয়ে পলিমুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সমীক্ষা ও সিল্ট ট্রাপের ডিজাইন প্যারামিটার নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রকৌশলী মুহাম্মদ শাহজাহানকে। এ থেকে তাঁর কারিগরি, মেধা ও মননের উৎকর্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এবারের শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। তিস্তা এখন মৃতপ্রায়। তিস্তা নদীকে বাঁচাতে হলে উজানের পানির বিকল্প নেই। কারণ তিস্তার গঠন মূলত বালুমাটি দিয়ে। এখানে বর্ষার পানি সংরক্ষণ ও নদী খনন করে এ নদীতে পানি ধরে রাখা সম্ভব নয়। পানি না পেলে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হবে। এ ধারণা প্রকৌশলী মুহাম্মদ শাহজাহান নব্বই দশকের শুরুতেই দিয়েছেন। উজানের পানি পেতে ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তিনি যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ছিলেন।
মুহাম্মদ শাহজাহান ১৯৯৬ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে বিশেষ সাক্ষৎকারে বলেন, ভারত গঙ্গার পানিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
তিনি তথ্য প্রকাশ করেন, উজানে গঙ্গা নদীর পাড়ে ভারতীয় এলাকার কমপক্ষে ৮০টি রাসায়নিক শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে উৎপাদনে গিয়েছে। এর মধ্যে সার কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ডাইং মিল রয়েছে। এসব শিল্প কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, সরাসরি গঙ্গার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এ পানি ফসলি জমির জন্য ক্ষতিকর। পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে পানির মান বা কোয়ালিটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূগর্ভস্থ পানি দূষণজনিত কারণে আর্সেনিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে।
গঙ্গার পানিতে রয়েছে বাংলাদেশিদের ন্যায্য অধিকার। এ অধিকার আমাদের আদায় করে নিতে হবে। পানি এটম কিংবা হাইড্রোজেন বোমার চেয়েও বড় মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যারা পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই হবে বড় অস্ত্রের অধিকারী। অধ্যাপক মুহাম্মদ শাহজাহানের পানি ও নদী প্রবাহ নিয়ে গবেষণা ও চিন্তাধারা আজ বাংলাদেশের সব নাগরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে। তিনি দুই সন্তানের জনক। তাঁর পুত্র প্রকৌশলী ড. মোহাম্মদ ইকবাল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। তিনি ওয়ার্ক স্টাডি ও আইপিইতে ৩৪ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। তাঁর একমাত্র কন্যা আমেরিকাতে প্রবাসজীবনে রয়েছেন। আগামীকাল ২০ সেপ্টেম্বর তাঁর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমরা তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, অ্যাব।
মনিটর, জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন (জেডআরএফ)