দলের নেতা-কর্মীরা ‘আয়রন লেডি’ বলে অভিহিত করতেন শেখ হাসিনাকে। বিরোধী দল দমনে তার কৃতিত্বের জন্যই নেত্রীকে লৌহ মানবী হিসেবে কল্পনা করে মোসাহেবরা আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। কারও কারও কাছে শেখ হাসিনা ছিলেন সাক্ষাৎ বাঘিনী। বলা হতো বাঘে ধরলে ছাড় পাওয়া যায়, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না। কিন্তু গণ অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে শেখ হাসিনা লৌহ মানবী নন। বরং কাচ দিয়ে গড়া ভাস্কর্য মাত্র। দড়ি ধরে দাও টান স্বৈরাচার হবে খান খান স্লোগানেই তার তখ্তে তাউশ ভেঙে পড়েছে। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
যাকে ভাবা হতো বাঘ বা বাঘিনী তিনি যে নিছক বাঘডাশা তাও প্রমাণিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেত্রী পালিয়েছেন জনরোষের ভয়ে। দলের নেতা-কর্মীরা আশ্রয় নিয়েছেন ইঁদুরের গর্তে। সেখানে বসেও ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরিতে ব্যস্ত তারা। পতিত সরকারের গোয়েবলসীয় বাহিনী একের পর এক গুজব ছড়াচ্ছিল বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে। তবে ১৭ সেপ্টেম্বরের সমাবেশ থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গুজব রটনাকারীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সব কার্যক্রম মনঃপূত না হলেও তাদের কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। কারণ হাজারো শহীদের আত্মদান ও ছাত্র-জনতাসহ সর্বস্তরের জনগণের আন্দোলনের ফসল অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা মানেই আমাদের সবার ব্যর্থতা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর বাংলাদেশ ছিল মাফিয়া চক্রের দখলে। ফ্যাসিস্ট ওই চক্র দেশকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। গত দেড় দশকে দেশ থেকে ১৭ লাখ কোটি টাকারও বেশি বিদেশে পাচার হয়েছে। মাফিয়া চক্র শুধু অর্থনীতি ধ্বংস করেনি, দেশের বিচার ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে। দেশকে আমদানিনির্ভর ও পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। মাফিয়ারা দেশের ব্যাংকগুলো দেউলিয়া করেছে। একটা দেশ কতটুকু সভ্য, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে ফুটে ওঠে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে দেশ ১০০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ঋণে জর্জরিত। যে শিশু আজ জন্ম নিচ্ছে তার মাথায় দেড় লাখ টাকা ঋণ। স্বৈরাচারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। মাফিয়া চক্রের প্রধান দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের লোকজন প্রশাসনে এখনো সক্রিয়। তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। জনগণকে তাদের পাশে থেকে সহযোগিতা করতে হবে। গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত নয়াপল্টনের বিশাল সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য দুটি কারণে তাৎপর্যের দাবিদার। প্রথমত, বিএনপি এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। সবচেয়ে সুসংগঠিত গণসংগঠন। দেশের এমন এলাকা নেই যেখানে এ সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। যেখানে বিএনপির কর্মী বা সমর্থক নেই। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে। তার উপদেষ্টারা সুযোগ্য সৎ এবং সজ্জন হিসেবে পরিচিত। তবে তারা রাজনীতির কেউ নন। তাদের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নেই। দেশের ছাত্রসমাজ, আমজনতা ও গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলো তাদের ভরসা। বিএনপি দেশের বৃহত্তম দল। যে কারণে অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিএনপির সমর্থন এ সরকারের শক্তি বলে বিবেচিত হবে। জুলাই বিপ্লবে দেশ ছেড়ে পালানো এবং ইঁদুরের গর্তে লুকানো কর্তৃত্ববাদী শাসক ও তাদের অনুচরদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র থেকে বিপ্লবের সুফল রক্ষায় সমর্থন জোগাবে। নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যে কোনো রাজনৈতিক দলের পছন্দ-অপছন্দের পার্থক্য থাকতেই পারে। প্রকৃতিগতভাবে দুটি মানুষের মধ্যে সব বিষয়ে মতের মিল পাওয়া দুষ্কর, সেখানে এ সরকারের সঙ্গে তাদের সমর্থকদের কোনো ক্ষেত্রে মতভিন্নতা থাকতেই পারে। কিন্তু এ সরকার যেহেতু ১৮ কোটি মানুষের আবেগের ফসল, সেহেতু তাদের মদত দেওয়া বিএনপিসহ জুলাই বিপ্লবের সমর্থক সব দলের কর্তব্য। সে বিবেচনায় বিএনপি সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে সরকারকেও ভাবতে হবে, পতিত কর্তৃত্ববাদের গুটিকয় মোসাহেব ছাড়া দেশের সিংহভাগ মানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবে এমন কিছু করা যাবে না- যা তাদের গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করে। বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে সংস্কার এবং অবাধ নির্বাচনের পথ রচনায় সরকারকে তাদের সব মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই বিপ্লবের ফসল। জুলাই বিপ্লবে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের অর্ধেকই বিএনপির সঙ্গে জড়িত। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় সারা দেশে ৮৭৫ জন শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপির সঙ্গে জড়িত। দেশজুড়ে শহীদ হওয়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের একটা বড় অংশ যে বিএনপির নেতা-কর্মী, তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং তা তাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিবার্য ফল। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও ছাত্র-জনতার বিজয়ের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নির্যাতিত মানুষের বেদনার অপ্রকাশিত ইতিহাস। গুম হওয়া ছেলের ঘরে ফেরার প্রতীক্ষায় ব্যথাতুর মায়ের ডাক। স্বামী হারানো বেদনাবিধুর স্ত্রীর অনন্ত আর্তনাদ। পঙ্গু বাবার জন্য সন্তানের হৃদয়বিদারক হাহাকার। আর কারাগারে বন্দি ভাইয়ের জন্য বোনের নীরব প্রার্থনা। তাদের সবার ১৬ বছরের রক্ত, শ্রম ও অশ্রু দিয়ে, প্রতিটি পরিবারের ক্ষোভ, ক্রোধ ও অব্যক্ত ব্যথা বুকে ধারণ করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছে মজলুম মানুষ। এর আগে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির ১ হাজার ৫৫১ জন শহীদ ও গুম হয়েছেন ৪২৩ জন। আর সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে ওই সময়ে গুমের সংখ্যা প্রায় ৭০০। বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দেড় লাখ গায়েবি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৬০ লাখ মানুষকে। এসব তথ্য কেবল বিএনপির ত্যাগের পরিসংখ্যানই নয়, বরং অবিচল সংগ্রাম ও অবদানের প্রতিফলন। গণ অভ্যুত্থান হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এটি বহু বছরের নির্যাতন, নিপীড়ন ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন পরিক্রমা। এখানে বিএনপির অবদান খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। আন্দোলনের কৃতিত্ব নয়, স্বৈরাচার পতন নিশ্চিত করাই ছিল বিএনপির লক্ষ্য।
আশঙ্কার কথা, পতিত সরকারের সুবিধাভোগীরা উঠেপড়ে লেগেছে জুলাই বিপ্লবকে ব্যর্থ করতে। প্রতি-বিপ্লবের পরিবেশ সৃষ্টিতে তারা কলকারখানায় অশান্তির উসকানি দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য সফল হলে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। কলকারখানা বন্ধের জন্য শিল্প ক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। এজন্য পরিকল্পিতভাবে শিল্পমালিকদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা রকম মিথ্যা মামলা চাপানো হচ্ছে। এমন মামলাও দায়ের করা হচ্ছে যেখানে বাদী আসামিকে চেনেনই না। তার নামও জানেন না- সংবাদমাধ্যমে এমন খবরও প্রচার হয়েছে। কোথাও যে পুতুলনাচের ইতিবৃত্ত চলছে এটি তারই প্রমাণ। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে অস্বস্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে সরকারকেই তা রুখে দিতে হবে।
দেড় দশকের স্বৈরশাসন অবসানের দেড় মাস পেরিয়েছে। ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণ অভ্যুত্থানে অর্জিত বিজয়কে অর্থপূর্ণ করে তোলার কাজ চলছে জোরকদমে। রাষ্ট্র সংস্কারের এ ব্যস্ত সময়ে উৎপাদন ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অত্যন্ত জরুরি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পোৎপাদন গতিশীল রাখার বিকল্প নেই। তাই নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্যোক্তাদের শতভাগ আশ্বস্ত করা না গেলে বিনিয়োগ বিঘিœত হবে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে পুষ্টির জোগানে ভাটা পড়বে।
বাংলাদেশ দেড় দশক ধরে বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আওয়ামী শাসকরা হয়তো এটিকে কৃতিত্ব বলে ভেবেছেন। যে কারণে ঘুষ-দুর্নীতি রোধের গণদাবি সত্ত্বেও তারা নির্বিকার থেকেছেন। বিগত সাড়ে ১৫ বছরের প্রশ্নবিদ্ধ শাসনে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার কসরত চলেছে। এ সময় দেশ থেকে ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বিদেশে। দুই বছরের মধ্যে ডলারের দাম ৮৫ থেকে ১২০ টাকায় পৌঁছানোর প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার। এ অনৈতিক কর্মকান্ডে আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও তাদের সহযোগী আমলা কেউ পিছিয়ে ছিলেন না। বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা স্বীকার করেছে পতিত সরকারও। তা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকারও কম হয়নি। কিন্তু বোধগম্য কারণেই তারা সে উদ্যোগ নেননি- কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার ভয়ে। বর্তমান সরকারের কর্ণধারদের মধ্যে সে শঙ্কা না থাকায় তারা এ বিষয়ে শুরু থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছেন। বিগত সরকারের মদতপুষ্ট যেসব ব্যক্তি বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে বাড়িঘরসহ নানা সম্পদ গড়েছেন, সেই অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। বিশেষত যুক্তরাজ্যে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকের বসবাস। তাদের অনেকেই সেখানে আর্থিক ও রাজনৈতিভাবে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের বাড়ি ও ব্যবসা রয়েছে যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান তার ব্যক্তিগত প্রভাব কাজে লাগিয়ে সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচারকৃত অর্থের একাংশ ফেরত আনার উদ্যোগ নেবেন। অর্থ পাচারের সব ফাঁকফোকরও বন্ধ করা হবে।
♦ লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক